শহরের এক রাস্তা লাগোয়া রিক্সাস্ট্যান্ডের দেওয়ালে এই দুটো লাইন চোখে পড়ল সম্প্রতি। কে লিখেছিল জানি না। কোনও দলের নাম ছিল না।
“কাজের দিদি চাইলে টাকা দিদির ’পরে রাগ করো,
তোমরা যে সব ডেঁপো খোকা, পাব-এ দশহাজারি ড্যান্স করো, তার বেলা?”
আমার আপনার বাড়িতে প্রতিদিন ভোরবেলা যে মহিলারা কলিং বেল বাজান, আমাদের চোখ খোলার আগেই যাঁদের কাজের সময় শুরু হয়ে যায়, তাঁদের কথা বলছি। ভোরের ঠান্ডায় হালকা চাদরটা যখন আমরা জাপ্টে ধরতে থাকি আরও, তার মধ্যেই হয়ত তাঁরা আধ ঘণ্টা কিংবা পঁয়তাল্লিশ মিনিট দূরের কোনও স্টেশন থেকে ট্রেনে চেপে বসেছেন, আপনার বাড়িতে ঠিক সময়ে কাজে ঢুকবেন বলে। য কিংবা ত-এর উপরে চন্দ্রবিন্দুটা দেখতে পেয়েই অনেকে হয়তো নাক সিঁটকোবেন, ভ্রু কুঁচকোবেন। কাজের লোককে আবার ‘আপনি’, কত ঢং। অথচ একটু ভাল করে ভাবলেই বুঝতে পারি, আমাদের ভাল থাকার জন্য তাঁদের ‘অস্তিত্ত্ব’টা কত জরুরি। আক্ষরিক অর্থেই।
তাঁরা ভাল আছেন কি না, আমরা অবশ্য তা জানতে চাই না কোনওদিন। আমাদের বাড়িতে বছর পঁচিশের যে মেয়েটি কাজ করেন, সারা বছরের এঁটো বাসন আর ঘরের ধুলোর দায়িত্ব যাঁর হাতে তুলে দিয়ে আমরা নিশ্চিন্তে থাকি, তাঁর মাইনে বাড়ানো হয় বছরে একশ টাকা। একবার বুকে খুব দরদ উথলে ওঠায় আলপনাকে বলেছিলাম, আজ থেকে তোমার মাইনে দ্বিগুণ করে দিলাম। মাস গেলে দেড় হাজার টাকা আমার থেকে নিয়ে যেও। নিজেকে বেশ রামমোহন রায়ের ২০১৯ এডিশনের মতো মনে হচ্ছিল। ভাল লোক তো এখনও আছে এই দুনিয়ায়, আমার মতো। এ কথা শোনার পর অবশ্য আলপনার মুখে কাশফুল দোলেনি, মেঘ জমে গিয়েছিল ঝটিতি। কাঁচুমাচু মুখে ও বলে, ‘এই ভুলটা একদম করবেন না দাদা। আমরা এত পাই না। আমার কাজ থাকবে না।’ আমায় অবাক হতে দেখে ও বলল, ‘অন্যরা আমায় টিকতে দেবে না।’
কর্পোরেট সংস্থাগুলোতে বিভিন্ন ধরনের ট্রেনিং প্রোগ্রাম হয়। এর মধ্যে একটা মডিউল খুব কমন, মানে অধিকাংশ সংস্থাতেই এই মডিউলের ট্রেনিংটা দেওয়া হয়। এর নাম, ব্যালেন্সিং ওয়ার্ক অ্যান্ড লাইফ। একটা সংস্থার তরফে এমন এক ট্রেনিং সেশনে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। সেশনটির পরিচালক কাজ আর জীবনের ব্যালেন্স বোঝাতে শুরু করে একটু পরেই যে স্টেশনে এসে থামলেন তা হল টাইম অ্যান্ড ভ্যালু অফ মানি। মানে, সময়ের দাম। এরপর তিনি বললেন, দিনে কত ঘণ্টা অফিসে থাকি সেই সময়টাকে মিনিটে কনভার্ট করতে। তার পর মাসে যে টাকা মাইনে পাই তাকে ওই মিনিট দিয়ে ভাগ করতে বলা হল। ভাগফল হিসেবে যা পাওয়া গেল সেটাই হল হল মিনিট প্রতি সময়ের দাম। এই অঙ্কের ‘প্রাপ্তি’ দেখে এক ডিরেক্টর সাহেব যারপরনাই উত্তেজিত হয়ে জানালেন, হিসেব বলছে, ওঁর প্রতি মিনিটের আয় আটতিরিশ টাকা। লাখ চারেক টাকা মাসে মাইনে হলে হিসেবটা এরকমই দাঁড়ায়। উনি এ বারে বললেন, “ভেরি এনকারেজিং। অগলা সাল অনওয়ার্ডস মাই টার্গেট হর সেকেন্ডে এক টাকা রোজগার।” হাততালি। পরিচালক বললেন, “দ্যাটস দ্য স্পিরিট”।
যে হিসেবটা আমরা করি না কোনওদিন, সেই হিসেবের খাতাটা খোলা যাক এবার। বাড়িতে কাজ করছেন যিনি, কাজ বলতে বাসন মাজা আর ঘর ঝাড় দেওয়া মূলত, তাকে মাসের শেষে সাকুল্যে বেতন দিচ্ছি সাত-আটশো টাকা। তিরিশ দিনে মাস ধরলে বাড়ি প্রতি ওনার রোজগার দিনে মোটামুটি তেইশ টাকার মতো। এই তেইশ টাকার জন্য ওঁকে প্রতি দিন প্রতি বাড়িতে অন্তত এক ঘণ্টা করে কাজ করতে হয়। বাসন ধুতে আধ ঘণ্টা। ঘর ঝাড় দিয়ে মুছতে আরও অন্তত কুড়ি পঁচিশ মিনিট। মাসে তিন চার দিন ছুটির অনুমোদন আছে কোনও কোনও বাড়িতে। অনেক বাড়িতে অবশ্য তাও নেই। কামাই করলে পয়সা কাটা যায়। বাসন বেশি হলে, কিংবা কড়াইতে নাছোড়বান্দা পোড়া তেলের দাগ লেগে থাকতে দেখে যদি কখনও মুখ খুলে ফেলেন তাঁদের মধ্যে কেউ, বুলেটের মতো জবাব তেড়ে আসে, হ্যাঁ, তো? ফ্রিতে কাজ করছিস নাকি?
সিভিক পুলিশের কথা প্রশাসন ভাবে, ভিন রাজ্যে কাজ করা কোনও ঠেলাচালক আহত হলেও উপরওয়ালারা নড়েচড়ে বসেন, যৌনকর্মীদের দাবি-দাওয়া-অধিকার নিয়েও আলোচনা চলে প্রায়ই, বিল পাশ হয়, কিন্তু আমাদের বাড়িতে দিনের পর দিন কাজ করে চলেন যাঁরা, শ্রমদান করেন হরির লুঠের বাতাসার মতো, তাঁদের নিয়ে কোনও কথা শোনা যায় না। আমরাও করি না। আমার বিদেশে থাকা বন্ধুরা, আমাদের ভিনদেশি তারারা, সব পেয়েছির দেশে বসেও এক জন কাজের লোক পায় না। প্রথমত, কাজের লোক বলে সেভাবে কিছু হয় না বিদেশে। দ্বিতীয়ত, লোক পায় না কথাটা হয়ত বলা ভুল। লেখা উচিত ছিল, ‘অ্যাফর্ড’ করতে পারে না। ইওরোপে একা থাকা, আমার এক স্কুলজীবনের বন্ধুর থেকে শুনলাম, ঘরে তিন মাস কোনও ঝাঁটা না পড়ায় মেঝেটা যখন পোস্তা বাজারের মতো হয়ে গিয়েছিল, তখন একজন প্রফেশনাল ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট কনসালট্যান্টকে ও কল দেয়। আমাদের আলপনার মতোই বছর পঁচিশ-ছাব্বিশের এক সে দেশীয় আলপনা হাজির হয়, কালো, চকচকে এক বড় সেডান গাড়ি চালিয়ে। প্রথমে ডাস্ট ফ্রি ব্রুম (মানে ঝাঁটা) আর তার পরে ভ্যাকুয়াম ক্লিনার দিয়ে পঁয়তিরিশ চল্লিশ মিনিটে কোনওমতে কাজ সেরে হাজার দশেক টাকার সমান ইওরো নিয়ে চলে যায়। এমন স্মার্ট আর বড়লোক কাজের দিদি দেখে বন্ধুর এমনিতেই ‘প্রেস্টিজ ডাউন’ হয়ে যায়। তাও মিনমিন করে জিজ্ঞেস করে, ‘ম্যাডাম, মুছবেন না? এক বালতি জলে এক ছিপি ফিনাইল দিয়ে যদি..? ন্যাকড়াটা বেসিনের তলায় আছে।’ উত্তর যা পেয়েছিল, তা ছাপা যাবে না। তবে ওই বন্ধুই বলল, বিল মেটানোর পরে ও চিরাচরিত আলস্যটাকে কমোডে ফ্লাশ করে দিয়েছিল।
সস্তা দেশে সস্তা হয়ে আমরা যারা দিব্যি আছি, নিজেদের থেকে আরও অনেক সস্তা কাউকে পেয়ে গেলে আমরা নিংড়োতে ছাড়ি না। বাড়ির বাসন মাজা আর ঘর পরিস্কার করার মহিলারা আমাদের মতো বহু মানুষের কাছে একমাত্র ছড়ি ঘোরানোর জায়গা। শুধু এঁদের উপরেই আমরা নিজেদের এমপ্লয়ার সত্ত্বার নখদন্তসহ পূর্ণ প্রকাশ ঘটানোর সুযোগ পাই। রান্নার লোক আরএকটু উঁচু ‘জাত’। তাদের মাইনেও বেশ বেশি। অতিরিক্ত কথা শোনানোর কোনও সুযোগ নেই। ড্রাইভারেরা তো রীতিমতো ড্রাইভার সাহেব। ইলেক্ট্রিশিয়ান কিংবা কলের মিস্তিরির পায়ে দশ বার পড়তে পারলে ওনারা একবার দেখা দেন। দশ বার হয়তো কম বলা হল। তার্কিকরা বলবেন, এমনই তো হবার কথা ছিল। ওঁরা তো স্কিলড। হক কথা। তবে এঁটো বাসন পরিস্কার করতে আর ঘর মুছতে কতটা স্কিল যে আসলে দরকার হয়, তা বুঝি আলপনা, মালতী বা জবারা এক দিন কাজে না এলে।
আমরা এটা খুব ভাল করে জানি, তাঁরা গণ অভ্যুত্থানে নামবেন না কোনও দিন। কারও সইয়ের ভুলে অসংগঠিত ক্ষেত্রে ন্যুনতম মজুরির আওতাতেও আসবেন না। যদি আসেন, মনে রাখবেন, আমাদের কিন্তু ঘোর বিপদ। আপাতত যেটা করা যেতে পারে, তা হল ওঁদের একটু বেশি সম্মান দেওয়া। নিজের ওভারটাইম তো বুঝে নিতে পারি বেশ। একদিনের কাজ বাড়তি হয়ে গেলে পরের দিনের জন্য ফেলে রাখতে পারি সানন্দে। কাজের দিদিরা তা পারেন না। কোনওদিন বাসন যদি বেশি হয়ে যায় খুব, কয়েকটা যদি নিজেরাই ধুয়ে রাখি, মন্দ কি? ওঁদের কাজ কমাতে পারায় যে আনন্দ, তার থেকে অনেক বেশি ফিল গুড ফ্যাক্টর কাজ করবে নিজের কাজটা বাড়ায়।
আরও একটা জিনিস করা যেতে পারে। আমি যদি ওঁর জায়গায় থাকতাম, তাহলে এই কাজগুলো করার জন্য আমি কত নিতাম, সেটা যদি আমরা সবাই মিলে নিজেদের মনে ভাবতে শুরু করি, তা হলে আমাদের অজান্তেই ওঁদের অবস্থার একটু উন্নতি হয়।
ছকে বাঁধা হিসেবের বাইরেও একটা বড় হিসেব পড়ে থাকে।
অম্লানকুসুমের জন্ম‚ কর্ম‚ ধর্ম সবই এই শহরে। একেবারেই উচ্চাকাঙ্খী নয়‚ অল্প লইয়া সুখী। সাংবাদিকতা দিয়ে কেরিয়ার শুরু করলেও পরে জীবিকার খাতবদল। বর্তমানে একটি বেসরকারি সংস্থায় স্ট্র্যাটেজি অ্যানালিস্ট পদে কর্মরত। বহু পোর্টাল ও পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। প্রকাশিত হয়েছে গল্প সংকলন 'আদম ইভ আর্কিমিডিস' ও কয়েকটি অন্য রকম লেখা নিয়ে 'শব্দের সার্কাস'।
আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ, এমনভাবে ভেবেছেন বলে । এসব গৃহকর্মীদের উপর আমাদের যথেষ্ট সহানুভূতিশীল হতে হবে।তাঁদের কাজের মূল্যায়ন করতে হবে । সেসময় এসে গেছে।
খুব ভালো লেখা । জীবনের আশে পাশে ছড়িয়ে থাকা বিষয় নিয়ে ভাবছেন । সুন্দর পরিবেশনা।