ইন্ডিয়ান কালচারাল সোসাইটি, সংক্ষেপে আই সি এস – কেম্ব্রিজে প্রথম দুর্গা পুজোর উদ্যোক্তা। \পুজো করতে হবে বলেই কয়েকজন স্থানীয় বাঙ্গালী বাসিন্দার চেষ্টায় এর শুরু ২০০৩ সালে। প্রথম দিকে আয়োজন ছিল সামান্য, হাতে হাতে সবাই সব কিছু করে নিতেন।

তখনকার দিনে কেম্ব্রিজে ছাত্রছাত্রীরাই বেশী আসতেন। তাঁরা ছিলেন স্রোতের মত। বেশীদিন থাকতেন না কেউ। স্থায়ী বাসিন্দা ছিলেন হাতে গোনা। আস্তে আস্তে আর পাঁচটা জায়গার মত কেম্ব্রিজেও বাড়তে লাগল স্থায়ী চাকুরীজীবী বাসিন্দার সংখ্যা, বিশ্বায়নের ফল আর কি। অতএব পুজোর আয়তনও বাড়তে লাগল ধীরে ধীরে। ২০০৭ /২০০৮ নাগাদ প্রায় তিন -চারশ লোকের উপস্থিতিতে গমগমে পুজোর আবহাওয়া জমে উঠল। বড় জায়গায় আরও ধুমধাম করে পূজো শুরু হল। তার স্বীকৃতি মিলল হাতে হাতে। বাংলা-লাইভের শ্রেষ্ঠ শারদ সম্মান কপালে জুটল কেম্ব্রিজের পূজোর। এখন এই পুজোতে আশেপাশের নানা জায়গা থেকে বাঙালিরা এসে ভিড় জমান। নতুনদের সঙ্গে আলাপ, পুরনোদের সঙ্গে দেখা হওয়া, সাউন্ড-বক্সে ঢাকের আওয়াজ, অঞ্জলি আর ঘণ্টাধ্বনিতে জমে ওঠে পূজো।

পুজো হয় এখানে সপ্তাহান্তে। পাঁচদিনের পুজো দু-দিনে সারতে হবে। তার জন্য পাঁজির হিসেব টিসেব সেরে নেন পুরোহিত মশায়। চাট্টিখানি কথা নয়। তবে কলেজ জীবন থেকে সব বাঙালির অভ্যেস আছে দুটো কে পাঁচটা করার। উল্টোটাও দিব্যি সুষ্ঠুভাবে হয়ে যায়। প্রবাসে পুজোর কিছু বিশেষ ব্যাপার আছে, যেগুলো মাথায় রাখতে হয়। তার মধ্যে প্রথম এবং সর্বপ্রধান হোল প্রদীপ জ্বালা। এখানে কোন না কোন হল বুক করে পুজো করতে হয়। আর সে সব জায়গায় আগুন জ্বালানোর কড়াকড়ি একেবারে ভয়ঙ্কর রকম। কাজেই কর্মকর্তাদের মধ্যে যারা একটু পাবলিক রিলেশনে পাকা (অর্থাৎ মিষ্টি করে লোকজনকে ভজাতে পারেন ) তাঁদের ওপর ভার পড়ে হলের সাহেব বা মেমসাহেব ম্যানেজারকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিশ্চিন্ত করা এবং প্রদীপ জ্বালানোর অনুমতি আদায় করার। এর জন্য এমনও হয়েছে যে প্রদীপ নিয়ে গিয়ে জ্বালিয়ে দেখাতে হয়েছে।

এর পর আসা যাক খাবার কথায়। দেশে পুজোতে বিশাল বিশাল ডেকচিতে পাড়ার বড়রা রান্না-বান্না করে পূজোর ক’দিন সবাইকে দিব্যি খাইয়ে দিতেন। এখানেো সেরকম ক্যালিবারের লোকের অভাব নেই কিন্তু ওরকম ইচ্ছেমত রান্না করার বিপদ আছে এখানে। হঠাত হয়ত হল-ম্যানেজার এসে পাবলিক হেলথ সার্টিফিকেট দেখতে চাইল। কাজেই সেটাও সামলাতে হয়।

এর পর প্রতিমা আনা-নেওয়া আর এক পর্ব। প্রতিমা এখানে বিভিন্ন বাড়িতে ভাগ ভাগ করে রাখা থাকে। দুর্গা সিংহ এবং অসুর সহ যদি কমল বাবুর বাড়িতে জায়গা নিলেন তো গণেশ ইঁদুর নিয়ে চলে গেলেন রতন বাবুর বাড়ি। পুজোর আগে এনাদের সবাইকে একজায়গায় করার জন্য ভ্যান ভাড়া করা, চালানো , বিভিন্ন জায়গা থেকে মা দুর্গা আর তাঁর সন্তানদের তুলে পূজোর জায়গায় আনা আর পূজোর পরে ফেরত নিয়ে যাওয়া ঠিক সময়ের মধ্যে ( ভুললে চলবে না ভ্যানের ভাড়া সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়বে) – এও এক জটিল অপারেশন অঙ্ক। পূজোর সময় একটি ছোট্ট কিন্তু পরিপাটি সাহিত্য সঙ্কলন প্রকাশিত হয়। নাম তার কথন। তার ডিজাইন থেকে আরম্ভ করে ছাপার জন্য তৈরি করা সবটাই করেন আই সি এস -এর স্বেচ্ছাসেবক কয়েকজন।

পুজোর দু’দিন অবশ্যই প্রবল আড্ডা আর নানা জমকালো সাজপোশাকে চোখ ধাঁধায়। তার মধ্যে বাচ্চাদের দৌড়োদৌড়ি, অল্প-বয়সীদের হাহা-হিহি। অবশ্যম্ভাবী ঘটনার মধ্যে বাচ্চাদের দু’একটা ঝগড়া, মারামারি, রাগারাগি , তারপর আবার গলাগলি। পূজো চলতে থাকে সকাল থেকে। মন্ত্রোচ্চারণ, অঞ্জলি আর তারপর প্রসাদ। প্রদীপের শিখা থেকে তাপ নেওয়া , মা-কাকিমারা বাচ্চাদের বুকে মাথায় ছুঁইয়ে দেন তপ্ত হাত চিরাচরিত মঙ্গল-কামনায়। দুপুরের খাবার হতে হতে দেরী একটু হবেই অবধারিত ভাবে। খাবার রেডি খবর পেতেই জনতার ঢল নামে সেদিকে। হাতে হাতে ভলান্টিয়াররা ধরিয়ে দেয় থালা। দেরীটা পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয় আন্তরিকতা দিয়ে।

খাবার শেষ হতে না হতেই সন্ধ্যের সাজপোশাকের প্রস্তুতি। এখানে আবার ব্যাপারটা দু’রকম। কেউ কেউ এমনি সেজেগুজে পরিপাটি হবেন আবার কারুর কারুর বিশেষ সাজ সন্ধ্যেবেলার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য। এই কুশীলবদের নানা পোশাক – কারুর গোঁফ,কারুর পাগড়ি, কারুর বা ঝোলা দুল, তার একটা হয়ত খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছেনা। এর মধ্যে কোন শিশু-নৃত্য শিল্পী ওড়নায় পা বেধে ধড়াম করে হয়ত আছাড় খেল আর ঠিক সেই সময়ই কিনা তার তরুণী মা বাচ্চার দিকে মন না দিয়ে সেলফি তুলছিল। সবাই যে যার কাজ ফেলে ছোটে মা’টিকে একটু বকে আসতে। এরকম নির্ভেজাল আমোদ বিনা খরচায় আর কোথায় পাওয়া যাবে। এদিকে মাইক হাতে কেউ হয়ত বলতে শুরু করেছে… এখুনি অনুষ্ঠান শুরু হবে…।” সব মিলিয়ে দেশ-কাল সব কিছু ছাপিয়ে সবাই যেন পৌঁছে যায় চেনা ছবিগুলোর মধ্যে – যার যার নিজের নিজের স্মৃতির কুঠরিতে।

এভাবেই চলে আসছে আমাদের কেম্ব্রিজের পুজো। এবারের পুজো অক্টোবরের ৫ এবং ৬ তারিখে। কেম্ব্রিজের চেস্টারটন স্কুলের হলে। সবাইকে জানাই সাদর আমন্ত্রণ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *