টেকনোলজির কিং হলেন বিশ্বকর্মা। তাঁর পুজোয় বৃষ্টি না হলে ঘুড়ি উড়িয়ে, কারখানায় বিরিয়ানি খেয়েই কেটে যায়, একবেলার ব্যাপার তো। প্রযুক্তির ব্যবহারে দুর্গা ফ্যামিলি বরাবরই হট ফেভারিট। প্রায় এক সপ্তাহের উৎসব, মানুষের আগ্রহও আকাশছোঁয়া। ঠাকুরের আদল যাই হোক, তা মাটি দিয়েই তৈরি হয়ে আসছে বেশিরভাগ জায়গায়। কেউ কেউ ফাইবার গ্লাস, লোহা দিয়ে করেছেন, বেশ নতুন রকম চেহারা নিয়েছিল। অত্যুৎসাহীরা একবার বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিল। সন্দেশ দিয়ে ঠাকুর গড়ে তাক লাগিয়ে দেবে ভেবেছিল। চতুর্থীতেই পিঁপড়ে ধরে গিয়ে যাচ্ছেতাই অবস্থা। আবার কুমোরটুলিতে দৌড়, সেই মাটির ঠাকুর এনে নমো নমো করে ইনিংস শেষ করেছিল।
ঠাকুরের আর্ট নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা আগেও হয়েছে। পরে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কল্যাণে হাত খুলে সাজাতে পেরেছেন মণ্ডপ নিয়ে ভাবা শিল্পীরা। ইলেকট্রনিক্স এগিয়ে দিয়েছে ইলেকট্রিক্যালকে, আলো অন্য মাত্রা এনেছে পুজোতে। স্রেফ ঠাকুর আর ছুটিছাটা নয়, কলকাতার দুর্গাপুজো বহুদিন হল চলে গেছে আর্ট ইনস্টলেশনের দখলে। ধর্ম, প্রাচীন বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে এত বড় আর্ট ফেয়ার আর কোনও দেশে হয় কিনা জানি না। তবে বাড়ির পুজো, সে বনেদি হোক বা পড়তি, পুজোকে নব্য চেহারা দিতে কেউ রাজি নন। নামী বাড়িতে দর্শনার্থীরা আসেন সকাল থেকে, ভোগ পান, ফোটোগ্রাফাররা হামলে পড়েন লাল পাড় শাড়ি, সোনার গয়না পরা বৌয়ের সঙ্গে ঠাকুরের একজ়টিক ছবি তুলতে। বাড়ির লোকজন অসীম ধৈর্য ধরে তাদের একটু হলেও প্রশ্রয় দেন, এটাই আভিজাত্য। বারোয়ারি পুজোয়, বিশেষ করে যারা বড় প্লেয়ার, বা প্রাইজ পেয়েছেন খবর হয়েছে, সেখানে মুশকিল হয়। মণ্ডপ পর্যন্ত পৌঁছনোই শক্ত হয়ে পড়ে। এবছরও একই রকম, একটি ব্যাপার ছাড়া। মানুষ উধাও।
ভিস্যুয়াল এফেক্টসের যুগ। অ্যানিমেশনের যুগ, চোখ ধাঁধানো শিল্পের ক্রিয়াকলা দেখতেই সবার উৎসাহ। দুর্গার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নয়, অন্য অনেক সংস্কৃতি, ভাবধারা মিশে গেছে পুজোয়। সজ্জায় শুধু বাংলা নয়, সারা দেশের ছায়া, আন্তর্জাতিকতার ফ্লেভার। আগে মণ্ডপে পৌঁছেই ঠাকুর দেখে ফেলা যেত। এখন বদলে গেছে ঘটনাটা। বেশ কিছুটা পথ পেরিয়ে তবেই প্রতিমা দর্শন সম্ভব। যাত্রাপথের পারিপার্শ্বিক চিত্রকল্প, নিমীলিত আলো, মন্দ্রস্বরে স্তোত্রপাঠ, শেষে দুর্গাচরণে অদ্ভুত উত্তরণের অভিজ্ঞতা। চূড়ান্ত শিল্পভাবনা ও প্রযুক্তি ছাড়া এ সম্ভব নয়। দুর্গাভাব অক্ষুণ্ণ রেখেই সবকিছু।
স্রেফ ঠাকুর আর ছুটিছাটা নয়, কলকাতার দুর্গাপুজো বহুদিন হল চলে গেছে আর্ট ইনস্টলেশনের দখলে। ধর্ম, প্রাচীন বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে এত বড় আর্ট ফেয়ার আর কোনও দেশে হয় কিনা জানি না। তবে বাড়ির পুজো, সে বনেদি হোক বা পড়তি, পুজোকে নব্য চেহারা দিতে কেউ রাজি নন।
যে কোনো শিল্পে নকলিকরণ থাকবেই, সেটিও বিনোদনের কারণ হয়ে ওঠে। একবার ভয়ঙ্কর রেল দুর্ঘটনা ঘটেছিল। ভূমিকম্প তো লেগেই থাকে। আলোর মালায়, আলোর খেলায় সেই ভয়াবহতা তুলে ধরেছিলেন শিল্পীরা। জনগণ হাঁ করে রিভাইস করেছিল ভুলতে চাওয়া করুণ উপাখ্যান। কেন, এর উত্তর জানা নেই। স্টাইল কপি করা নিয়ে বোদ্ধারা মাঝে মাঝে খুব শোরগোল তোলেন। এই যে নতুন শরীরের ঠাকুর, প্রথম দু’টি হাতের বিভঙ্গ ঠিক আছে। বাকি চার জোড়া শরীর থেকে উদ্ভূত নয়। যেন তাড়াহুড়ো করে জুড়ে দেওয়া হয়েছে পিঠে। অনেক বছর আগে কুমোরটুলির এক প্রবীণ মৃৎশিল্পী অস্ফুটস্বরে বলেছিলেন, যুদ্ধরত দশহাত রচনা করা কি চাট্টিখানি কথা? দুর্গা কি পুতুল নাকি?
যাই হোক, অষ্টমী এখন ওভার। লিস্টের কিয়দংশ দেখা হয়েছে, একদিন মাত্র বাকি। বাকি ঠাকুর দেখব না আমরা, দেখব না বাকি ঠাকুর? খবরের কাগজের প্রথম পাতার ওপরে ‘চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউতে নামল লক্ষ লক্ষ মানুষের ঢল’ ক্যাপশন দেওয়া ছবিটার আসন বাঁধাই থাকে প্রতিবছর। ওই আকুতিটা এবারে শোনার সম্ভাবনা নেই, ছবিকেও আসন ছেড়ে দিতে হয়েছে অবশ্যম্ভাবী কারণে।
আগে মণ্ডপে পৌঁছেই ঠাকুর দেখে ফেলা যেত। এখন বদলে গেছে ঘটনাটা। বেশ কিছুটা পথ পেরিয়ে তবেই প্রতিমা দর্শন সম্ভব। যাত্রাপথের পারিপার্শ্বিক চিত্রকল্প, নিমীলিত আলো, মন্দ্রস্বরে স্তোত্রপাঠ, শেষে দুর্গাচরণে অদ্ভুত উত্তরণের অভিজ্ঞতা।
বন্যায় ঘর ভাসলে যেমন নৌকোওয়ালার পৌষমাস, এবারের নবমীতেও একটা কানাঘুষো শোনা গেছে। সত্যি মিথ্যে জানি না, আজকাল কোনও খবরেই কেউ বিশ্বাস করে না। ঈশ্বরের প্রতিমূর্তির ত্রিসীমানায় যাওয়া নিষিদ্ধ। তাই ফন্দি এঁটেছে নাকি কিছু বুদ্ধিমান প্রযুক্তিবিদ।একটি অদ্ভুত যন্ত্র বাজারে ভন ভন করছে কয়েক বছর ধরে। বোলতা দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে তার সৃষ্টি। ইলেকট্রনিক চোখ আছে তার, দেখতে দেখতে সে দেখাতেও পারে। বিশেষ সরকারি অনুমতি ছাড়া সেটি ব্যবহারে বিধিনিষেধ আছে। এখন নাকি তার লাইসেন্সহীন ভার্সন এসে গেছে।
আপনাদের নিশ্চই মনে আছে ময়দানে হাতে চালানো সিনেমার মত যন্ত্রটার কথা। মুড়িওয়ালার মত সেট আপ। ওপরে হ্যান্ডেল ঘোরানো চলছে। এতে ঘুরছে চোঙা লাগানো কলের গ্রামোফোন। তলায় ঢাকনা খোলা গোল গবাক্ষ দিয়ে ভেতরে চলনশীল বিশ্বব্রহ্মাণ্ড দর্শন। ঠিক এক মিনিট চলবে, দু’টাকা দিতে হবে। কালচক্র ঘুরে গেছে, হালের দর্শনস্কোপ আলাদা। প্যান্ডেলের কিছু দূরে বসেছে রোল বা কোল্ড ড্রিংকসের মত দেখতে নিরীহ স্টল। সেখানে টিকিট কাটতে হবে। হাতে ধরিয়ে দেবে একটা মোবাইল ফোন। তাতেই দেখা যাবে যা আর কেউ দেখতে পাচ্ছে না। ব্যারিকেডের বাধা, আইনের ঘেরাটোপ, হতাশ মানুষের অল্প জটলার ওপর দিয়ে অদৃশ্য ভাইরাস থৈ থৈ করা শরতের হওয়া কেটে উড়ে যাবে ড্রোন। সোজা প্যান্ডেলে ঢুকে, এদিক ওদিক তাকিয়ে, ঠাকুরের নথের ডিটেল নথিবদ্ধ করে, লাইভ দেখিয়ে, ফিরে আসবে মালিকের কাছে। একশো টাকা।
আপনাদের নিশ্চই মনে আছে ময়দানে হাতে চালানো সিনেমার মত যন্ত্রটার কথা। মুড়িওয়ালার মত সেট আপ। ওপরে হ্যান্ডেল ঘোরানো চলছে। এতে ঘুরছে চোঙা লাগানো কলের গ্রামোফোন। তলায় ঢাকনা খোলা গোল গবাক্ষ দিয়ে ভেতরে চলনশীল বিশ্বব্রহ্মাণ্ড দর্শন। ঠিক এক মিনিট চলবে, দু’টাকা দিতে হবে। কালচক্র ঘুরে গেছে, হালের দর্শনস্কোপ আলাদা।
ঠিক কোথায়, কোন পাড়ায় এসব হয়েছে বলতে পারব না। সারাদিন বাড়িতেই তো বসে আছি, ফেসবুক বুকে নিয়ে। ওখানেই আসছে এসব, ইতিমধ্যে পেহলে আপ হোয়াটস্যাপে আরও খবর ফুটে উঠল। কয়েকটা দুষ্টু ছোকরার বুদ্ধিতে ওই ড্রোন নাকি প্যান্ডেলে না ঢুকে পাশের বাড়ির বারান্দা টপকে বোঁ বোঁ করে ঢুকে গিয়েছিলো অল্পবয়সী এক জ্যান্ত দুর্গার ঘরে। পরমুহূর্তে সে বাইরে বেরিয়ে আসে। তার চিরুনির চপোটাঘাতে ভূমিসাৎ হয় ড্রোন। তার মুখনিঃসৃত শব্দাস্ত্রে ড্রোনাচার্য ও তার সাঙ্গোপাঙ্গরা তল্লাট ছেড়ে চম্পট দেয়। এরপর আরওই চুপচাপ হয়ে গেছে নবমীর সন্ধেটা।
শুভময় মিত্র আদতে ক্যামেরার লোক, কিন্তু ছবিও আঁকেন। লিখতে বললে একটু লেখেন। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে অনেকরকম খামখেয়ালিপনায় সময় নষ্ট করে মূল কাজে গাফিলতির অভিযোগে দুষ্ট হন। বাড়িতে ওয়াইন তৈরি করা, মিনিয়েচার রেলগাড়ি নিয়ে খেলা করা, বিজাতীয় খাদ্য নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করা ওঁর বাতিক। একদা পাহাড়ে, সমুদ্রে, যত্রতত্র ঘুরে বেড়াতেন। এখন দৌড় বোলপুর পর্যন্ত।
চমৎকার !
আজকের লেখাটি ও বেশ ভালো। স্পেশালি ড্রোনের ব্যাপারটা। ড্রোনের হামলা শুধুই ড্রোনাচার্জো পিপিং টমের হাতেই সীমাবদ্ধ নয়। ড্রোন সর্বত্র বিরাজমান। অসভ্য নিওন বাতি, ড্রোন! ড্রোন তথ্যপ্রযুক্তি! ড্রোন ইনফরমেশনের কত্য়ুশা বারাজ! কেন যেন নবারুণ ভট্টাচার্যের কথা মনে পরে গেল! ড্রোন, লোবটোমি, মলোটভ ককটেল এর মালসাট! ফায়ারম্যান, তুমি কোথায়!