গ্রামে আসি যাই। যদিও গ্রাম বলে আর কিছু নেই।
শহরের উপকণ্ঠে একটা গ্রেটার জুড়ে দিলেই গ্রামের ইজ্জত বেড়ে যায়।
মানুষ সত্যি বিশ্বাস করে যে, এবারে দারুণ কিছু হবে। মা-বাবারা কষ্টে কাটিয়েছে, আমরাও তাই। কিন্তু ছেলেমেয়েগুলো ভালো থাকবে।
এই তো পাকা রাস্তা হয়েছে। স্কুলে খেতে দেয়। গুড়গুড় করে টোটো চলছে। কারেন্ট আছে, যদিও হুক করে নিতে হয়, তাই ধরপাকড় চলে, চলারই কথা। দফতরে গিয়ে আবেদন করলে বলে, যে পোলে পাওয়ার আছে সেখান থেকে তার টানতে হবে, অনেক ঝামেলা। চলে আসতে হয়। খরচ রোজ বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। মাঠে কাজ নেই, বিশাল যন্ত্র এনে চাষ করে ধান মুড়িয়ে তুলে নিচ্ছে। লেবার দিয়ে করালে খরচ বেশি পড়ত, সময় বেশি লাগত। কলকারখানা হয়েছে কিছু। বলেছিল গ্রামের লোক কাজ পাবে। কই ? দূরে, অন্য শহরে কাজ নিয়ে চলে গেছে অনেকে, তারা টাকা করেছে কিছু। যাদের কিছু ছিল, তা দিয়ে দোকান দিয়েছে অনেকে। মুদির দোকান ভালো চলে, এখন জিঞ্জার গার্লিক পেস্টও পাওয়া যায়। এইসব কথা শুনতে পাই এদিক ওদিক।
লকডাউনের পুরো সময়টাই গ্রামে ছিলাম। কী ঘটেছে, কী হবে, কেউ ঠিকমত বুঝতে পারছিল না। পুলিশ পাড়ায় পাড়ায় বলে গেল, কেউ বেরবে না। মুখে মাস্ক পরতেই হবে। না মানলে সিভিকরা অত্যাচার করছিল। ক্ষেতের কাজ, দোকানের কাজ, রাজমিস্তিরির কাজ, বাস, লরি সব বন্ধ। একটা ভয় ছিল, গুদাম লুঠ হবে। কিন্তু হয়নি। চাল ডাল এসেছিল সময়মত। লোকজন ভরসা পেয়েছিল, বুঝেছিল কিছুদিন কষ্ট করতে হবে। হাওয়া থেকে বিষ নেমে যাবেই, রোগ ভোগ ঠিক কমে যাবে।
অনেক কাণ্ড হল ওই সময়ে। গরমকালটা চুরি হয়ে গেল।
এই বৃষ্টি, এই মেঘ, সে কী নীল আকাশ!
কলকাতা থেকে খবর এল, ধোঁয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পাখিরা সবাই ফিরে এসেছে।
ঠিকই, খুব পাখি ডেকেছে তখন। বটতলার বুড়ো বলল, আমি আগেই বলেছিলাম, সব হিসেব গুলিয়ে গেছে, পাঁজিটা দেখ। মহালয়ার অনেক পরে পুজো, এমন দেখেছ কখনও?
মহামারী হবে, এটা তো পাঁজিতে লেখা ছিল না দাদু।
কী করে থাকবে? চায়নায় কি পাঁজি চলে নাকি? সারাক্ষন তোমাদের চায়নামাল চায়নামাল।
এরপরেই খবর হল, ঝড় আসবে। ঠিক এল। শেষ করে দিল সব।
তবে আমাদের গ্রামে তার প্রকোপ পড়েনি তেমন, অনেকটা উত্তরে তো। ঝড়ের পর একটা হাওয়া উঠেছিল, চালসুদ্ধু একটা বাড়ি পুকুর পেরিয়ে ওপারে পড়েছিল। বৃষ্টি থামছিলই না, চাষবাসের দফারফা।
লকডাউন একটু শিথিল হতে মাঠে ঘুরছিলাম, দেখি লাল হয়ে আছে অনেকখানি জায়গা। শুনলাম, দারুন টোম্যাটো হয়েছিল, কেউ তোলেনি, নেবার নেই, ওখানেই নষ্ট হচ্ছে।
এটা ঠিক যে, একটু অভাব থাকলেও কালোবাজারি হয়নি আমাদের গ্রামে। চোরাগোপ্তা অন্য কারবার চলছিল যদিও। মদের দোকান বন্ধ থাকায় অনেকেই নাজেহাল হয়ে যাচ্ছিল। মদ খেলে তো করোনা হয় না, করুণ ভাবে একথাও বলছিল। একজন নাকি জানত কী করে বানাতে হয়। অর্ডার দিলে এক ঘণ্টায় এক বোতল ‘বের করে দিচ্ছিল’, একশো টাকা। কী ভাবে, আমি জানি না।
পুজোর আগেই সব কমে যাবে, এটাও কানে আসছিল। এখানে খবরের কাগজ আসে না, কিন্তু সবার ফোনেই খবর হয়ে যায়। রোগ বাড়ছে, থাকতে দেবে না, কাজ নেই, রোজগার নেই, শহরের ভিড়ে মরেই যাবে হয়তো। দিল্লি ছেড়ে হাজারে হাজারে শ্রমিক হাঁটা লাগিয়েছে শত শত কিলোমিটার দূরে নিজের বাড়ির দিকে। যে পৌঁছল সে নিজের গ্রামে ঢুকতে পারছে না। ঢুকতে দিচ্ছে না। আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ল এই খবরও। আমাদের গ্রামের রাস্তায় রাস্তায় বাঁশ পড়ল। ঘরের লোক এখন বহিরাগত। অনেকেই দূরের শহরে কাজ করে, তারা এখন কোথায়, কবে আসবে, কী ভাবে আসবে, আদৌ আসতে পারবে কিনা, ঘোর বর্ষায় আসন্ন শরতের ইন্ডিগো আকাশে অদ্ভুত দুশ্চিন্তার মেঘ ভাসতে দেখলাম। এই প্রথম দেখলাম অনেক সহৃদয় মানুষ পরের কথা ভাবছেন, খুলে দিয়েছেন নিজের সঞ্চিত ভাণ্ডারের অনেক কিছুই।
বাস চালু হতে কলকাতায় ফিরলাম। দেখি অদ্ভুত এক শহর। খাঁ খাঁ করছে পথঘাট। ছড়িয়ে পড়া রোগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে, পরিস্থিতিতে নিজেকে সইয়ে নিয়ে গমগম করে উঠল জনজীবন। বাজার খুলে গেল ঠিকই, তবে বিক্রিবাটা নেই একেবারে। মানুষ বুঝে গেছে, এর শেষ জানা নেই। সঞ্চিত টাকাটুকু বাঁচানোর চেষ্টা করতেই হবে। চাকরি গেছে অনেকের। মাইনে বন্ধ, বা কাটা যাচ্ছে। ভাইরাসে টাকা খেয়ে ফেলেছে, তাই। আমার কাজকম্মও খতম। ফিরে গেলাম, বলা উচিত পালিয়ে গেলাম গ্রামে। নাগরিক ভয়াবহতা থেকে নিজেকে লুকোতে। শুনলাম, পুজো হবে, তবে ছোট করে। এবছর কলকাতার ফেমাস দুর্গোৎসবের দফারফা হয়ে গেছে সেটা মশা মাছিও জানে। শুধু তাই নয়, ভিড় উপচোবেই, ঝামেলা বাড়বেই। অনেক ছোট প্যান্ডেল পঞ্চমী পর্যন্ত খাঁ খাঁ করছিলো, এখন তা নয়।
ব্যাপারটা সয়ে গেছে সবার। এতদিনে সবাই বুঝেছে সুখের অভাবই অসুখ নয়। এই অবস্থায় হাইকোর্টের রায় শুনে এদিকের লোক, মুখে বলছে না, আল্হাদিত। শহর ও বে-শহরের আনব্যালান্সড প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিলই। দুর্গাপুজো সবার, টাকার জোরে কলকাতা চিরকাল বেশি প্রাধান্য পেয়ে থাকে। এবারে শহর জব্দ। যারা বাড়ি ফেরার ফিরে এসেছে, কাজকর্ম একটু একটু করে শুরু হয়েছে। হাঁস ছাগলরা আগের মতোই নির্বিকার, ছোকরা ছুকরিরাও। আসলে, এই সময়টাই অদ্ভুত, অক্টোবরের শেষে রোদে গা পুড়লেও সুন্দর। এবছরের কাশেরা ডিটারজেন্টের মত সফেদ নয়। না হোক, পাঁজি ভুল ছাপলেও, এখন শারদীয় বসন্ত।
একটাই চিন্তা এই সপ্তমীর সকালে, কে একটা বলল, তার বাবা বাড়িতেই থাকে। মা এখনও ফেরেনি।
শুভময় মিত্র আদতে ক্যামেরার লোক, কিন্তু ছবিও আঁকেন। লিখতে বললে একটু লেখেন। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে অনেকরকম খামখেয়ালিপনায় সময় নষ্ট করে মূল কাজে গাফিলতির অভিযোগে দুষ্ট হন। বাড়িতে ওয়াইন তৈরি করা, মিনিয়েচার রেলগাড়ি নিয়ে খেলা করা, বিজাতীয় খাদ্য নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করা ওঁর বাতিক। একদা পাহাড়ে, সমুদ্রে, যত্রতত্র ঘুরে বেড়াতেন। এখন দৌড় বোলপুর পর্যন্ত।
আহা…
ভীষণ ভালো লাগল লেখাটি। আমার সল্টলেকের বড়ির ঠিক গায়ে একজন তেলেভজর দোকান দিতেন। লকডাউন এর দুএক মাস আগে থেকে। যখন লকডাউন হল অনেকেক দিন ছেলে বাবাকে দেখি নি। ভেবেছিলাম, ওঁরা কোথায় গেলেন। লক ডাউন শিথিল হলো। কিছু কিছু দোকান খোলা শুরু হলো। তারপর একদিন বিকেলে দেখি – তেলেভাজার দোকান আবার খুলেছে।
দারুণ
অদ্ভুত বাস্তবতার ছবি…দারুণ।