হাতে টানা রিকশার ঠুং ঠুং শব্দে কলকাতার মাদকতা জড়িয়ে আছে। আজ অতীত এই রিকশা। গুটিকয়েক ছড়িয়ে ছিটিয়ে উত্তর বা দক্ষিণ কলকাতার পুরনো পাড়ায় গাছের তলায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে বটে, কিন্তু তাদের ঠুং ঠুং আওয়াজ আর শোনা যায় না। আমরা যারা টানা রিকশা করে ইসকুল গিয়েছি কিংবা বিজলীতে সিনেমা দেখতে যেতাম, বর্ষাকালে নিয়ম করে রিকশা করে নাচের ক্লাশ থেকে ফিরতাম, তারা এর অদৃশ্য মোহের জাল কেটে বেরতে পারিনি।

একটি বিশেষ ক্রিম ছাড়াও বঙ্গ জীবনের অঙ্গ এই হাতে টানা রিকশাও। আমি ছোট বেলা থেকে টানা রিকশায় চড়ে অভ্যস্ত বলে এখনও আমার সাইকেল রিকশায় বসে কোথাও যেতে অসম্ভব ভয় করে। লোকজন-বন্ধুবান্ধব শুনে হাসে। কিন্তু ঘাম ফুটে ওঠা, কালো  শীর্ণ হাতগুলো আসলে আমায় অনেক বেশি ভরসা যোগাত। বার দু’য়েক রিকশা উল্টে পড়ে যাইনি, এমনটা নয়। তা হলেও টানা রিকশাই আমার প্রিয়। আমার ধারণা অনেকেরই প্রিয়। টানা রিকশার গুণপনার কথায় হাতিবাগানের রিকশাওয়ালাদের বিশেষ স্কিলসেট বর্ণনা না করে শেষ করা যায় না। আমি ও পাড়ায় কখনও রিকশায় চড়িনি, কিন্তু বাস থেকে দেখেছি কী তুখোড় ভাবে রিকশাওয়ালারা সওয়ারি সমেত রিকশা সামলাতে পারে। সারি সারি দোকান, বাস-ট্রাম, অসংখ্য রিকশা, প্রচুর পথচারি যাঁরা রাস্তা দিয়ে হাঁটাই দস্তুর করেছেন— এঁদের প্রত্যেককে সামলে কোনও অ্যাক্সিডেন্ট না করে প্রতিটি রিকশাওয়ালা, প্রত্যেক সওয়ারি কে গন্তব্যে পৌঁছে দিয়েছে। এটা বিশেষ হাততালিযোগ্য।

খাস দক্ষিণ কলকাতার বুকে টানা রিকশা দর্পের সহিত দাপাইয়া বেড়াত, শুনলে মনে হয় গপ্পো দিচ্ছে। কিন্তু না, মনোহরপুকুর রোডের মুখে টানা রিকশার স্ট্যান্ড ছিল। এবং ওই স্ট্যান্ডে আমার ছোটবেলা এখনও ঠায় দাঁড়িয়ে। বাড়ির চাইল্ড লেবার যত দিন ছিলাম, ততদিন মুদির দোকান বা ভুজিয়াওয়ালার দোকান থেকে অনেক সময়ই রিকশায় লিফ্ট নিতাম। কিংবা বিকেল বেলায় আমি ডানপিটে, অন্য খুদেদের জুটিয়ে স্ট্যান্ড থেকে রিকশায় উঠে মেন রাস্তা দিয়ে গিয়ে গ্রিক চার্চের পাশ দিয়ে বেঁকে ফের মনোহরপুকুর রোডের মুখে এসে রিকশা থেকে নামতাম। এই সব রাইডগুলো ফ্রি ছিল। চোখ পাকিয়ে আমি ওদের নিয়ে যেতে বাধ্য করতাম। কারণ তখন আমাদের হাতে পয়সা দেওয়া হত না। অতএব স্পোরাডিক গুন্ডামিই ছিল আমার সম্বল। ওখানকার রিকশাওয়ালাদের নাম যে খুব জানতাম তা নয়, কিন্তু তারা যে আমারই এক্সটেন্ডেড পরিবার ছিল, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। আমার মা, যাঁর কিনা সর্বদা মনে হত ছেলেধরায় তাঁর মেয়েদের যখন তখন তুলে নিয়ে যাবে, কখনও একলা কোথাও ছাড়েনি, সেই মা-ও রিকশাওয়ালাদের ভরসা করে স্কুলে পাঠিয়ে দিতেন। তারাও তো আমাদের অভিভাবকের মতোই ছিল। রিকশা থেকে নামিয়ে স্কুলের গেটে না ঢোকা অবধি দাঁড়িয়ে থাকত। ঘোর বর্ষায় বুক জলে রিকশা টেনে পরীক্ষার হলে পৌঁছে দিত। পরে তার বউ এসে খবর নিত আমার এবং খবর দিত তার বরের যে সে জ্বরে কাবু। মায়ের আফশোস কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিত। তার পর তার বউ মায়ের সঙ্গে গপ্পো জুড়ে দিত জিরে, লঙ্কা আর হলুদ দিয়ে কী করে যে কোনও সবজির স্বাদ অমৃতের মতো করে তুলতে হয়।

একটু যখন বড় হলাম তখন থেকে টানা রিকশায় উঠতে চাইতাম না। তখন সমাজ সচেতনতা বাড়ছে, শ্রেণি সচেতনতা বাড়ছে, দূরদর্শনে দো বিঘা জমিন দেখে ফেলেছি। রিকশা টানতে কত কষ্ট হয়, তা বুঝতে পারি। আমি কোচিং যাওয়ার সময় যখন ওরা ঠুং ঠুং শব্দ করে “দিদি, চলিয়ে” বলত, আমি এড়িয়ে যেতাম। আস্তে আস্তে অটোর দৌড়াত্ম্য বাড়তে লাগল। টানা রিকশার বাজার পড়তে লাগল। একদিন গরমের দুপুরে গাছের তলায় সার সার টানা রিকশা আর তাদের চালকদের ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে বাড়ি ফিরে খুব তম্বি করতে থাকলাম। মাকে বললাম, ওদের এই কাজটা করার দরকার কী? আমরা কেন এত নিষ্ঠুর যে এক জন লোককে অন্য জন লোক টেনে নিয়ে যাবে! মা বলল, “কারণ ওরা একমাত্র এই কাজটাই পারে। আর তুমি যদি না ওঠো রিকশায়, তা হলে ওদের ওই রোজগারটুকুও হবে না। আর তুমি ওদের ভালবাস বলে এমনি এমনি টাকা দিয়ে দেবে আর ওরা নিয়ে নেবে, এটা অন্যায়। ওদের অপমান করা। ওরা শ্রম দান করে টাকা রোজগার করে। সেটা যেমনই হোক, তাকে সম্মান করতে শেখো।” সেই দিন থেকে আমি আবার টানা রিকশায় উঠি। ব্যস্তসমস্ত রাস্তার মধ্যে দিয়ে কাটিয়ে কাটিয়ে হেলেদুলে যেতে আমার ভালই লাগে। ছাপরা আর মুঙ্গের জেলার বহু ভূমিহীন কৃষকের রিকশায় আমার ছোটবেলা কেটেছে। যে ছোট বেলায় আনন্দ মিশে আছে, যে ছোট-বড় বেলায় ওদের কষ্ট মিশে আছে, যে বড় বেলায় ওদের অনুপস্থিতির যন্ত্রণা মিশে আছে। থাকবেও চির দিন।

আমার ছোটবেলায় কাবুলিওয়ালা ছিল না। রিকশাওয়ালারা ছিল। আমার মতো ওদেরও দেশে খোঁকি ছিল। তাদেরও সাদি হত। তার জন্য ওরা টাকা জমাত, রিকশা টেনে। ঘোর গরমে ওরা দেশে যেত, ওদের গ্রামে। মাস দুই-তিন থাকত না কখনও কখনও। অন্যের জমিতে মজুর খাটতে যেত। আর ফিরে এসে বলত, ‘দিদি তুমি তো বড় হয়ে গেলে!’

সঞ্চারী মুখোপাধ্যায় হাসিখুশি, এমনকী যখন সেই মোড-এ থাকেন না, নিজেকে ঠেলে হিঁচড়ে হিহিহোহো’তেই ল্যান্ড করানোর চেষ্টা করেন। জাপটে ভালবাসেন আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, সিরিয়াল, গান, রাস্তায় নেড়িবাচ্চার লটরপটর কান। পড়াশোনার সময় ফিল্ড করেছেন, হাতুড়ি দিয়ে পাথর ভেঙেছেন, গ্রামবাসীদের তাড়া খেয়েছেন, এক বার পাহাড় থেকে অনেকটা হড়কে পড়ে মুচ্ছো গেছিলেন, উঠে দেখেন, কবর! এক বার ম্যানেজমেন্ট কোর্সের অঙ্গ হিসেবে চিন গেছিলেন, রাত্তির দুটোয় সাংহাইয়ের রাস্তায় হারিয়ে গিয়েও কাঁদেননি। ফিউজ সারাতে পারেন, পাখার কার্বন বদলাতে পারেন, কাগজের চোঙ পাকিয়ে গাড়িতে পেট্রল ঢালতে পারেন, চিনেবাদাম ছুড়ে দিয়ে মুখে নিপুণ লুফতে পারেন। ব্যাডমিন্টন খেলার ইচ্ছে খুব, কিন্তু জায়গা ও র‌্যাকেট নেই। অরোরা বোরিয়ালিস যারা দেখেছে, তাদের একাগ্র ভাবে হিংসে করেন। দেশের বাড়িটা উনি বড় হওয়ার পর ছোট হয়ে গেছে বলে, আর আমির খান এক বার কার্টুন এঁকে দিয়েছিলেন— সে কাগজ হারিয়ে গেছে বলে, জেনুইন কষ্ট পান। এক বার ঈগলের রাজকীয় উড়ান আগাগোড়া খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *