‘কিন্তু তুমি কেন বললে আমার বিপদ হবে?’ অস্থির লাগছিল টুনুর।

‘বলছি, কারণ তোমার সব কথা বিশ্বাস করছি। অন্য অনেকেই করবে না, ভাববে তুমি ভয় পেয়েছ, মনের ভুল এসব। কিন্তু আমি জানি, তুমি ভুল করোনি। যা বলেছ সব সত্যি। আমি দেখতে পাচ্ছি, এবার তোমার ক্ষতি হবে। অন্যদের মতো’।

‘কাদের মতো?’

পরেশ মাঠের ওপরেই বসে পড়ল, ফলে টুনুও। পরেশের ঠোঁট নড়ছে, অনেক কিছু বলতে চায় তবু পারছে না। শেষে টুনুর দিকে তাকিয়ে লম্বা নিশ্বাস ফেলল। ‘তোমাকে বলা যায়। তুমি বুঝবে।’

‘এই গ্রামে অনেকদিন ধরেই বাচ্চারা নিখোঁজ হয়ে যায়, মরে যায়।’ নিজের মনে বলতে শুরু করল পরেশ। ‘কেন, কেউ জানে না। শুরু হয়েছিল বছর কুড়ি আগে থেকে। বামুনপাড়ার একটা ছেলেকে জলের নীচে যখ টেনে নিয়ে গিয়েছিল বলে শোনা যায়। সাঁতার কাটতে নেমেছিল, আর ওঠেনি।’

‘যখ কী?’




‘আছে একরকম। অপদেবতা বলি আমরা। জলের নীচে থাকে। সেই ছেলেটাকে আর কখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। তার এক বছরের মাথায় আরো একজন মরেছিল, বাড়ির ছাদ থেকে কেউ ঠেলে ফেলে দিয়েছিল। কিন্তু সেই সময় ছাদে কেউ ছিল না। সেদিন মেলায় যে পাগলটাকে দেখলে, তাকেও বাচ্চাবেলায় মাথার পেছনে বাড়ি মেরে কেউ অজ্ঞান করে দিয়েছিল। তারপর থেকেই এরকম। তারপর আরো একজন, হারিয়ে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। মাঝে মাঝেই এখান ওখান থেকে এরকম হারিয়ে গিয়েছে, তাই বাবা- মায়েরা সবাই ভয়ে থাকে। পাঁচু ঠাকুরের পুজো করে ধুমধাম করে। তোমার কি ভয় লাগছে?’

টুনু মাথা নাড়ল।

‘ভয় লাগাটাই স্বাভাবিক। তোমাকে এগুলো বলাটাও ঠিক হচ্ছে না, তার ওপর তুমি অসুস্থ। কিন্তু বলছি, কারণ আমি চাই না তুমি এখানে থাকো।’

‘কেন? আমাকেও মারবে?’

পরেশ টুনুর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল। ‘কিছু একটা আছে টুনু, ওই বাড়িতে, এই মাঠে, ওই জঙ্গলে। আমি বুঝতে পারি, ছোটবেলা থেকে বুঝতে পেরে আসছি, কিন্তু ধরতে পারি না।’

‘তোমার ভয় লাগে?’

পরেশ আকাশের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল, ‘লাগে। ছোট থেকে ওই ভয়টা পুষতে পুষতে বড় হয়ে উঠেছি। ভয় লাগে যে এক্ষুনি কেউ আমাকে ঠেলে ফেলে দেবে ছাদ থেকে, বা পুকুরের তলায় টেনে নিয়ে যাবে। কী সেটা, আমি জানি না।’ পরেশের গলা কাঁপছে, মুখে চোখে বলিরেখা, মনে হচ্ছে কত না বয়েস, ‘আর জানি না বলেই আরো বেশি করে ভয় লাগে।’


টুনু সব বুঝতে পারছিল না, এর আগে কেউ তার সঙ্গে এরকম বড়দের মতো কথাও বলেনি। কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে প্রশ্ন করল, ‘আর ওই তালগাছ? ওখানে কি একানড়ে থাকে?’


‘আজ যখন তুমি আমাকে এগুলো বললে, আমার ভয় লাগল তোমার জন্যে। কারণ আমি এতদিন এগুলো দেখে এসেছি, যাদের সঙ্গে ছোটবেলা থেকে খেলাধুলো করে এসেছি তারা মরে গেছে, হারিয়ে গেছে, পাগল হয়ে গেছে, আর আমি ভেবে এসেছি, কবে আমার পালা আসবে। রাত্রে আমি ঘুমোতে পারি না টুনু। উঠে বসি, জল খাই,’ পরেশ আর টুনুকে বলছে না, নিজেকেই শোনাচ্ছে, ‘জানালা দিয়ে অন্ধকার বাইরে তাকিয়ে দেখি, ঝুঁকে পড়া বাঁশগাছের ওপর যেন কেউ এসে বসেছিল, এই মাত্র চলে গেল। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বারবার পিছু ফিরে তাকাই। কিন্তু সে শুধু আমার ভয়। আর আজ তোমাকে নিয়ে ভয় লাগছে। কেমন মনে হচ্ছে, তোমার ওপর একটা ছায়া পড়ে আছে।’ অস্থিরভাবে মাথার চুল ঘাঁটল পরেশ, ‘কিছু একটা আছে, যার নজর তোমার ওপর পড়েছে।’

টুনু সব বুঝতে পারছিল না, এর আগে কেউ তার সঙ্গে এরকম বড়দের মতো কথাও বলেনি। কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে প্রশ্ন করল, ‘আর ওই তালগাছ? ওখানে কি একানড়ে থাকে?’

আতঙ্ক মেশানো চোখে পরেশ টুনুর দিকে তাকাল। ঠোঁট শুকনো, চাটছে বারবার, তারপর মাথা নেড়ে নিজের মনেই বলল, ‘পাপ, আমাদের সবার পাপ। পিছু ছাড়বে না।’

‘পাপ, মানে? আমি কিছু বুঝতে পারছি না।’ টুনু অসহায় গলায় বলল।




পরেশ কিছু না বলে নীরবে তালগাছের দিকে তাকিয়ে থাকল। শকুন উড়ছে, আজকেও। চিঠিটা এখন আর গাছের গোড়ায় নেই, টুনু ঘুরতে ঘুরতেই দেখে নিয়েছিল। বিশাল মাঠ এখন জনহীন, শুধু কাছে- দূরে ছোটবড় বুনো বৈঁচি, আশশ্যাওড়া, আকন্দ কুলের ঝোপজঙ্গল অল্প হাওয়ায় কাঁপছে। সেই ঝোপঝাড় ঘন হতে হতে একসময়ে মিশে গেছে যে জঙ্গলের মধ্যে, এই সকালবেলাও তাকে কালো দেখাচ্ছে, হয়ত ভেতরে আলো ঢোকে না। তালগাছের মাথা এখনো ধোঁয়া ধোঁয়া, আবছা, ওপর থেকে বসে কেউ তাদের দেখলেও চট করে বোঝা যাবে না। টুনুর পেটের কাছে হঠাৎ করেই যেন একটা গুবরেপোকা হেঁটে গেল। হালকা শিউরে উঠে সে বলল, ‘আমাকে কেন ধরবে কেউ? আমি তো কিছু করিনি?’

‘তুমি চলে যাও টুনু। মা-কে বলো, যেন এসে নিয়ে যায়।’ ক্লান্ত স্বরে বলল পরেশ।

‘মা আসবে না।’ অস্ফুটে কথাগুলো বলার পরে টুনু যোগ করল, ‘দিদাও নেই’।


বামুনপাড়ার একটা ছেলেকে জলের নীচে যখ টেনে নিয়ে গিয়েছিল বলে শোনা যায়। সাঁতার কাটতে নেমেছিল, আর ওঠেনি।


তখন হনহন করে তাদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল বিশ্বমামাকে, আর পরেশ ত্রস্ত উঠে দাঁড়াল, দেখাদেখি টুনুও। বিশ্বমামা তাদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পরেশকে রূক্ষস্বরে বলল, ‘টুনুর শরীর খারাপ, ওকে হিম খাওয়াচ্ছিস কেন?’

‘না, এখন তো রোদ–‘ আমতা আমতা করছিল পরেশ।

‘টুনু, বাড়ি এসো’। কঠিন গলায় বলল বিশ্বমামা, যার পর আর কথা চলে না। বিশ্বমামার পেছন পেছন চোরের মতো মাথা লুকিয়ে আসছিল পরেশমামা, যেন অদৃশ্য হয়ে যেতে পারলে বাঁচে। টুনু গেটের ভেতর ঢুকে গিয়ে কুয়োতলায় দাঁড়িয়ে দেখল, বিশ্ব পরেশের দিকে আঙুল তুলে কিছু বলছে, নিচুগলায় কথা বলছে বলে ভাল শোনা যাচ্ছে না, কিন্তু দু’জনেই যেন উত্তেজিত। টুকরো টুকরো কিছু কথা ভেঙে গিয়ে টুনুর কানে আসছিল যা থেকে কিছুই বোঝা যায় না।




‘…কেন বুঝতে চাস না! এসব কি এমনি এমনি… ‘

‘… শুনব না কিছু। আসিস না এখানে। পুরনো কথা আর ভাল লাগে না…’

‘নিজের চোখেই দেখেছিস তুই… পর পর ঘটেছে’

‘না, বলছি তো না…কেন এক জিনিস বারবার… তোর মাথা খারাপ, অন্যের মাথা খাস না… ‘

‘কিচ্ছু নেই… সব বাজে কথা… তোর মনগড়া… ‘

‘টুনুকে দেখিস। ও ভাল নেই।’

দু’জনেই এক সময়ে কথা থামিয়ে স্তব্ধ হয়ে দূরের দিকে তাকিয়ে ছিল, কারণ দু’জনেই হয়ত ভেবেছিল একটা নিষ্ফল তর্ক চালিয়ে যাচ্ছে, না চাইলেও। তারপর পরেশ কিছু না বলেই হাঁটতে শুরু করল, বিশ্বও তাকে ডাকেনি।

টুনু ধীরে ধীরে নিজের ঘরে আসল। তার ওপর একানড়ের নজর–তাকেও ধরে নিয়ে যাবে, ছোটমামার মতো, কিন্তু তাহলে যে চিঠি লিখল, তার কী হবে? কেনই বা গম্বুজ, তার স্বপ্নে এবং খাতায়? ঐ ঘরে কি তাহলে যে থাকে, সে টুনুকে নিয়ে যেতে চায়, অন্য কোথাও, যেখানে ছোটমামা আছে? টুনু বুঝল, তার জ্বর আস্তে আস্তে বাড়ছে। জ্বরাসুর নেমে আসছে তালগাছ বেয়ে। ঠোঁট টিপে শুয়ে থাকল জানালার দিকে তাকিয়ে, কারণ যতই মুখ লাল হয়ে উঠুক আর কান ঝাঁ ঝাঁ, দিদা জানলে আবার রাগ করবে।




ঠক করে একটা ঢিল এসে পড়ল তার বালিশে। টুনু ধড়মড় করে উঠে জানালা দিয়ে দেখল, সেই ছেলেগুলো, নিজেদের মধ্যে খেলছে, ঢিল ছোঁড়াছুঁড়ি করছে। একজন আবার উঠছে তালগাছটা বেয়ে। ভাল লাগছে না, ফিরে এসে টুনু আবার শুয়ে পড়ল। একটা চিঠি লিখতে হবে। ছোটমামা কোথায় আছে, সে না হয় হল, কিন্তু টুনুকে কেন ধরে নিয়ে যাবে? ছোটমামার কাছে নিয়ে যাবে? তাতে লাভ কী, যদি না দু’জনেই দিদার কাছে ফিরে আসতে পারে! বরং টুনুও যদি চলে যায়, তাহলে তার মা-ও সারাদিন দিদার মতো জানালার ধারে দাঁড়িয়ে থাকবে। ভয় করছে, খুব ভয় করছে ঠিক, যখন মনে হচ্ছে যে একদিন তাকেও ওই তালগাছের মাথায়, কিন্তু কী করতে পারে সে, একানড়ের সঙ্গে কথা চালিয়ে যাওয়া বাদে! হয়ত চিঠি লেখবার জন্যেই ছোটমামার খাতায় গম্বুজের ছবি এঁকে দিয়েছে। পরের চিঠি পাঠালে নতুন কিছু কি আর জানাবে না? টুনু চোখ বন্ধ করে বালিশে মুখ গুঁজে দিল–সারা শরীরে ঝাঁপিয়ে পড়ছে ভাইরাস, লড়তে লড়তে ক্লান্ত লাগে।

সন্ধেবেলায় জ্বর কিছুটা নামল। এই সময়টায় টুনু কাউকে কিছু বলেনি, চুপচাপ শুয়ে থেকেছে, হয়ত দিদা ঘরে এসে তার কপালে হাত রাখবে, বুঝে যাবে, কিন্তু দিদা আসেনি। নীচে থেকে শুধু গুবলুর সঙ্গে তার খেলার খিলিখিলি শব্দ। জ্বরের মধ্যেই টুনু চিঠি লিখেছে, এবং যত জ্বরই আসুক না কেন, আবার রেখে আসতে হবে। একানড়ে বসে আছে। তার অপেক্ষায়।

handwritten letter Ekanore episode 11

পরবর্তী পর্ব ২৬ জানুয়ারি সন্ধ্যে ছটা।
*ছবি সৌজন্যে Pinterest

একানড়ে পর্ব ১০

 

শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৮২ সালে কলকাতায়। প্রথম গল্প বেরিয়েছিল পরিকথা পত্রিকায়, ২০০৩ সালে। এ পর্যন্ত লিখেছেন সাতটি উপন্যাস ও প্রায় চল্লিশটি ছোটগল্প। মূলত লিটল ম্যাগাজিনই তাঁর লেখালেখির জায়গা। এ পর্যন্ত পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *