শীতের কলকাতা মানে কিছু বছর আগেও ছিল চিড়িয়াখানায় বাঘ-সিংহের খাঁচার সামনে দু’চক্কর মেরে ব্যাডমিন্টন খেলা আর শতরঞ্চি পেতে বসে পিঠে রোদ নিয়ে কমলালেবু ছাড়িয়ে খাওয়া, ভাল খেজুর গুড়ের সন্ধান করা, এ বেলা-ও বেলা  ফুলকপি খেতে খেতে হেদিয়ে যাওয়া আর মার্গ সংগীতের আসরে, যাকে বাংলায় বলে ডোভার লেন, সেখানে যাওয়া। 

ডোভার লেন মিউজিক কনফারেন্স-এ সারা রাত ক্লাসিক্যাল বাজনা বা গান শোনা ছিল শিক্ষিত ও রুচিমানের অভিজ্ঞান। বাড়িতে আনকোরা কেউ এলে দু-চার জন ওস্তাদজির নাম করে ফেলতে পারলে, অন্য পক্ষের চোখে অপার সম্ভ্রম। শিক্ষিত হওয়ার একটা লক্ষণ ছিল ক্লাসিক্যাল সংগীতের সঙ্গে একটা বন্ধুতা পাতানো। 

এর আবার অনেকগুলো দিকও ছিল। কেউ কেউ সত্যিই বোদ্ধা ছিলেন। কেউ কেউ শুনতে শুনতে কান তৈরি করেছিলেন, অনেকে ছিলেন যাঁরা মিঠে বাজনা শুনতে ভালবাসতেন, আর একটা দল ছিল, যাঁরা শুনতেও ভালবাসতেন না, বুঝতেনও না। কিন্তু তাঁরা বোদ্ধা ও শিক্ষিত গ্রুপে নিজেদের নাম তুলতে চাইতেন। অতএব ক্লাসিক্যাল কনসার্ট মাস্ট। যতই হাসি-ঠাট্টা করি না কেন এ সব নিয়ে, একটা কথা তো মানতেই হবে যে, ক্লাসিক্যাল মিউজ়িক একটা সময় পর্যন্ত বাঙালি জীবনের অঙ্গ ছিল। কেউ কিছু জানুক বা না জানুক আলাউদ্দিন খাঁ, কেরামতুল্লা, রবিশঙ্কর, নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়, আলি আকবর খান, বিলায়েত খান, বিসমিল্লা খান, বড়ে গুলাম আলি খান সাহেব, বেগম আখতার তো চিরকাল আখতারী বাঈ– এমন সবার নাম জানত। এমনকী নিত্য মধ্যবিত্তের জীবনের মধ্যে এঁরা আটপৌরে ভাবেই নিহিত ছিলেন। আর এঁরা যে অত্যন্ত গুণী ব্যক্তি সেই সম্ভ্রম ছিল। আসলে বাঙালি সমাজের মধ্যে শিক্ষার প্রতি, নিরলস পরিশ্রমের প্রতি বাঙালির শ্রদ্ধা ছিল। সেটাই নিয়ম বলে জানত সে। মানে, সেতার-সরোদ শুনতে যাওয়া ছিল নিজেকে ঋদ্ধ করার একটা মাপকাঠি। 

ডোভার লেন মিউজিক কনফারেন্স-এর কার্ড না পেলে, অল বেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্স-এ গিয়ে সে নিজেকে শুদ্ধ করে নিত। উত্তরপাড়া সঙ্গীত চক্রে গিয়ে নতুন কাউকে খুঁজে পেত। রবিশঙ্কর কী বিলায়েত খান সামনাসামনি শোনা না থাকলে সে নিজেকে কমতি ভাবত অন্যের থেকে। তার বাকেট লিস্ট-এ এঁদের একটা লাইভ শো ছিল অত্যন্ত জরুরি, থাইল্যান্ড নয়। 

ছোট বেলায় মা-বাবার কাছে এ রকম কত গল্প শুনেছি, “বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলনে সে বছর  বিসমিল্লা খান সাহেব বসলেন, তখন রাত তিনটে হবে। সে বাজনা যে না শুনেছে, কী যে মিস করেছে। আর যখন উনি শেষ করছেন তখন ভোরের আলো ফুটছে আর খান সাহেব বোধ হয় ভৈরবী বাজাচ্ছেন।” বলতে বলতে মা-বাবার মুখে যে আলো ফুটে উঠত, তাতে বিসমিল্লা ঠিকরে বেরোতেন। আমাদের বাড়িতে যে সবাই ক্লাসিক্যাল বোদ্ধা ছিলেন তা নয়, কিন্তু মার্গ সঙ্গীতের প্রতি একটা অনুরাগ, একটা সম্মান সব সময় ছিল।

সন্ধের মুখে সব বাড়ি থেকে যে হারমোনিয়ামের রিডের আওয়াজ আর অপটু গলায় বিলাবল রাগ গাওয়ার চেষ্টা, এ তো  সেই পরিশ্রম, সেই নিখুঁত উচ্চতায় পৌঁছনোর সাধনা। 

এখন সেটা নেই বললে খুব ভুল হবে। এখনও আছে। এখনও কিছু মানুষের মধ্যে সেই আদিকে খোঁজার, তার আস্বাদ গ্রহণ করার প্রবণতা রয়েছে। কিন্তু আম-জনতার কাছে ক্লাসিক্যাল মিউজিকের কদর কমেছে। কিংবা ক্লাসিক্যাল মিউজিক জানাটা আর অবশ্য কর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। 

তা-ই সংস্কৃতির পীঠস্থানে নিঃশব্দে কখন ললিত, কখন মিয়াঁ কী মলহার বেজে যায়, কখন যে জোছনা আড়ি করে চলে যায়, সে কথা কলকাতা তেমন করে জানতে পারে না, চায়ও না। 

সঞ্চারী মুখোপাধ্যায় হাসিখুশি, এমনকী যখন সেই মোড-এ থাকেন না, নিজেকে ঠেলে হিঁচড়ে হিহিহোহো’তেই ল্যান্ড করানোর চেষ্টা করেন। জাপটে ভালবাসেন আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, সিরিয়াল, গান, রাস্তায় নেড়িবাচ্চার লটরপটর কান। পড়াশোনার সময় ফিল্ড করেছেন, হাতুড়ি দিয়ে পাথর ভেঙেছেন, গ্রামবাসীদের তাড়া খেয়েছেন, এক বার পাহাড় থেকে অনেকটা হড়কে পড়ে মুচ্ছো গেছিলেন, উঠে দেখেন, কবর! এক বার ম্যানেজমেন্ট কোর্সের অঙ্গ হিসেবে চিন গেছিলেন, রাত্তির দুটোয় সাংহাইয়ের রাস্তায় হারিয়ে গিয়েও কাঁদেননি। ফিউজ সারাতে পারেন, পাখার কার্বন বদলাতে পারেন, কাগজের চোঙ পাকিয়ে গাড়িতে পেট্রল ঢালতে পারেন, চিনেবাদাম ছুড়ে দিয়ে মুখে নিপুণ লুফতে পারেন। ব্যাডমিন্টন খেলার ইচ্ছে খুব, কিন্তু জায়গা ও র‌্যাকেট নেই। অরোরা বোরিয়ালিস যারা দেখেছে, তাদের একাগ্র ভাবে হিংসে করেন। দেশের বাড়িটা উনি বড় হওয়ার পর ছোট হয়ে গেছে বলে, আর আমির খান এক বার কার্টুন এঁকে দিয়েছিলেন— সে কাগজ হারিয়ে গেছে বলে, জেনুইন কষ্ট পান। এক বার ঈগলের রাজকীয় উড়ান আগাগোড়া খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *