সূর্য ওঠার আগেই আকাশে সঞ্চারিত হয় এক অলৌকিক সুরধ্বনি, অমৃতের কন্যা ও পুত্রদের, অর্থাৎ এই আমাদের সে জানায় তার সঞ্জীবনী বার্তা: আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জীর। আমাদের ঘুমভাঙা চেতনায় সেই সুসংবাদের অমোঘ প্রতিধ্বনি: আজ মহালয়া।

আজ মহালয়া। শাস্ত্রমতে আজ পিতৃপক্ষের অবসান। পূর্ব প্রজন্মের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য নির্দিষ্ট এই পক্ষকাল। তর্পণ তার প্রক্রিয়া, যে প্রক্রিয়ায় পূর্বসূরিদের পরিতৃপ্ত করার জন্য অর্ঘ্য দেওয়া হয়। কেবল নিজের প্রত্যক্ষ পূর্বপুরুষ নয়, বান্ধব, অবান্ধব, অন্য জন্মের বান্ধব, এমনকি যাঁদের অর্ঘ্য দেওয়ার জন্য কোনও উত্তরপ্রজন্মের কেউ নেই, তর্পণের মন্ত্রে তাঁদের জন্যও সম্মানিত পরিসর আছে।

কিন্তু তর্পণ কি কেবল পূর্বপ্রজন্মের স্মারক? কেবল অতীতের সঙ্গে বর্তমানের সম্পর্কের স্বীকৃতি? না, তর্পণের মধ্যে লুকিয়ে আছে আরও বড়, মহত্তর এক ধারণা। সময়ের সীমারেখা অতিক্রম করে মহাজাগতিক ঐক্যের স্বীকৃতি দেয় এই পিতৃপক্ষ। আমরা অনুভব করি, অতীত বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ এক সূত্রে গাঁথা। কাল নিরবধি, এই আপ্তবাক্য যে কেবল একটি কথা নয়, খুব বড় সত্য, সে কথা আমরা এই সময়টিতে বিশেষ ভাবে উপলব্ধি করি।

আর সেই বৃহতের অনুভবের মধ্যেই আসে আমাদের বৃহত্তম উৎসব। এটা আকস্মিক ব্যাপার নয় যে পিতৃপক্ষের তর্পণের পরে আসে শারদোৎসবের আনন্দ। আমাদের দর্শনে মৃত্যু বা অতীত নয় দুঃখময় অন্ধকারের বিষয়, বস্তুত আমরা কখনও দুঃখকে জীবনের একটা ভয়ঙ্কর দিক বলে মেনে নিইনি, বরং দুঃখ ও আনন্দকে পরস্পরের অবিচ্ছেদ্য পরিপূরক বলেই জেনেছি। এবং সেটা তখনই সম্ভব হতে পারে, যখন উৎসব সত্যিকারের সর্বজনীন হয়ে ওঠে।

সর্বজনীন কথাটা আজকাল আমাদের কাছে বারোয়ারির প্রতিশব্দে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এ কথার বড় অর্থটা অনেক বড়। সমস্ত মানুষের জীবনের সমস্ত দিকগুলিকে নিয়ে, দুঃখ ও আনন্দ, ঘর ও বাহির, ঐহিক ও পারত্রিক, সব অভিজ্ঞতাগুলি ধারণ করে তবেই একটা অনুষ্ঠান সত্য অর্থে সর্বজনীন হয়ে উঠতে পারে। এই সর্বজনীনতার পরিসরে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়। সমাজ অর্থে কেবল একটা এলাকার বা অঞ্চলের বা এমনকি দেশের জনসাধারণই নয়, আজকের পৃথিবীতে যে যেখানেই থাকুক না কেন, তারা সেই সমাজের অঙ্গ হয়ে উঠতে পারে।

শারদোৎসবের সর্বজনীনতার মধ্যেও এই আদিগন্ত প্রসারের সম্ভাবনা সর্বদা বিদ্যমান। বাস্তবে সেই সম্ভাবনার কতটুকু চরিতার্থ হয়, সেটা অন্য প্রশ্ন। কিন্তু দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে যে বিপুল আয়োজন, তার ধারণা সমস্ত সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে বৃহৎ অর্থে সর্বজনীন হয়ে উঠতে চায়। তার নানা প্রকাশ নানা ভাবে দেখা যায়। দুনিয়া জুড়ে বছরের এই সময়টিতে বাঙালি মানুষ যে যার জায়গায় নিজের মতো করে শারদোৎসব পালন করেন, এমনকি পৃথিবীর অন্য গোলার্ধে, যেখানে এই সময় শরৎকাল নয়, সেখানেও তাঁরা উৎসবে মাতেন। এবং আজকের প্রযুক্তির সুযোগ নিয়ে তাঁদের সেই উদযাপনের খবর ও ছবি মুহূর্তের মধ্যে গোটা পৃথিবীতে পরিচিত জনের কাছে, তার সঙ্গে সঙ্গে বহু অপরিচিত জনের কাছেও, ছড়িয়ে পড়ে। আমরা এই বিস্তারে এতটাই অভ্যস্ত হয়েছি যে, এর সর্বজনীন হয়ে ওঠার আশ্চর্য ক্ষমতাটা সচরাচর খেয়ালও করি না। শারদীয় উৎসবের প্রকৃত মাহাত্ম্য হয়তো এখানেই। না জেনেই আমরা এই উৎসবের মাধ্যমে একই ভুবনগ্রামের বাসিন্দা হয়ে গিয়েছি। শারদীয় ভুবনগ্রাম।

সঞ্চারী মুখোপাধ্যায় হাসিখুশি, এমনকী যখন সেই মোড-এ থাকেন না, নিজেকে ঠেলে হিঁচড়ে হিহিহোহো’তেই ল্যান্ড করানোর চেষ্টা করেন। জাপটে ভালবাসেন আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, সিরিয়াল, গান, রাস্তায় নেড়িবাচ্চার লটরপটর কান। পড়াশোনার সময় ফিল্ড করেছেন, হাতুড়ি দিয়ে পাথর ভেঙেছেন, গ্রামবাসীদের তাড়া খেয়েছেন, এক বার পাহাড় থেকে অনেকটা হড়কে পড়ে মুচ্ছো গেছিলেন, উঠে দেখেন, কবর! এক বার ম্যানেজমেন্ট কোর্সের অঙ্গ হিসেবে চিন গেছিলেন, রাত্তির দুটোয় সাংহাইয়ের রাস্তায় হারিয়ে গিয়েও কাঁদেননি। ফিউজ সারাতে পারেন, পাখার কার্বন বদলাতে পারেন, কাগজের চোঙ পাকিয়ে গাড়িতে পেট্রল ঢালতে পারেন, চিনেবাদাম ছুড়ে দিয়ে মুখে নিপুণ লুফতে পারেন। ব্যাডমিন্টন খেলার ইচ্ছে খুব, কিন্তু জায়গা ও র‌্যাকেট নেই। অরোরা বোরিয়ালিস যারা দেখেছে, তাদের একাগ্র ভাবে হিংসে করেন। দেশের বাড়িটা উনি বড় হওয়ার পর ছোট হয়ে গেছে বলে, আর আমির খান এক বার কার্টুন এঁকে দিয়েছিলেন— সে কাগজ হারিয়ে গেছে বলে, জেনুইন কষ্ট পান। এক বার ঈগলের রাজকীয় উড়ান আগাগোড়া খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *