একবারই পুজোর সময় কলকাতায় থাকা হয়নি। কলকাতা ছাড়ার সময় একটু দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। পুজো দেখতে পাব না বলে নয়। প্রথমবার অন্য দেশে যাচ্ছি, সেখানে পৌঁছে এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে যদি দেখি আমার ডাক্তার বন্ধু নিতে আসেনি, তাহলে কী হবে এই ভেবে। ইন্টারন্যাশনাল রোমিং করা ফোন ছিল না আমার, তাই ‘ওরে তুই কোথায়?’ জিজ্ঞেস করার উপায়ও ছিল না। হিথরোর অ্যারাইভাল থেকে বেরিয়ে ঠিক কোথায় দাঁড়াতে হবে, সেটা পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিল সে। আর এক বন্ধু বলেছিল, চিন্তা কোরও না, আসবেই। যদি দেখ আসেনি, তাহলে বুঝবে, লুটনে আর একজনের ফ্লাইট নির্ঘাত দেরি করেছে, তার ব্যবস্থা করে ঠিক চলে আসবে। দেশ থেকে প্রথমবার ভীতু বন্ধুবান্ধবরা এলে ও-ই রক্ষা করে আসছে বহুবছর ধরে। রেস্পন্সিবিলিটি নিয়ে কথা হবে না।
বেরতেই দেখি ইংলিশ চ্যানেলের চেয়েও চওড়া অভয় হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। ‘উফ শেষ অব্দি এলি তাহলে। একটা কথা বলি, এদেশে একটাই তফাৎ। পিপল বিলিভ ইন কোয়ালিটি টাইম, কোয়ালিটি লাইফ।’ প্রাথমিক ঘোরটা কাটল, গাড়িতে উঠে গান চালিয়ে ড্যাশবোর্ডে মিউজিক প্লেয়ারে একটা টোকা মেরে বলল, ‘বস, এটি কিন্তু বাঙালি।’ দেখি, বোস-এর লোগো। এবারে পুজো দেখব ইংল্যান্ডে। শুনে নিলাম, ফাইবারের তৈরি ঠাকুর রাখাই থাকে একজনের বাড়ির ব্যাক ইয়ার্ডে, যথাসময়ে পৌঁছে যায় যথাস্থানে।
হিথরোর অ্যারাইভাল থেকে বেরিয়ে ঠিক কোথায় দাঁড়াতে হবে, সেটা পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিল সে। আর এক বন্ধু বলেছিল, চিন্তা কোরও না, আসবেই। যদি দেখ আসেনি, তাহলে বুঝবে, লুটনে আর একজনের ফ্লাইট নির্ঘাত দেরি করেছে, তার ব্যবস্থা করে ঠিক চলে আসবে। দেশ থেকে প্রথমবার ভীতু বন্ধুবান্ধবরা এলে ও-ই রক্ষা করে আসছে বহুবছর ধরে।
দুর্গাপুজো বলতে চিরকালই একটা বাঙালি ব্যাপার দেখেছি, এখানে তা নয়। প্যান্ডেল বাঁধার গল্প নেই। পুজো হচ্ছে একটা কমিউনিটি হলে। সপ্তমীর দিন আমার বন্ধু বলল, ‘চল কলাগাছ নিয়ে আসি, এটা আমার রেস্পন্সিবিলিটি।’ কলাগাছ কোথায় পাওয়া যাবে? গার্ডেন সেন্টারে। ফুল,বাগান সংক্রান্ত যাবতীয় জিনিস পাওয়া যায় ওখানে। বাহারি আউটডোরের উপযুক্ত রেট্রো ঘড়ি থেকে শুরু করে গার্ডেন বেঞ্চ। বিশাল জায়গা। স্রেফ নার্সারি বললে ভুল বলা হবে। সারা দুনিয়ার জিনিস আসে এদেশে। সুপারমার্কেটের ফলের সেকশনে দেখতাম, সবকিছুর নাম, দাম ও কান্ট্রি অফ অরিজিন লেখা আছে একটা কাঠি লাগানো কার্ড এর গায়ে। খুঁজলে বাওবাবের বনসাইও পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু কোথাও কলাগাছ পাওয়া গেল না।
বুঝলাম ওর দুশ্চিন্তা হচ্ছে, প্রেস্টিজ ইস্যু হয়ে যাবে না পেলে। এদেশে এটা সবাই খুব সিরিয়াসলি নেয়। সায়েব সেলসম্যান বলল, কলাগাছ নাকি আসে বাহামা থেকে। এবারে কী সব রোগভোগ হওয়ায় ওদেশ থেকে আসা কোনও ফ্লাইট নামতে দিচ্ছে না, তাই নো কলা। একে ওকে ফোন করা চলছিল গাড়ি চালাতে চালাতেই, শেষে উদ্ধার করলেন জ্যাগসদা। জাগুয়ার গাড়ি চালান, তাই ওই নাম। কার কী গাড়ি, কার কোন পাড়াতে বাড়ি, এসব নিয়ে এদেশে অনেকেরই মাথাব্যথা আছে। ওঁর বাড়ির বাগান থেকে পাওয়া গেল ঝকঝকে, তকতকে, অবনতমস্তক রম্ভাসুন্দরীকে। পুজোর পরে রেস্পন্সিবিলিটি নিয়ে ফেরত দেওয়া হবে, জানানো হল।
প্রত্যেকদিন সকালে ভোগের মিষ্টি কিনে আনা আর একটা কাজ। এশিয়ান পাড়ায় ফিট দোকান আছে, মস্ত বাক্স প্যাক করাই আছে, স্রেফ তুলে নিয়ে নামিয়ে দেওয়া। আড় চোখে দেখে নিলাম হলুদের ওপর লালের ছিটে দেওয়া বোমা লাড্ডু। এছাড়া একটা ছোট বাক্সতে আরও কী সব নেওয়া হল। আমার হাতে সেটা ধরিয়ে দিয়ে বলল, এটা আমাদের চাপুর চুপুর। নে, মুখ চালা। পুজোর বাড়ি দামি শাড়ি, ধুতি পাঞ্জাবি, সালোয়ার কামিজ, লেহেঙ্গা চোলি, কুর্তা শেরওয়ানিতে ঝলসে উঠল। আলাপ হল অনেক নতুন লোকের সঙ্গে। খেয়াল করলাম, অবাঙালিরা আমাদের চেয়ে দুর্গা মাহাত্ম্য মোটেই কম বোঝেন না। এক বয়স্ক সর্দারজি আমার কাঁধে হাত রেখে সস্নেহে বললেন, ‘কী, মন কেমন করছে?’ সত্যি বলতে কি বিলেতের বিহ্বলতায় নিশ্চয়ই, কলকাতার কথা একবারও মনে পড়েনি। একটা ব্যাপারই মিসিং, রেকর্ডেড ঢাক বেজে চলেছে, কিন্তু ঢাকি নেই। একজন রোগাসোগা আপাত নিরীহ মানুষের ঢাককে পিটিয়ে হাসিয়ে কাঁদিয়ে ক্লান্ত করে দেওয়ার দৃশ্যটা দেখলেই নেশা লেগে যায়, সেটা হল না।
সায়েব সেলসম্যান বলল, কলাগাছ নাকি আসে বাহামা থেকে। এবারে কী সব রোগভোগ হওয়ায় ওদেশ থেকে আসা কোনও ফ্লাইট নামতে দিচ্ছে না, তাই নো কলা। একে ওকে ফোন করা চলছিল গাড়ি চালাতে চালাতেই, শেষে উদ্ধার করলেন জ্যাগসদা।
কলকাতায় প্রথমবার একই ঘটনা ঘটছে এবারে। বারোয়ারিতে নয়, বহু বাড়ির পুজোয় ঢাকি নেই। সহৃদয়, সিগনেচার বনেদি বাড়ির কর্তা-কর্তৃরা ঢাকিদের পারিশ্রমিক পাঠিয়ে দিয়েছেন, এই খবর শুনেছি। ধারে থাক বাপু, কাছে এস না নিয়েই গড়িয়ে গেল এবারের দুর্গোৎসব। পুরনো অভ্যাসমত কে শারদ সম্মান পেল সেটা টিভিতে বা নেটে দেখে নিলাম আমরা। উত্তেজনা ছড়াল না। কেউ কেউ আন্দাজ করে প্যান্ডেলের ভোল বদলে দিয়েছিলেন আগেই, দূর থেকে হলেও দিব্বি ঠাকুর দেখা গেল। বাইনোকুলারওয়ালারা দু’পয়সা রোজগার করে ফেললেন। অন্যদের দেখে কষ্ট হচ্ছিল, পূর্ণসজ্জায় সজ্জিত ক্ষণিকের দুর্গাগৃহ একেবারে শাট ডাউন। শেষ মুহূর্তে তো তাঁকে ঘুরিয়ে দর্শকমুখী করা যায় না। শান্ত সমুদ্রের ঢেউয়ের মত গুটিকয় দর্শনার্থী তীর অবধি এসে ভেঙে পড়লেন, হয়তো ভেতরের আলোর আভাটুকু দেখে দেবীর অবস্থানকে প্রণাম জানালেন। সতর্ক নিষেধাজ্ঞা খেয়াল রেখে যেটুকু লিমিটেড প্যান্ডেল হপিং করলাম, তাতে নতুন প্রাপ্তিও হল। সারা শহর জুড়ে একটা মিষ্টি নেশা নেশা গন্ধ ভাসছিল। পারফিউম নয়, গন্ধটা স্যানিটাইজারের।
পুজোর বাড়ি দামি শাড়ি, ধুতি পাঞ্জাবি, সালোয়ার কামিজ, লেহেঙ্গা চোলি, কুর্তা শেরওয়ানিতে ঝলসে উঠল। আলাপ হল অনেক নতুন লোকের সঙ্গে। খেয়াল করলাম, অবাঙালিরা আমাদের চেয়ে দুর্গা মাহাত্ম্য মোটেই কম বোঝেন না। এক বয়স্ক সর্দারজি আমার কাঁধে হাত রেখে সস্নেহে বললেন, ‘কী, মন কেমন করছে?’ সত্যি বলতে কি বিলেতের বিহ্বলতায় নিশ্চয়ই, কলকাতার কথা একবারও মনে পড়েনি। একটা ব্যাপারই মিসিং, রেকর্ডেড ঢাক বেজে চলেছে, কিন্তু ঢাকি নেই।
আজ তো বিজয়া। সিঁদুরখেলার কী হল কে জানে। ছোট মিষ্টির দোকানে ঘোলাটে কাঁচের বাক্সের ভেতরটা প্রায় খালি। পাড়ার ক্যাওড়া ছেলে অকারণে আওয়াজ দিয়ে গেছে, সন্দেশে শুভ করোনা ছাপ মেরে দাও। এবাড়ি ওবাড়ি ঘুরে বেল পাতায় ওঁ দুর্গা সহায় লিখে, প্রণাম, কোলাকুলি সেরে, ঘুগনি, মাছের কচুরি, ইয়া চন্দ্রপুলি খেয়ে, বাকিটা প্যাক করে নিয়ে যাওয়াটা এবারে নেই। নেই তো নেই, এখন আমরা মানিয়ে নিয়েছি। মুখ ভার করা আকাশ দিয়ে এবারে শুরু হল, তারপর তো বেশ ঝলমলে।
তবে আমি খুবই মুস্কিলে পড়ে গেছি। এবছর সাতানব্বই হল, প্রত্যেক বছর একবার যাই দেখা করতে। এবারেও মেয়েকে দিয়ে ফোন করিয়ে বলেছেন, আসি যেন। সুস্থই আছেন, আজ অবধি কারুর মুশকিলের কারণ হয়ে দাঁড়াননি। আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, পরীক্ষা করলে আমাদের অনেকেরই পজিটিভ বেরবে। এখনও অসুখ করেনি, সেটা আলাদা ব্যাপার। এই অবস্থায় ওঁর কাছে যাওয়ার প্রশ্নই উঠছে না। আবার না গেলে ভীষণ কষ্ট পাবেন, এটাও জানি। ঠিক জানতাম, ফোনটা এল। ধরলাম। ওঁরই গলা। হাসতে হাসতে বললেন ‘শোনো দাদুভাই, চিন্তা কোরও না। এস একবার। ওপরে উঠতে হবে না। বারান্দা থেকেই আমি স্যানিটির জল ছিটিয়ে দেব, মাথায় পড়লে যমের বাবাও কিছু করতে পারবে না। এস যখন খুশি।
শুভময় মিত্র আদতে ক্যামেরার লোক, কিন্তু ছবিও আঁকেন। লিখতে বললে একটু লেখেন। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে অনেকরকম খামখেয়ালিপনায় সময় নষ্ট করে মূল কাজে গাফিলতির অভিযোগে দুষ্ট হন। বাড়িতে ওয়াইন তৈরি করা, মিনিয়েচার রেলগাড়ি নিয়ে খেলা করা, বিজাতীয় খাদ্য নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করা ওঁর বাতিক। একদা পাহাড়ে, সমুদ্রে, যত্রতত্র ঘুরে বেড়াতেন। এখন দৌড় বোলপুর পর্যন্ত।
যাক ফোন এসেছিল তাহলে!