বই – দৃষ্টিকোণ
লেখক- মণীশ নন্দী
প্রকাশক – আনন্দ, ২০১৯
প্রকাশকাল – ২০১৯
লেখক ও সাংবাদিক, অর্থনীতিক, আধিকারিক ও কূটনীতিক মণীশ নন্দী তাঁর জীবনের বহু বিচিত্র অভিমুখ চিত্রিত করেছেন এই বইয়ে। কর্মসূত্রে প্রায় ভূপর্যটক এই মানুষটির বর্ণময় অভিজ্ঞতা পাঠকদের আকর্ষণ করে স্বাভাবিকভাবেই। উপক্রমণিকা দিয়ে সূচিপত্রের শুরু করে দু’শ পনেরো পাতার এই বইটি ভাগ করা হয়েছে চারটি অংশে – ‘চেনা-অচেনা’, ‘বিদেশ-বিভুঁই’, ‘সম্পর্ক-জ্বালা’ ও ‘সমাজ-সংকট’।
এই চারটি অধ্যায় প্রতিফলিত করে লেখকের বহতা জীবনের এক পরিক্রমা, যার মধ্য দিয়ে মূ্র্ত হয় তাঁর জীবনবোধ। এই যাত্রাপথে একদিকে যেমন রয়েছে আনন্দে-বিষাদে গড়া পারস্পরিক সম্পর্কের টানাপোড়েন, তেমনি অন্যদিকে রয়েছে সমাজ-সংস্কৃতি, রাজনীতি বা অর্থনীতি নিয়ে লেখকের মননশীল চিন্তার ছোঁয়া যা পরিস্ফুট হয়েছে এই জীবনদর্পণের নির্মাণে।
যে কোন স্মৃতিচারণই ব্যক্তিগত এবং ‘দৃষ্টিকোণ’ও তার ব্যতিক্রম নয়। কিছুটা অণুগল্পের আকারে বিন্যস্ত লেখকের নানা অনুভবই পাঠককে আগ্রহী করে তুলবে এই সঙ্কলনটির প্রতি, যা লেখক মুখবন্ধে একটি প্রবন্ধ সঙ্কলন হিসেবেই উপস্থাপিত করেছেন। এই ব্যক্তিগত কথনের মাঝে নানাভাবে আভাস পাওয়া যায় লেখকের সুচিন্তিত মননের।
“বিদেশ-বিুভুঁই” অংশে দুজন সফল মানুষের আখ্যান দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ‘আশ্চর্য লোক, আশ্চর্য লোকালয়’ –এ রয়েছে রবার্টের কথা। রবার্টের স্বপ্ন এমন একটি শহর গড়ে তোলা যা হবে একটি ‘স্বয়ংসম্পূর্ণ সম্প্রদায়, যেখানে লোকে থাকবে, কাজ করবে এবং সানন্দে অবসর সময় কাটাবে’। গড়ে ওঠে রেস্টন, বৃহত্তর ওয়াশিংটনের এক খানদানি মফস্বল।
‘চেনা-অচেনা’ পর্বে ‘কি লিখছি, কি পড়ছি’ তুলে ধরেছে লেখকের দায়িত্ববোধের বিশ্লেষণ –“লেখকের প্রধান কাজ হল সাক্ষ্য দেওয়া, আপস-রহিত সততার সঙ্গে”। এই অনমনীয় মনোভাবের মধ্যে স্পষ্ট হবে তার স্বকীয় স্বরক্ষেপণ। লেখার বিষয় কী হওয়া উচিৎ, সে সম্পর্কে বিতর্কের অবকাশ আছে, যা হয়তো লেখকের অনভিপ্রেত নয়।
এই পর্বেই “সুবিধার অসুবিধা” লেখায় পাই এক তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণ – “আরাম আমাদের ভগবান”। আর এই আরাম খুঁজতে গিয়ে মানুষ হারিয়ে ফেলছে “স্বাধীন, ঋণহীন চিন্তা করার ক্ষমতা ও প্রবণতা…”।
“বিদেশ-বিুভুঁই” অংশে দুজন সফল মানুষের আখ্যান দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ‘আশ্চর্য লোক, আশ্চর্য লোকালয়’ –এ রয়েছে রবার্টের কথা। রবার্টের স্বপ্ন এমন একটি শহর গড়ে তোলা যা হবে একটি ‘স্বয়ংসম্পূর্ণ সম্প্রদায়, যেখানে লোকে থাকবে, কাজ করবে এবং সানন্দে অবসর সময় কাটাবে’। গড়ে ওঠে রেস্টন, বৃহত্তর ওয়াশিংটনের এক খানদানি মফস্বল। লেখকের মতে ‘প্রায় অবাস্তব’ এক স্বপ্নের রূপকার এই মানুষটির আখ্যান সাফল্যের এক আশ্চর্য দৃষ্টান্ত।
আর একটি চরিত্র যশবীর ধীলন। ‘একটি সম্পূর্ণ জীবন’ -এ যাঁর সহজ সরল জীবনবোধ পাঠককে আকৃষ্ট করে। যশবীর বলেন, ‘রানিয়া গ্রামে (পাঞ্জাব) আমি মন্দ ছিলাম না, যদিও গরিব ছিলাম। এখানে আমি বড়োলোক হলাম না বটে, কিন্ত সৎপথে থেকে….জীবন ভালোই কাটালাম। আমার জীবন বেশ সম্পূর্ণ।’ যশবীরের আত্মবিশ্বাস সাফল্যের এক নতুন মানদণ্ড।
‘সম্পর্ক-জ্বালা’ বিভিন্ন প্রবন্ধের মধ্য দিয়ে মানবিক সম্পর্কের বিশ্লেষণের এক প্রয়াস। লেখক তাঁর জীবনযাপনের ধারায়, বহু মানুষের সংস্পর্শে এসেছেন। সেই সকল অভিজ্ঞতা তাঁকে সমৃদ্ধ করেছে।। “তোমাকে বুঝি কী করে” – এক শিশুর ভাষা বোঝার চেষ্টার মধ্য দিয়ে প্রকাশ করে সেই উপলব্ধি যে “অন্যদের কথা আমরা কতটুকু শুনি আর কতটুকুই বা আত্মস্থ করি”।
“সঙ্গ ও নিঃসঙ্গতা” বিশেষভাবে ভালো লাগে এই সম্পর্ক বিশ্লেষণের প্রেক্ষিতে। লেখকের সঙ্গে এক বিখ্যাত অভিনেত্রী আলাপচারিতার সূত্রে বলছেন, ‘প্রচুর লোকজনের সঙ্গে আমায় সময় কাটাতে হয়।…লোকে সদাই আমার আশেপাশে ঘোরে। ওই সব সঙ্গ আসলে কিন্তু সম্পর্কবিহীন, ওগুলোর বিশেষ কোনও মূল্য নেই…সব মিলিয়ে আমি নিঃসঙ্গ”।
লেখকও তাঁর গতিময় জীবনে অনুভব করেন এই নিঃসঙ্গতা যা পাঠককে ছুঁয়ে যায়। এই অংশে নারী নির্যাতন প্রসঙ্গে লেখা ‘আজই হোক প্রথম দিন’ উল্লেখযোগ্য। লেখকের মতে, মেয়েদের আত্মসম্মান ও স্বাধিকার রক্ষার জন্য ‘গোষ্ঠীগতভাবে’ প্রতিরোধ করতে হবে।
চতুর্থ পর্ব – “সমাজ-সংকট”। এই সময়ে নারীদের অবস্থান, লিঙ্গভিত্তিক কিছু অনমনীয় চিন্তাধারা, কালো টাকার ভূমিকা, স্বেচ্ছামৃত্যু, একনায়কতন্ত্রের প্রবণতা প্রভৃতি বিবিধ প্রসঙ্গে লেখক তাঁর সুচিন্তিত মতামত ব্যক্ত করেছেন এক অনায়াস দক্ষতায়। গভীর অর্থবহ এই বিষয়গুলি লেখনীর গুণে কখনই অনধিগম্য হয়ে ওঠে না।
“চুরিবিদ্যা মহাবিদ্যা” দুর্নীতি, কালো টাকা ও রাজনীতি কীভাবে একে অপরের সম্পূরক তা ব্যক্ত করে নিঃসংশয়ে। ‘বিমুদ্রাকরণ’ লেখকের মতে ‘কপটতার’ উদাহরণ মাত্র। “ খলনায়ক ও আমরা” হিটলারের কাহিনী বিবৃত করে এক সতর্কবার্তা রূপে।
‘মনীষাদের কথা’ প্রশ্ন রাখে যে, কেন স্বাধীনতার সত্তর বছর পরেও, ভারতীয় মেয়েরা প্রধানমন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রী হতে পারলেও, মেয়েদের পক্ষে অন্যতম ‘নিকৃষ্ট দেশ হল ভারতবর্ষ’। লেখকের মতে এর কারণ ‘একটা বদ্ধমূল ধারণা – মেয়েরা ছেলেদের সমান মূল্যবান নয়’। বহুযুগ ধরে মেয়েদের নিকৃষ্ট প্রতিপন্ন করবার এই প্রবণতা ‘বদলাবার সময় এসেছে’। সেই সময় অভিষ্ট যেখন দ্বিধাহীনভাবে বলা যাবে, ‘বাচ্চার মা ডাক্তার, বাবা নার্স’।
“অস্বাভাবিকতা প্রসঙ্গে” একটি যথার্থ সংবেদনশীল রচনা যা ভাবতে শেখায় যে সমাজে নারী-পুরুষের সরাসরি সরলিকৃত বিভাজনের পরেও আছেন এমন অনেক মানুষ যাদের পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপনের প্রবণতা প্রথাগত সামাজিক নির্দেশ মেনে চলে না। লেখক মনে করে, বৃহত্তর সমাজ এদের প্রান্তিক করে রাখলেও, নানাভাবে এদের নিগৃহিত করা হলেও, সময় এসেছে ‘আমাদের দৃষ্টির আলস্য ত্যাগ করবার’।
“চুরিবিদ্যা মহাবিদ্যা” দুর্নীতি, কালো টাকা ও রাজনীতি কীভাবে একে অপরের সম্পূরক তা ব্যক্ত করে নিঃসংশয়ে। ‘বিমুদ্রাকরণ’ লেখকের মতে ‘কপটতার’ উদাহরণ মাত্র। “ খলনায়ক ও আমরা” হিটলারের কাহিনী বিবৃত করে এক সতর্কবার্তা রূপে। জনসমর্থনপুষ্ট ক্ষমতাসীন ব্যক্তি যথার্থই দেশের ও দশের জন্য অশনী সংকেত কিনা তা অবশ্যই বিচার্য। “যে মরণ শ্যাম-সমান” স্বেচ্ছামৃত্যু ও মানুষের ব্যক্তিগত অধিকার নিয়ে লেখকের মতামত ব্যক্ত করে – ‘তোমার জীবন তোমার…কীভাবে তুমি বাঁচবে সেটা তুমি স্থির করবে…’।
“দৃষ্টিকোণ” জীবনের এক চালচিত্র। পাঠক যে শুধু এক বিশ্বজনীন সংস্কৃতির আস্বাদ পাবেন তাই নয়, মানবজীবনের নানা স্তরের বর্ণময়তাও উপলব্ধি করবেন। সমান্তরাল রেখায় রয়েছে এমন কিছু বিষয় যা শুধু প্রাসঙ্গিকই নয় বর্তমান কালের দিশারী।
ড: ঝুমা সান্যাল দক্ষিণ কলকাতার উইমেন্স ক্রীশ্চান কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপিকা ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কাজ করেছেন বহু বছর। বর্তমানে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের ইতিহাস বিভাগের সঙ্গে যুক্ত। অবসরের অবকাশে নানা বিষয়ে পড়াশুনা ও লেখালেখির চর্চা করতে ভালো লাগে। সাহিত্য, সঙ্গীত ও সিনেমার একান্ত অনুরাগী। ভাল লাগে পথপশুদের দেখাশোনা করতে।
বই রিভিউ টি পড়ে বইটি পড়বার আগ্ৰহ জাগে।
সমালোচকের সুন্দর লেখনি পুস্তকটির প্রতি আগ্রহ জাগায় । লেখকের বিভিন্ন গল্প , প্রবন্ধ ইত্যাদির বিষয়বস্তু যেভাবে আলোচনায় বর্ণনা করেছেন তা এককথায় অনবদ্য ।
Very encouraging review.long to read the book itself