পুজোয় কেনা নতুন জুতো মাথার বালিশের পাশে  নিয়ে শোওয়ার বয়সটা আমাদের ইহজীবনের মতো চলে গেছে সত্যি! কিন্তু পুজো এলেই নতুন শাড়ি বা কেনাকাটার আনন্দে ভাঁটা পড়া? উঁহু! তার কোনও লক্ষন নেই! সে যতই বিদেশে বা আমেরিকায় থাকি না কেন! কয়েক বছর আগে পর্যন্তও আমেরিকার বিভিন্ন শহরের পুজো গুলোতে, কে কাকে শাড়ি, পাঞ্জাবিতে কতটা টেক্কা দেবে, তা নির্ভর করত কে পুজোর খানিক আগেই গরমের ছুটি কাটিয়ে দেশ থেকে ফিরেছে তার ওপর। তিন চারজনের সদস্য সহ দেশ থেকে ফেরা মানে টোটাল ছটা আটটা সুটকেসও সঙ্গে এসেছে। আর তার পেট ফুঁড়লেই বেরিয়ে পড়েছে আদি ঢাকেশ্বরী বস্ত্রালয়, কনিষ্ক, দক্ষিণাপন, সাউথ সিটি মল, দিল্লি হাটের জমজমাট সম্ভার! কেউ কেউ বন্ধুদের ফোন করে ডেকে আনন্দ সহকারে পুজোর আগেই দেশ থেকে আনা সেসব বাজার দেখিয়ে ফেলতেন। কেউ কেউ আবার গোপনীয়তা বজায় রেখে একেবারে চমক দিতেন পুজোর দিনগুলোতেই!

নতুন শাড়ি ছাড়া পুজো মানায় না

এবাদেও টাটকা পুজোর বাজার আমদানির জন্য সবসময়ই  ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ছিলেন,আছেন দেশ থেকে ছেলেমেয়ের কাছে বেড়াতে আসা বাবা,মা,শ্বশুর, শাশুড়ি! পই পই করে ঠিক কীরকম ব্লাউজ শাড়ি লাগবে, কেমন পাঞ্জাবি লাগবে তার বর্ণনা দিয়ে, তাঁদের হাত দিয়ে আনিয়ে নেওয়া যায় সহজেই। তবে এখন অনলাইন শপিং এর রমরমা! বিদেশে বসে দেশীয় কেনাকাটার এখন জোয়ার। তা শুধু আমাজনের জঙ্গলেই আটকে নেই! ফেসবুক খুললেই আপনি যদি দেখেন আপনার কাছে, কয়েকজন অচেনা মহিলার থেকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এসে জমা হয়ে আছে, তাহলে তাদের প্রোফাইল খুলে দেখুন, তাদের মধ্যে অন্তত দুজনার শাড়ির ব্যবসা আছে। তাদের ফেসবুক টাইমলাইনের লোভনীয় সব শাড়ি চেয়ার, টেবিল, মেঝে, বাগানে আঁচল বিছিয়ে নিউজফিডে আপনার চোখের সামনে ওঠানামা করে আপনাকে দুর্বল করবে। এর পরেই আপনার প্রশ্ন “পি পি!” প্রাইস প্লিজ! এবার মাত্রই কয়েকটা ক্লিকের অপেক্ষা! আপনি বিগত এবং আগামী পাঁচ বছরে দেশে না গেলেও আপনার ভাঁড়ারে কম পড়বে না!  ব্লাউজ, ফলস, পিকো সহ সব এসে যাবে!

তিন চারজনের সদস্য সহ দেশ থেকে ফেরা মানে টোটাল ছটা আটটা সুটকেসও সঙ্গে এসেছে। আর তার পেট ফুঁড়লেই বেরিয়ে পড়েছে আদি ঢাকেশ্বরী বস্ত্রালয়, কনিষ্ক, দক্ষিণাপন, সাউথ সিটি মল, দিল্লি হাটের জমজমাট সম্ভার!

প্রথম দিকে এই অনলাইন শপিং করতে গিয়ে অনেক সময় বেকুব হতে হয়েছে। মিষ্টি গোলাপি  রঙ ছবিতে দেখে অর্ডার করায় কটকটে গোলাপি শাড়ি এসে হাজির হয়েছে। একগাদা টাকা দিয়েবাইলুম ভেবে অর্ডার করে,হাতে গামছা জাতীয় যা এসেছে,তা দেখে কপাল চাপড়াতে হয়েছে “এ কী ঠকলুম ” বলে! এখন কিন্তু সত্যি করেই যে কোনও ওয়েবসাইট, সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি দেখে কিনলে প্রায় হুবহু এক প্রতিশ্রুত জিনিস আসে। এসব বাদেও আমেরিকায় প্রায় সব শহরেই ছোট বড় প্রচুর ইন্ডিয়ান দোকান,বড় শোরুম। সেখানেও দশেরা নবরাত্রি উপলক্ষ্যে প্রচুর শাড়ি,জামাকাপড়ের স্টক আসে। মন্দির গুলোতে যেকোনও উৎসবে পুজোর দিন গুলোতে প্রচুর স্টল বসে শাড়ি, কুর্তি, শেরওয়ানি, কস্টিউম জুয়েলারির। পাড়ায় পাড়ায় বন্ধুদের মধ্যে অনেক মহিলাই এসবের ব্যবসা করেন। তারা যে শুধু অনলাইন বিক্রি করেন তা নয়, সটান তাদের বাড়ি গিয়েও কিনে আনা যায় !সঙ্গে চা এবং বান্ধবীর বানানো মুখরোচক স্ন্যাক ফ্রি।ভারী ট্রাডিশনাল গাদোয়াল ,কাঞ্জিভরম অর্ডার করতে হলে আছে নাল্লি শাড়িস এর ইউ এস শাখা!

অনেকে জুলাইতে হওয়া উত্তর আমেরিকা বঙ্গ সংস্কৃতির সম্মেলন চত্বর থেকেও বিপুল কেনাকাটা করেন। কাঁথা স্টিচ,বালুচরী এসব কোনওদিন জনপ্রিয়তা হারায়নি! তবে মাঝের কিছু বছরের জরি,চুমকি, ডিজাইনার পার্টিওয়্যারের অত্যধিক প্রকোপ কাটিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মহিলা আবার ফিরে এসেছেন  সিল্ক, তসর,জুট ও তাঁতের চিরাচরিত ফেব্রিকে। তবে এবছর পুজোতে পুজোর মেজাজই নেই যেন! পুজোর রোদ আছে বাইরের আকাশে কিন্তু সে রোদ মন ছুঁতে পারলো কোথায়? দেশে যেতে পারিনি প্রায় কেউ-ই! সেখানে পাড়ার দর্জিকে তাড়া দিইনি ফেরার প্লেন ধরার আগে সব ব্লাউজ বানানো শেষ করার জন্য! সুটকেসভর্তি শুধু শাড়ি কেন! আসেনি সুটকেসে শাড়ির ভাঁজের ফাঁক ফোঁকরে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বাবা মায়ের গুঁজে দেওয়া আচার, বড়ি, নাড়ু, নিমকি, সদ্য প্রকাশিত পূজা বার্ষিকী আরও কত কী!

প্রবাসে পুজোর সাজে

এবছর নিয়মরক্ষার দুর্গাপুজো হবে আমেরিকার প্রায় সব ছোট বড় শহরেই  নমঃ নমঃ করে। সামাজিক দূরত্ববিধি মেনে চলতে পুজোপ্রাঙ্গনে যাওয়ারও বিশেষ সুযোগ থাকবে না! পুজোর আচার অনুষ্ঠান,সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সবই দেখানো হবে লাইভ স্ট্রিমের মাধ্যমে। যদিও পুজোর কেনাকাটা পুরোপুরি বন্ধ নেই। যাঁরা বাড়ি থেকে বিজনেস করেন,তাঁরা তাদের সম্ভার নিয়ে ফেসবুক লাইভে আসছেন। মুহূর্তে বিক্রিও হচ্ছে। আবার অনেকে এবছর নতুন করে কিছু কেনাকাটায় উৎসাহ না পেয়ে, ক্লসেট ঘেঁটে খুঁজে বার করছেন না ভাঙা কোনও গিফট পাওয়া বা আগে কিনে রাখা শাড়িই। পরবেন ওই শুধু পুজোয় নতুন কিছু পড়ার নিয়মরক্ষার খাতিরেই। এই দুর্যোগের সময়ে এমনিতেও সাধারণ মানুষের মধ্যে ভোগের থেকে ভাগ করে নেওয়ার ইচ্ছাটাই বেশি চোখে পড়ছে। আমেরিকাবাসী বাঙালিরাও তাই নানা প্রকল্পের মাধ্যমে এদেশ এবং ভারতে, পশ্চিমবঙ্গে আর্থিকভাবে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কথাই ভাবছেন বেশি। নতুন ডিজাইনের শাড়ি, দোপাট্টা, ব্লাউজের বদলে এমনিতেও এবছর শুধু নানান ডিজাইনের মাস্কের রমরমা! মা দুর্গা আমাদের নাকমুখ থেকে এই মাস্ক সরিয়ে সুস্থ সময় উপহার দিয়ে আগামী বছর পুজোর কেনাকাটার স্বাভাবিক ছন্দ উত্তেজনা আমাদের ফিরিয়ে দিন, আপাতত দেশে বিদেশে এই প্রার্থনা!

টেক্সাসের হিউস্টনের বাসিন্দা! লেখালেখি ছোটবেলা থেকেই। গত দশ বছরে প্রবন্ধ , ছোট গল্প, কবিতা, রম্যরচনা প্রকাশিত হয়েছে দেশে বিদেশের বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকায়। এছাড়াও লিখেছেন নানান দৈনিক সংবাদপত্রে। লেখালিখির পাশাপাশি পড়তে, শুনতে, ভাবতে, জানতে, বেড়াতে ভালোবাসেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *