নোবেল পুরস্কার ঘোষণার পরে সবার প্রথমে ফোন পাই এক বন্ধুর কাছ থেকে। আমি তখন ধর্মতলায়। একটা বাসের পাদানিতে দাঁড়িয়ে কোনও মতে ঝুলছি, কবীর সুমনের ‘ডানপিটে’ গানটার মতো। ‘হ্যালো’ বলার পরেই শুনলাম উচ্ছ্বসিত এক গলা। ‘অ্যাই, বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় নোবেল পেয়েছে শুনেছিস? তুই তো খুব শারদীয়া কিনিস। দু’তিনটে দে না রে প্লিজ। ওনার লেখা পড়ে দেখব। প্লিজ প্লিজ।’ আমি কিছুই জানি না তখন। বললাম, ‘তুই শিওর?’ কন্ডাক্টর ইতিমধ্যে ‘টিকিট টিকিট’ করে হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছে আঁকশির মতো। বন্ধুটা বলল, ‘হ্যাঁ। একদম। কিন্তু হোয়্যাটসঅ্যাপে আমায় কে একটা বলল, অর্থনীতি নিয়ে নাকি একটা ভাল উপন্যাস আছে ওনার। তোর কাছে ওই বইটা হবে?’

একই সময়ে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় আর অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুই পরম প্রাপ্তিতে আমাদের মনে সত্যিই আনন্দ আর ধরে না। মুম্বইতে ক্রিকেট বোর্ডের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পরের দিন, ১৫ই অক্টোবর মহারাজ যখন কলকাতা বিমানবন্দরে নামলেন, রাজকীয় অভ্যর্থনা হল। রাজপথে বাজি ফাটল। এর পরে ইডেনে লাল কার্পেট হল। অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের হয়তো এত কিছু রাজসূয় যজ্ঞ কপালে নেই। রেকর্ড বলে, অমর্ত্য সেনের সেমিনারের থেকে আজও সিরিয়ালের হাসি-রাশিকে দেখতে বেশি ভিড় হয়। বাঙালি রাজত্ব ও কৌলীন্যের মরা গাঙে তবুও তো অভিজিৎবাবু এক-দু’দিনের দিনের হিরো। নোবেল প্রাপ্তিতে আজ খবরের কাগজের পাতায় পাতায় তিনি। স্থলে, পাতালে, বাসে, মেট্রোয় সবার মুখে মুখে আজ নতুন নোবেলজয়ীর কথা। ভাল মানুষের ভাল গুণগুলো সবাই আমরা নিজেদের মতো করে আপণ করে নিই। কাগজে পড়লাম, হাতের লেখা খারাপ হওয়ার জন্য নাকি গার্জেন কল হয়েছিল সাউথ পয়েন্টের ছাত্র অভিজিৎ-এর। এক মেট্রো যাত্রীর কথায়, ‘মেয়েটার হাতের লেখা নিয়ে প্যারেন্ট-টিচার্স মিটিংয়ে যা তা বলল লাস্ট উইকে। মুখের মতো জবাব দেব এ বার।’ কিশোর অভিজিৎ ফুটবল খেলতেন। ক্রিকেট খেলতেন। ‘তখন কম্পিটিশন অনেক কম ছিল। আজকের যুগে পড়ার যা চাপ, ওস্সব খেলে টেলে অ্যাওয়ার্ড পাওয়া যায় না।’ জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় দশ দিনের জন্য জেল খেটেছেন যুবক অভিজিৎ। উপাচার্যের বাড়ি ঘেরাও করার অপরাধে ঠাঁই হয়েছিল তিহার জেলে। ‘বেশ করেছে বাবুলকে মেরেছে। আমাদের যাদবপুর কম যায় কীসে? ভাল ছেলেরা কি এ রাজ্যে নেই নাকি?’ ভোটের আগে কংগ্রেস যে ‘ন্যায়’ প্রকল্পটাকে ভোট টানার তুরুপের তাস করেছিল, খবরে পড়লাম, তাতে নাকি অভিজিৎ পরামর্শ দিয়েছিলেন প্রতিটা গরিব পরিবারকে সরকারের তরফে মাসে আড়াই হাজার টাকা করে দেওয়ার কথা বলা হোক। মেট্রো রেলে সত্তর ছুঁই ছুঁই এক রাশভারী ভদ্রলোক সিনিয়র সিটিজেন সিটে বসে নাকের উপরে চশমা তুলে বললেন, ‘কে বলেছিল আড়াই হাজারটাকে ছ’হাজার করতে? নোবেল লরিয়েট বলেছে যখন, কিছু হিসেব করেই তো বলেছে। রাহুল বেশি বোঝে। এবারে টের পাচ্ছ তো?’ অভিজিতের স্ত্রী এসথার ডুফলো সমুদ্র ভালোবাসেন না। তিনি কোনও এক সময় বলেছিলেন, যদি তিনি কখনও সমুদ্রের ধারে যেতেনও, তা হলে দুটো অর্থনীতির বই নিয়ে যেতেন, যাতে বসে পড়তে পারেন। ‘এ মা, এ কী কথা। এটা কি করে উনি বলতে পারলেন? অভিজিৎবাবুকে দেখলে বলতাম, বৌদিকে নিয়ে একবার পুরী ঘুরে আসুন। ঢেউ দেখে আর বই পড়তে ইচ্ছে করবে না স্যার। হে হে।’ এর পাল্টা যুক্তি হিসাবে উড়ে এল, ‘ব্রিলিয়ান্ট লোকেরা সমুদ্র একদম লাইক করেন না। আইনস্টাইন, নিউটন, ডিরোজিও, লর্ড ক্লাইভ সবাই পাহাড়ে যেতে ভালবাসতেন। নেটে পড়েছি।’

কলকাতা সত্যিই ডগমগ। দেশের একটা মাত্র শহর থেকে নোবেল পুরস্কারের দুই নয়, তিন নয়, ওভার বাউন্ডারি হল এ বার। একেবারে ছক্কা। তামাম ভারতে এমন নজির, এমন গর্ব আর কোনও শহরের নেই। স্যার রোনাল্ড রস ১৯০২ সালে চিকিৎসাশাস্ত্রে নোবেল পান। ম্যালেরিয়ার জীবাণু আবিষ্কার করেছিলেন। মানুষের শরীরে সেই জীবাণুর সংক্রমণ বিশ্লেষণ করেছিলেন। কলকাতার নোবেল-যোগের শুরু তখনই। এর পর ঠিক চার বছরের অপেক্ষা। ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার পর একে একে সি ভি রমন, মাদার টেরিজা, অমর্ত্য সেন। আর এ বারে অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। 

মুশকিলটা হল, যত কথা শুনছি অভিজিৎবাবুকে নিয়ে, তার মধ্যে সিকিভাগও শোনা গেল না তাঁর কাজ নিয়ে, অন্তত আম আদমির মুখে। বাঙালি নোবেল পেয়েছে, একের পর এক পেয়েই চলেছে, প্রাপ্তিভরা হাঁড়ি থেকে চলকে পড়ছে আহ্লাদ রস, কিন্তু কীসের জন্য নোবেল এই নিয়ে কারও কোনও মাথাব্যথা নেই। পুওর ইকনমিক্স আবার কি? রান্ডামাইজ কন্ট্রোল ট্রায়ালটা খায় না মাথায় দেয়? একে তো ছোট করে আবার আরসিটি বলা হয়। ‘আরে, আরসিটি মানে তো এত দিন জানতাম রুট ক্যানেল ট্রিটমেন্ট। তা হলে কি এটার সঙ্গে আবার ইকনমিক্সের যোগ আছে? কোন সাবজেক্ট যে কোথায় মিশছে। এগুলো আসলে সব গ্লোবালাইজেশনের এফেক্ট, দাদা।’ 

অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নোবেল জয়ের সারমর্ম হিসাবে একটা জিনিস আমরা বুঝে ফেলেছি। যতটুকু বুঝলে আমাদের সুবিধা হয়, তর্কের ঝালাতে যাওয়ার আগে আলোচনার আলাপটা শুরু করে ফেলা যায়, ঠিক ততটুকু। তা হল, বড়লোকদের হাতে বেশি টাকা থাকা আর গরিব লোকদের হাতে কম টাকা থাকা নিয়ে অভিজিৎবাবু এবং তাঁর স্ত্রীর খুব আপত্তি। শুধু বড়লোকদের দিকে নজর দিলে যে চলবে না, তা সরকারকে বুঝতে হবে। গরিবদের হাতে টাকা বাড়লেই আসলে দেশের মঙ্গল, দশের মঙ্গল। হক কথা বলেছেন বলেই তো নোবেল। অত সব তত্ত্ব টত্ত্ব পড়ার সময় আছে কার আজকের যুগে? এই কথাটাও হঠাৎ করে উড়ে এল চিড়িয়ামোড়ে, বাসে, আমার পাশের সিটে বসা ভদ্রলোকের থেকে। ‘গরিবের হাতে টাকা এলে যে দেশের ভাল হয়—এ আর নতুন কথা কি? এর জন্য নোবেল? নোবেল পাওয়া উচিৎ ছিল কিশোরকুমারের। গুরুদেব, গুরুদেব।’

সত্যি কথা বলতে কি, একমাত্র গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছাড়া আমরা কেউ জানতেই চাইলাম না, এ শহরে শিকড় রাখা মানুষগুলো নোবেল পেলেন কেন। বিশ্বকবি মানে তো বিশ্বের কবি। গান, নাটক, গল্প, কবিতা লিখে নোবেল পেলেন গীতাঞ্জলির জন্য। বাচিক শিল্পীরা বলেন, আমাদের শয়নে স্বপনে জীবনে মরণে আনন্দে রোদনে রবীন্দ্রনাথ। এর পরে যাঁর নোবেল নিয়ে একটু একটু জানি, তিনি মাদার টেরিজা। সবার শান্তি চাইতেন। তাই নোবেল। ওনাদের ভাগ্য প্রসন্ন। অন্তত কোন বিষয়ের জন্য নোবেল পেয়েছিলেন, আমরা তার খবর রাখি। স্যার চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামনের কথা ভাবুন। তিনি কে ছিলেন তাই তো মনে পড়ে না আর। ‘উনিও নোবেল পেয়েছিলেন না?’ হলফ করে বলতে পারি, একমাত্র ‘লাইনের লোক’ না হলে রামন সাহেবের সাবজেক্টটা কী ছিল তা জিজ্ঞেস করলে দশ জনের মধ্যে আট জনই মাথা চুলকোবেন। রামন এফেক্ট তো দশ হাত দূরের ব্যাপার। অমর্ত্য সেনের নোবেলপ্রাপ্তিও অর্থনীতিতে। ওনার বিষয়টাও বড্ড খটমট। ডেভেলাপমেন্টাল ইকনমিক্স। বাংলা করলে দাঁড়ায় কল্যাণমূলক অর্থনীতি। রাম শ্যাম যদু মধুর তো সাধারণ, ফালতু লোকেদের কথা তো বাদই দিন। সম্প্রতি এক তাবড় জনপ্রতিনিধিও রেগে গিয়ে প্রকাশ্যে গর্জেছিলেন, উনি (অধ্যাপক সেন) কী করেছেন তা বাংলার কেউ বোঝে না। দুনিয়ার কেউ বোঝে না। উনি নিজেও বোঝেন কি না সন্দেহ আছে। জননেতার দাবি ছিল, অমর্ত্য দেশের কোনও উপকারেই লাগেননি। কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও নীতির সমালোচনা করার ফল হিসেবে যে এমন সার্টিফিকেট মিলতে পারে, তা স্বয়ং অমর্ত্য সেনও হয়তো ভাবেননি কখনও। অভিজিৎবাবুও দিল্লির সমালোচনা শুরু করেছেন। তাঁর জন্য কী বাক্যবাণ অপেক্ষা করে আছে সময় জানে। 

বাঙালি নোবেলজয়ীদের দিয়ে আমাকে করা দুটো প্রশ্ন হজম করতে পারিনি আজও। প্রশ্ন এক। এই নোবেলজয়ী বাঙালি হলেও এপার বংলার নন। মহম্মদ ইউনুস। প্রশ্নটা ছিল, বাংলাদেশে গ্রামীণ ব্যাঙ্ক আর ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে কাজ করা সত্ত্বেও উনি শান্তিতে নোবেল পেয়েছিলেন কেন? অর্থনীতির কোটা কি ফুল হয়ে গিয়েছিল সে বার? প্রশ্ন দুই। এটা করেছিল জগাদা। আমাদের ফ্ল্যাটবাড়িতে ফি সন্ধেতে দুটো করে দুধের পাউচ দিত। মাদার টেবিজা প্রয়াত হলেন যে দিন, সে দিন সন্ধেবেলা দুধ দিতে এসে ঈষৎ গোমড়া মুখে জগাদা জানিয়েছিল, কাল সাপ্লাই বন্ধ থাকতে পারে। মালিক মারা গিয়েছেন।
জগাদা মাদার ডেয়ারি দিত।   

অম্লানকুসুমের জন্ম‚ কর্ম‚ ধর্ম সবই এই শহরে। একেবারেই উচ্চাকাঙ্খী নয়‚ অল্প লইয়া সুখী। সাংবাদিকতা দিয়ে কেরিয়ার শুরু করলেও পরে জীবিকার খাতবদল। বর্তমানে একটি বেসরকারি সংস্থায় স্ট্র্যাটেজি অ্যানালিস্ট পদে কর্মরত। বহু পোর্টাল ও পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। প্রকাশিত হয়েছে গল্প সংকলন 'আদম ইভ আর্কিমিডিস' ও কয়েকটি অন্য রকম লেখা নিয়ে 'শব্দের সার্কাস'।

2 Responses

  1. টাকা দিয়ে মানুষের সমস্যার সমাধান করা যায় না। একটা গ্রামে কুবেরের সমস্ত ধন ঢেলে দিয়েও সেই গ্রামের মানুষেদের সুখী করা যাবে না। তাদের আসল শিক্ষা দিতে হবে যাতে ভালোটা মন্দটা বুঝতে পারে। ফ্রিতে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। বড়ো বড়ো তত্ত্ব লেখার লোকের অভাব নাই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *