কলেজ-ইউনিভার্সিটির ক্লাস, কফি হাউজ, ওয়াইএমসিএ-র চা, কফি, রোম্যান্স, হপ্তায় বারতিনেক শাঁখারিটোলার রামসীতা মন্দিরের আড্ডা আর মধ্যরাত অবধি বইয়ের পাতা ওল্টানোর বাইরেও আর এক নেশায় মজেছিলাম নকশাল আন্দোলনের ওই আশ্চর্য দ্রোহকালে। তা হল, ছুটিছাটার সকালে কী বিকেলে আমার পাড়ার বন্ধু বাবলুদার বাড়িতে ওঁর সেতারের রেওয়াজ শুনতে শুনতে ওঁর সঙ্গে রাগ-রাগিনী ও ক্ল্যাসিকাল আর্টিস্টদের নিয়ে দেদার আড্ডা চালানো। এই বাবলুদাকে বাঙালি চেনে সেতারশিল্পী সুব্রত রায়চৌধুরী নামে। সুদর্শন, বিদ্বান ও রাগদার এই মানুষটি আমার ক্রিক রো-র জীবনকাল থেকে এক অপূর্ব মানসসঙ্গী। আমার থেকে সাত বছরের বড়, কিন্তু এই বয়ঃভেদ কখনওই বুঝতে দেননি। একসময় ক্রিক রো ছেড়ে কাছেই ক্যানাল স্ট্রিটে উঠে গিয়েছিলেন, তাতে মনের টান যেন আরও বাড়ল। কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় (বাবলুদা তখন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ইকনমিক্স পড়াচ্ছেন) এই বন্ধুত্বটা একটা উঁচু তারে বাঁধা পড়ল। কোনও সপ্তাহে দেখা না হলে ফোন আসত, “কী গো, নতুন কোনও বান্ধবী জুটল বুঝি? এসো, রবিশঙ্করজির রোম্যান্টিক রাগিনী রসিয়া শুনিয়ে দেব। হবে তো?”
আমাদের আড্ডাটা অদ্ভুতই ছিল। বাবলুদা মারোয়াঁ বাজাচ্ছেন আর বলে যাচ্ছেন, “আমির খাঁ সাহেবের এল পি-তে মারোয়াঁর যে-চেহারাটা পাচ্ছ, সেটা রেকর্ডের অন্য পিঠে যে-হংসধ্বনি পাচ্ছ সেরকমই একটা ধ্যানমন্ত্রের মতো। অথচ হংসধ্বনি একটা রোম্যান্টিক রাগ। খাঁ সাহেব বন্দিশ ব্যবহার করছেন কী? না, ‘জয় মাতে বিলাম্ভ, তাজ দে।’ রোম্যান্সের সুরে দেবীর বন্দনা। আর রুখুসুখু মরুভূমির থেকে উঠে আসা পঞ্চমবর্জিত মারোয়াঁতে কথা নিচ্ছেন ‘পিয়া মোরে আয়’! আর কী গভীর রং লাগাচ্ছেন ‘ম ধা নি রে সা’ রূপরেখায়! তন্ত্রকারীতে এই ভাব পেতে হলে শুনতে হবে রবিশঙ্করজির মারোয়াঁ। উনি নিচ্ছেন এভাবে…” বলে বাবলুদা রে নি ধ ম গ ম রে সা তান নিলেন মধ্য বিলম্বিতে। তারপরেই বললেন, “আর আমির খাঁ সাহেব দ্রুত বন্দিশে ধরে নিচ্ছেন কী? না, ‘গুরু বিনা জ্ঞান ন পাবে’… ভাবা যায়? কী কথা, কী তার রূপ! যাই বলো ভাই, এঁরা মহাপুরুষ।”

বাবলুদার সঙ্গে সন্ধের আড্ডা হামেশাই রাত পর্যন্ত গড়াত। আমাকে বাড়ি পৌঁছে দেবার অজুহাতে সিগারেট ধরিয়ে বেরতেন। আর মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে তর্ক শুরু হত রবিশঙ্কর, আলি আকবর, বিলায়েত খাঁ নিয়ে। একদিন আমি লড়ে যাচ্ছি রবিশঙ্করের হয়ে, বাবলুদা আলি আকবর খাঁর হয়ে, আর একদিন আমি লড়ছি আলি আকবর সাহেবের জন্য আর রবিশঙ্করের পক্ষ নিয়ে তর্ক করে যাচ্ছেন বাবলুদা। পাড়ার অনেককেই পরে বলতে শুনেছি, “রাত্তিরে তুমি আর বাবলু রাস্তায় দাঁড়িয়ে কী করো?” তাদেরকে কিছু বোঝাবার চেষ্টাও করিনি কখনও। কে জানে, কী বুঝতে কী বুঝবে! তবে একটা ডায়ালগ এসেই পড়ত বাবলুদা আর আমার তর্ক করতে করতে। কখনও বাবলুদা বলছেন মাথা চুলকোতে চুলকোতে, “এই সেরেছে, কাল ন’টায় তো ক্লাস নেবার আছে!” কখনও আমি বলছি, “ও মা, সকাল দশটায় তো জ্যোতি ভট্টাচার্যের ‘কিং লিয়ার’ নিয়ে ক্লাস! আর এখন রাত দশটা!!” তখন দু’জন দু’দিকে পালালাম।

উচ্চাঙ্গ গানের মহলে বাবলুদার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন তরুণ উস্তাদ আমজাদ আলি খান। একদিন বাবলুদা আর আমি রেকর্ড চালিয়ে আমির খাঁয়ের মারোয়াঁ শুনছি, হঠাৎ আমজাদ এলেন আনন্দবাজার গ্রুপের তরুণ, সঙ্গীতবিলাসী কর্তাব্যক্তি অরূপ সরকারের সঙ্গে। আমরা আমির খাঁয়ের মারোয়াঁয় ডুবে আছি দেখে আমজাদভাই সেদিন যে-একটা কথা বলেছিলেন তা আজও কানে অবিকল লেগে আছে। খাঁ সাহেবের সাদা-কালো পোর্ট্রেট দেওয়া এলপি স্লিভটা হাতে তুলে বলেছিলেন, “হিন্দুস্তানমে এক হি তো গাওয়াইয়া হ্যায়!” এর কিছুদিন আগেই এই বাবলুদা আর অরূপবাবুর মাধ্যমে আমজাদভাইয়ের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। সে কথায় পরে আসছি।
আগে বলি অরূপবাবু কী করে এলেন জীবনে। ওঁকে প্রথম দেখার সকালটাও স্পষ্ট মনে আছে। বাবলুদা কার্পেটে বসে শুদ্ধ সারং বাজাচ্ছেন, আমি ওঁর মুখোমুখি কার্পেটে বসে শুনছি। আর আমাদের পিছনে সোফাতে বিস্কিট এবং সাদা চেকের বুশ শার্ট, খাকি রঙের ট্রাউজার্স, বাটার ব্রাউন মুনডাস্ট বুট জুতো, কবজিতে ওমেগা ঘড়ি আর মোটা ফ্রেমের খয়েরি রঙের চশমা পরে এক ভদ্রলোক বসে আছেন। আমি বাবলুদার দিকে মুখ করে আছি, ভদ্রলোক ‘সুব্রতদা! সুব্রতদা’ করে মাঝেমধ্যে কিছু বলছেন। সবই বাজানো রাগ নিয়ে। বাবলুদা রাগের কিছু ভেরিয়েশন করলেও টপাটপ বলে দিচ্ছেন সেটা মিঞাঁ কি সারং হল না গৌড় সারং। ভদ্রলোকের এই রাগবোধটাই আমাকে প্রথম টেনেছিল ওঁর দিকে। পিছনে ঘুরে ছোট করে কাটা চুলের মানুষটাকে প্রথম যে-চেহারায় দেখি সেই চেহারাটাই বর্ণনা করলাম একটু আগে। পরে বাজনা শেষ করে বাবলুদা আলাপ করিয়ে দিলেন, “এই হচ্ছে অরূপ, আর এই হচ্ছে শঙ্কর”। ব্যস্, এইটুকুই। পরে অরূপ চলে যেতে বললেন, “ও কলেজে আমার ছাত্র ছিল, এখন আনন্দবাজারের জেনেরাল ম্যানেজার। নেশা হল গান।”
এরপরে অরূপবাবু ও আমজাদভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয় এক মনোরম আড্ডায়, গ্র্যান্ড হোটেলে সরোদশিল্পীর সুইটে। আমজাদ অনুষ্ঠান করতে এসেছিলেন শহরে এবং থাকছিলেন গ্র্যান্ডে। সাতাশ বছরের জন্মদিন পালন করতে দুর্দান্ত বাজিয়েছিলেন, তারপরের সন্ধ্যায় বাবলুদাকে নেমন্তন্ন করেছিলেন একটু ড্রিঙ্ক এবং আড্ডার জন্য। আমজাদভাই না অরূপ, কে আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য বলেছিলেন বলতে পারব না। তবে আমি প্রেসিডেন্সিতে ডঃ অমল ভট্টাচার্যের নেওয়া টি এস এলিয়টের ‘দ্য সেক্রেড উড’-এর ক্লাস শেষ করে বাড়ি ফিরতেই বাবলুদার ফোন পেলাম, “শোনো, পনেরো মিনিটের মধ্যে এসে যাও, আমজাদ নেমন্তন্ন করেছে গ্র্যান্ডে। ভাল স্কচ হবে, মিস কোরও না।”
আমজাদ, অরূপের সঙ্গে আড্ডা, সঙ্গে স্কচ— এ তো গরিবের কপালে মোহর বৃষ্টি। সাত তাড়াতাড়ি ড্রেস চেঞ্জ করে মা-কে পেন্নাম ঠুকে বেরিয়ে পড়লাম। আর গ্র্যান্ডের সুইটে প্রথম যে-দৃশ্যটা দেখলাম তাতে মনটা প্রায় উথালপাথাল হতে থাকল। স্নান সেরে সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবিতে ধবধবে সাদা বিছানায় বসে আমজাদভাই, আর ওঁর সামনে রাখা ইন্ডিয়া কিংসের কুড়ির প্যাকেট! চারমিনার ফুকে ফুকে হাল্লাক আমার কাছে তখন ইন্ডিয়া কিংস স্বর্গের সোনার সিঁড়ি। পরে যে ডিম্পল স্কচ আসবে সে চিন্তা মাথাতেই নেই। আমরা গিয়ে বসতেই অরূপ ফোন তুলে ড্রিঙ্কস অর্ডার করতে লাগলেন, আর একটা ইন্ডিয়া কিংস শেষ হতে না হতে নতুন একটা বাড়িয়ে দিতে লাগলেন। খাওয়ানো-দাওয়ানোয় অমন একটা উদার প্রাণ খুঁজে পাইনি আজও। ড্রিঙ্কস, ফুড আর সিগারেট তখন ওঁর ‘language of friendship’.

গানের সঙ্গে সঙ্গে গানের কথা এল। তর্ক শুরু হল, কে বড়? রবিশঙ্কর না বিলায়েত? তর্ক করছে কারা? না, উস্তাদ আমজাদ আলি খান, প্রফেসর/পণ্ডিত সুব্রত রায়চৌধুরী আর অরূপ সরকার। তাল ঠুকতে হচ্ছে আমাকেও কারণ আমি রবিশঙ্করভক্ত, ওঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছি, আর বিলায়েত খাঁ-র মেহের আলি লেনের বাড়িতে দীর্ঘদিনের যাতায়াত। একটু আগেই এই আড্ডাকে মনোরম বলেছি, কারণ যতই বিতর্ক হোক, বিষয়টা তো গান। আর গান নিয়ে এত গুরুতর কথা, এত চুলচেরা বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা কে কবার শুনতে পায়? আমজাদভাই আর অরূপবাবু (ততদিনে জানা হয়ে গেছে রবিশঙ্করের রাগদারি, রাগরূপায়ণে কত মুগ্ধ ভদ্রলোক) লড়ে যাচ্ছেন বিলায়েত খাঁ-র হয়ে আর বাবলুদা ও এই সামান্য আমি লড়ছি রবিশঙ্করের জন্য। ওঁরা বিলায়েতের তানের কথা বলছেন তো আমরা রবিশঙ্করের আলাপের কথা বলছি। ওঁরা খাঁ সাহেবের গায়কি অঙ্গের কথা বলছেন তো আমরা সুরশৃঙ্গার থেকে বয়ে আসা পণ্ডিতজির জোড় অঙ্গের কথা বলছি, ওঁরা বিলায়েতের সুরিলাপন নিয়ে বলছেন তো আমরা রবিশঙ্করের রাগবিস্তার নিয়ে বলছি…।
এইভাবে চলতে চলতে একসময় আমরা আবিষ্কার করলাম আমরা চারজনই ও দুই মহারথীর সমান অনুরাগী। ঠিক যেমন ভরসন্ধ্যায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে বাবলুদা আর আমি তর্ক করতে করতে দল পাল্টে ফেলতাম নিজেদের অজান্তেই। সেদিন রাতে বাড়ি ফিরতে ফিরতে বাবলুদা একটা অপূর্ব কথা বলেছিলেন যা আজও ভুলিনি। ইন্ডিয়া কিংসের একটা লম্বা ধোঁয়া ছেড়ে বলেছিলেন, “জানো শঙ্কর, তর্ক না করে গানবাজনা বোঝা যায় না, ভালোবাসাও যায় না।” এই কথাটারই একটা অসাধারণ প্রতিধ্বনি শুনেছিলাম এর বছর দশেক পরে রবিশঙ্করের বলা একটি বাক্যে। লন্ডনে ওঁর সঙ্গে ‘রাগ-অনুরাগ’-এর কাজ করতে করতে কী একটা বিষয়ে ওঁর সঙ্গে তর্ক জুড়েছিলাম। পরে তাতে লজ্জা পেয়ে বলেছিলাম, “সরি রবুদা, কিছু মনে করলেন না তো?” উনি তখন হেসে আমার পিঠে মৃদু চাপড় দিয়ে বলেছিলেন, “না রে বাবা! I like you the most when you put the hard questions. ওটাই তো শেখার রাস্তা। শেখানোরও। বাবা (আলাউদ্দিন খাঁ সাহেব) বলতেন, বুঝে গেছি ভাবলে আর শিখবে কী? শিখতে শিখতেই বোঝা চলবে।” (চলবে)
*পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ১৬ অগস্ট ২০২২
*ছবি সৌজন্য: Times of India, Discogs, Youtube
শংকরলাল ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট, কলকাতায়। ইংরেজি সাহিত্যে স্বর্ণপদক পাওয়া ছাত্র শংকরলাল সাংবাদিকতার পাঠ নিতে যান প্যারিসে। তৎপরে কালি-কলমের জীবনে প্রবেশ। সাংবাদিকতা করেছেন আনন্দবাজার গোষ্ঠীতে। লিখেছেন একশো ত্রিশের ওপর বই। গল্প উপন্যাস ছাড়াও রবিশংকরের আত্মজীবনী 'রাগ অনুরাগ', বিলায়েৎ খানের স্মৃতিকথা 'কোমল গান্ধার', হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিমালা 'আমার গানের স্বরলিপি'-র সহলেখক। অনুবাদ করেছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা থেকে সত্যজিৎ রায়ের চিত্রনাট্য পর্যন্ত।