১৯৮৩, আমি বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। পৌষমেলা শুরুর আগের দিন রাত্রি। অর্থা‍ৎ পৌষের ছয় তারিখ রাত্রি এগারোটা। প্রবল শীত। আমি আর বন্ধু শুভ বসু সোয়েটার আর মাঙ্কি টুপি পরেও একটা চাদর দুজনে টানাটানি করে একটা বেঞ্চে জড়সড় হয়ে বসে আছি। না, আমরা মেলা ছেড়ে দার্জিলিং যাওয়ার জন‍্য বোলপুর স্টেশনে বসে নেই। বসে আছি একটা প্রেসে। একমাত্র ভেল্টিলেশন সামনের সাটার। তাই সেটা সাফোগেশনের ভয়ে বন্ধ করা যাচ্ছে না। হু হু করে হাওয়া ঢুকছে। কম্পোজার কাম ম‍্যানেজার গ্লাসের জলে (?) এক চুমুক মারছেন আর দ্রুত চৌকো খোপওয়ালা টেবিল থেকে বিদ‍্যাসাগরের বর্ণমালার সিসের নাড়িভুঁড়ি বার করে পেজ তৈরি করছেন। ওদিকে মেশিনম‍্যান আগের পেজগুলো ছাপছেন। প্রেসের জায়গা বলতে আড়ে-বহরে বড়জোর বারো বাই দশ। তারই একদিকে কম্পোজ করার ডেস্ক, ছাপার মেশিন আর পেল্লায় কাটিং মেশিন। আমি আর শুভ ঘুম আটকাবার প্রবল চেষ্টায় রাখি, রেখা, নূতন, পুনমের সৌন্দর্যের তুলনামূলক আলোচনা করেও ঢুলুনি আটকাতে পারছি না। এখনও দুপাতা কম্পোজ করা বাকি। তারপর প্রুফ দেখা, ছাপা, সেলাই করা। সকাল দশটার ট্রেনে প্রচ্ছদ আসবে কলকাতা থেকে। দুপুরে চিটিয়ে বিকেলে নিয়ে আসব প্রেস থেকে। আমরা বুক ভরে নতুন পত্রিকার গন্ধ নেব। মেলার মাঠে প্রকাশিত হবে রবীন্দ্রনাথের দ্বারা নামাঙ্কিত ‘আশ্রমিকদের’ আত্মপ্রকাশের পত্রিকা ‘সাহিত‍্যিকা’। প্রকাশ ও আত্মপ্রকাশের বড়ই ঠেলা। অথচ না করেও উপায় নেই।

২০১৫। স‍্যাস পত্রিকার সম্পাদক সত‍্য ভাদুড়ির হাত ধরে প্রকাশনা জগতে ঢুকছি। ১৯৩৭ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত সেই ‘সাহিত‍্যিকা’ পত্রিকায় যত প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে তার একটা সংকলন হবে আমাদের প্রথম বই। সব প্রবন্ধ আমি পাড়ার একজনের সাহায‍্য নিয়ে পেজ মেকারে কম্পোজ করে মেল করে দিলাম কলকাতার একটা নামকরা প্রেসে। প্রচ্ছদ পাঠানো হল। দিন পনেরো পর সত‍্যদা ফোন করে বলল বই রেডি। আমি জিজ্ঞাসা করলাম প্রেসটা ঠিক কোথায় বলুন তো? আমি বই দেখতে সেই প্রথম প্রেসে গেলাম। বোলপুর শহর অবশ‍্য লেটার প্রেসের রাতজাগা রোমান্স থেকে অনেক আগেই বেরিয়ে এসেছে।

sahityika

যে তিনটি ইংরিজি বর্ণমালা এই বিপ্লবটা ঘটিয়ে দিল তাদের একত্রে বলা হয় DTP, ডেক্সটপ পাবলিশিং। এই ডেক্সটপ পাবলিশিং-এর ইতিহাসটা একটু ঘেঁটে নেওয়া যাক। ১৯৭০ সালে DTP-র প্রাথমিক যাত্রা শুরু হয়। আর অগ্রগতি ঘটে যখন James বলে এক ভদ্রলোক ফিলাডেলফিয়ায় কমিউনিটি খবরের কাগজ প্রকাশ করতে একটা প্রোগ্রাম ডেভেলপ করেন। অর্থাৎ বিশ্বজয়ের শুরুয়াৎটা হচ্ছে একটা স্থানীয় প্রয়োজন মেটাতে। এর আগে অবশ‍্য দু-একটা পাতা টাইপ করার জন‍্যে একটা প্রোগ্রাম ছিল।

আরও পড়ুন: ছাপা বই ও এক অর্বাচীন পাঠকের ভাবনা

DTP কথাটা প্রথম গ্রন্থীবদ্ধ করেন Aldus-এর প্রতিষ্ঠাতা Paul Brainerd। Aldus বই কম্পোজ করার সফ্টওয়ার পেজ মেকার বাজারে আনলে এর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে ওঠে। অফিসে অফিসে ঘরে ঘরে এর ব‍্যবহার শুরু হয়। লেজার প্রিন্টার আবিষ্কার হবার পর ফটোশপ ও কমদামি স্ক‍্যানার এর জনপ্রিয়তা ও কার্যকারিতা আরও বাড়িয়ে দেয়। পাশাপাশি অফসেট প্রিন্টিং-এরও উন্নতি ঘটে ওই টেকনোলজির সাহায‍্য নিয়ে। বাজারে ক্রমশ উন্নত ডিজিটাল প্রিন্টার আসতে থাকায় এখন ছাপার জগতে মূল লড়াই অফসেট বনাম ডিজিটাল। ডিজিটাল প্রিন্টার আসার পর ছাপার যে কায়িক শ্রম তা আরও কমে যায়। বাজারে ছোট ছোট বাইন্ডিং মেশিনও চলে আসায় এখন ছোট পাবলিকেশন কার্যত ওয়ান ম‍্যান প্রোডাকশনে পরিণত হয়েছে। লেটার প্রেস মুখ লুকোয় বারো বাই পনেরোর অন্ধকার গর্ভে। বড় বড় লোহার মেশিন লোহার দরে বিকিয়ে যায়। জায়গা নেয় ছোট ছোট মেশিন।

Digital Printer

শুরু হল ছোট জায়গায় বড় সম্ভাবনার যুগ। ছোট শহর, ছোট জায়গা, ছোট ইনভেস্টমেন্ট। মধ‍্যবিত্ত বাবা প্রফিডেন্ট ফান্ডের জমানো ভেঙে বাড়ি করার সময় একটা গ‍্যারেজও করেছিল এই আশায়, ছেলে চাকরি পেয়ে গাড়ি কিনবে। ছেলে চাকরি পেল না। গ‍্যারেজ হয়ে গেল প্রিন্টিং প্রেস। ব‍্যবসা শুরু হল কমদামি লেজার প্রিন্টার দিয়ে, ক্রমে বড় কালার প্রিন্টার, সব শেষে ব‍্যানার ছাপার প্রিন্টার।
প্রকাশনা ও আত্মপ্রকাশের জগত হুড়মুড় করে খুলে গেল। ইনফর্মেশন টেকনোলজি, এনড্রয়েড ফোন, ডিজিটাল ক‍্যামেরা, ফেসবুক-টুইটার সব এই বিপ্লবের এক-একজন সেনাপতি। এ বলে আমাকে দেখ, ও বলে আমায়।

DTP-র হাত ধরেই শুরু হল প্রকাশনার বিকেন্দ্রীকরণ। আগে ভালো বই বলতে বুঝতাম কলকাতার একটি-দুটি বনেদি প্রকাশক। বাকি বনেদি প্রকাশকদের ছাপার হাল এখনও তথৈবচ। এই বনেদিয়ানার মুখে ঝামা ঘষে দিল ডিজিটাল টেকনোলজি। প্রকাশনা আর বড় শহরমুখী রইল না। মফস্বলেও প্রতিষ্ঠিত হল অনেক প্রকাশন। ধরা যাক কলেজস্ট্রিটের কথা। বই বিপণনে তার গুরত্ব এখনও প্রশ্নাতীত। কিন্তু বই প্রকাশে নয়। অন-ডিমান্ড বই ছাপার পদ্ধতি শুধু বই রাখার সমস‍্যার সমাধান করল না, একটা বই ছাপার পিছনে যে অর্থনৈতিক ঝুঁকি সেটাও কমিয়ে আনল। লিটিল ম‍্যাগাজিন প্রকাশ অনেক সহজ হল। শুধু মফস্বল শহর নয়, গ্রাম থেকেও লিটিল ম‍্যাগাজিন প্রকাশ করাটাও এখন জলভাত। প্রকাশ, প্রাত‍্যহিক ছাপাছাপি, উৎসবের কার্ড, অনুষ্ঠানের বিজ্ঞাপন-ব‍্যানার সব এখন ঘরে বসে অথবা ঘরের বাইরে দু-এক কদমের খেল্।

প্রাতিষ্ঠানিক প্রকাশনা শুধু নয়, ব‍্যক্তিগত প্রকাশনার জগতেও খুলে গেল অনন্ত সম্ভাবনার দরজা। আমি ইউটিউবে গ্রাফিক্স আর্টিস্টদের চার-পাঁচটা পোষ্ট দেখেছি যারা একটা পি.সি, লেজার ডুপ্লেক্স প্রিন্টার আর সামান‍্য একটা কাটিং মেশিনে কমিক্স বই বানিয়ে লোকাল বুকশপ আর বন্ধুদের বিক্রি করছে। এদের কেউ কেউ পরে বড় পাবলিশারদের নজরে এসেছে, প্রতিষ্ঠাও পেয়েছে।

sahityika2

শুধু প্রকাশক বা প্রকাশনা নয়, বই প্রকাশের গোটা প্রক্রিয়াতেই লেখকের সরাসরি যোগদানের পরিসর ও স্বাধীনতা তৈরি হল। আগে প্রকাশকের অন্ধকার গর্ভগৃহে বই ঢুকে যাওয়ার পর লেখক বই দেখতে পেত হাতে আসার পর। এখন লেখক চাইলে একটা ডামি-বই তার হাতে চলে আসবে আর তার ভালোমন্দ বিচার করে সে ছাপার অনুমতি দিতে পারবে ঘরে বসেই। এই স্বাধীনতা আগে লেখকদের ছিল না।

ডিজিটাল প্রিন্টারের অগ্রগতি এখন প্রকাশনা শিল্পকে কুটির শিল্পে পরিণত করেছে। শুধু প্রকাশনা নয়, বিজ্ঞাপনের জগতেও এসেছে বিপ্লব। আগে সিনেমার বড় পোস্টার আসত ছোট ছোট ভাগে। প্রডিউসার বা ডিস্ট্রিবিউটার সেই পোস্টার পাঠাত। মফস্বলের হল মালিক লোক লাগিয়ে নম্বর মিলিয়ে সেই পোস্টার দেওয়ালে সাঁটত। এখন হল-মালিক তার শহরেই ছ-ফুট চওড়া ও যত খুশি লম্বা পোস্টার ছাপিয়ে নিতে পারে। ডিজিটাল প্রিন্টারে ভিনাইল থেকে শুরু করে যে-কোনও ধরনের কাগজ এমনকি কটন ক‍্যানভাসও ছাপা যায়। বইয়ের প্রচ্ছদেও অনেক রকম এক্সপেরিমেন্ট করা যায়।

শেষ পর্যন্ত ব‍্যাপারটা গিয়ে পৌঁছেছে বুক এটিএম-এ। একটা বইয়ের পিডিএফ নিয়ে হাজির হলেই হল। একটা প্রিন্টিং মেশিনে সেটা ভরে দেওয়া হবে। প্রচ্ছদ ও লেখা-ছাপা-বাঁধাই-কাটিং হয়ে বারো মিনিটে বই হাতে চলে আসবে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় এখন এই বুক-এটিএম ব‍্যবহার করছে লাইব্রেরির বিকল্প হিসেবে।

জায়গা ও সময় অসঙ্কুলানের যে গল্প আমরা শুরু করেছিলাম পৌষ মেলার আগের দিনের একটা লেটার প্রেসের অভিজ্ঞতা দিয়ে, DTP বিশ্বময় দিয়েছে তাকে ছড়ায়ে। খুলে দিয়েছে প্রকাশনা ও আত্মপ্রকাশের নতুন দিগন্ত। লেটার প্রেসের রাত জাগা রোমান্স-মেদুরতা বেঁচে থাক। আমরা এগিয়ে যাই DTP-র দিবস-যাপনে।

 

 

ছবি সৌজন্য: লেখক, Needpix

Asim chattoraj

লেখক ও নাট্যকার অসীম চট্টরাজের জন্ম ১৯৬৪। প্রতিষ্ঠিত বাংলা সংবাদপত্র ও পত্রিকার পাঠকদের কাছে তিনি এক পরিচিত নাম। পেশায় অধ্যাপক অসীম চট্টরাজের লেখালেখির শুরু নাটক দিয়ে এবং গল্প উপন্যাসের জগতে প্রবেশ নব্বই-এর দশকে। প্রকাশিত কিছু গ্রন্থ 'হারাধন মণ্ডলের গল্প', 'কিছুতো নেপথ্যে থাক', 'অলৌকিক তীর্থযাত্রা', 'টিলা'।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *