আগের পর্ব- ঈশ্বর: পর্ব ১  ঈশ্বর: পর্ব ২ ঈশ্বর: পর্ব ৩ 

অতুল: যা চাই তাইই দেবেন? তারপর ওই অমিত মুখার্জির মত আমিও যদি আপনাদের সর্বস্ব নিয়ে পালিয়ে যাই?

 (দরজা ঠেলে এক বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা প্রবেশ করেন।) 

বৃদ্ধ: এটাই কি অতুলানন্দ মহারাজের আশ্রম? 

মৃণাল: কে আপনারা? কী চান? এপয়েন্টমেন্ট করেছেন? 

বৃদ্ধা: ওই তো, ওই তো আমার অমিত।  কোথায় ছিলি বাবা অমিত, মাকে ছেড়ে কোথায় ছিলি এতদিন? 

মৃণাল: আপনি ভুল করছেন। উনি অমিত নন, উনি শ্রীমৎ স্বামী অতুলানন্দ মহারাজ। 

বৃদ্ধা: না না, এই আমার অমিত। আমার ছেলে অমিত। 

অতুল: মৃণাল, ওনাকে আসতে দাও। আসুন মা। বসুন। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি শ্রান্ত। আপনার বিশ্রামের প্রয়োজন। মৃণাল ওনার জন্য এক গেলাস জল এনে দাও। 

বৃদ্ধা: তুই আমাকে চিনতে পারছিস না অমিত? আমাকে চিনতে পারছিস না? আমি তোর মা। ভাল করে দেখ। 

অতুল: আপনি ভুল করছেন। আমি অমিত নই। আমি অতুলানন্দ। 

বৃদ্ধ: তুমি অতুলানন্দ? কথাটা বলতে তোমার লজ্জা করছে না? যে গর্ভধারিণী মা তোমাকে জন্ম দিয়েছেন, তোমাকে লালন করেছেন, তুমি তাকে চিনতে পারছ না? বলছ ভুল করছেন? ছিঃ! চলে এস পরমা। তোমাকে আমি আগেই সাবধান করেছিলাম। যে একবার চলে গেছে সে আর কোনওদিন ফিরে আসবে না। 

বৃদ্ধা:  না না, তা হতে পারে না। আমার অমিত ফিরে আসবে। নিশ্চয়ই ফিরে আসবে। কিরে ফিরবি না? আমি এতটা পথ পেরিয়ে এসেছি তোকে ফিরে পেতে, তুই ফিরবি না? 

অতুল: কেন আপনারা আমাকে বার বার অমিত বলছেন? আমি অমিত নই। আমি অমিত বলে কাউকে চিনি না। আপনারা আমাকে বিশ্বাস করুন। 

মৃণাল: কেন আপনারা মহারাজকে বিরক্ত করছেন। উনি এখন ব্যস্ত আছেন। এপয়েন্টমেনট ছাড়া উনি কারও সঙ্গে দেখা করেন না। তবু আমি ওনার সঙ্গে কথা বলে একটু সময় বার করব। আপনারা বাইরে অপেক্ষা করুন। আসুন আমার সঙ্গে। 

বৃদ্ধ: চুপ করুন! এপয়েন্টমেন্ট ছাড়া দেখা করেন না? আপনি জানেন আমরা কতদূর থেকে এসেছি? এই বৃদ্ধা, ওঁর মা, ভাল করে হাঁটতে পারেন না। হাঁপানির রুগী। ছেলেকে দেখবেন বলে সব কষ্ট সহ্য করে এখেনে এসেছেন। আর আপনি বলছেন উনি ব্যস্ত আছেন? শুনুন, মুখে রক্ত তুলে উপার্জন করে ওঁকে মানুষ করেছি। পড়াশুনা করিয়েছি। বিদেশে পাঠিয়েছি। স্বপ্ন ছিল, ছেলে মস্ত বিজ্ঞানী হবে। দেশের নাম উজ্জ্বল করবে। বাপ মায়ের গর্ব হবে। তাদের বৃদ্ধ বয়সের সাহারা হবে। কিন্তু কী হল?  সেই অপগণ্ড ছেলে তার সমস্ত দায়িত্ব বিসর্জন দিয়ে সন্ন্যাসী হয়ে পালিয়ে গেল। ছেলে এখন প্রমুখ স্বামী অতুলানন্দ মহারাজ হয়ে দুধ ঘি খাচ্ছেন, আর আমরা বুড়ো বুড়ি অর্ধাহারে অনাহারে আমাদের জীবন কাটাচ্ছি। অমন ছেলে হওয়ার চেয়ে না হওয়া ভাল ছিল। 

বৃদ্ধা: অমন কথা বলও না গো। অমিত ঠিক ফিরবে। ও আবার ফিরে এসে সংসারের হাল ধরবে। ফিরবি না অমিত? বল না, ফিরবি না? 

অতুল: মা, আমাকে ক্ষমা করবেন। ঈশ্বরের সেবায় আমি আমার জীবন নিয়জিত করেছি।  আমি জানি না আপনার ছেলে অমিত কোথায়, কিন্তু আমি আর কোনওদিন সংসারে ফিরে যেতে পারব না।  আপনারা ফিরে যান। 

বৃদ্ধ: পরমা, তোমার গুরুদেব বলেছিলেন, তোমার কপালে পুত্রশোক আছে। কথাটা কেমন অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেল দেখলে? কিন্তু কি জানো, আমার ছেলে যদি রোগে ভুগে কিম্বা কোনও দুর্ঘটনায় মারা যেত, আমার এতোটা আফসোস হত না। যে আমি চিরকাল বামপন্থী রাজনীতি করে এসেছি, ঈশ্বর বলে কাউকে বিশ্বাস করিনি, সেই আমার সন্তান শেষে কিনা এক ভণ্ড সাধু হল? ঈশ্বর, ভগবান, ধর্ম, এই সমস্ত মিথ্যে প্রচার করে লোক ঠকানোর ব্যবসা ধরল? ছি ছি ছি। এ লজ্জা, এ অপমান আমি রাখব কোথায়? 

অতুলানন্দ: ঈশ্বর মিথ্যে? ধর্ম মিথ্যে? 

বৃদ্ধ: অবশ্যই মিথ্যে! ঈশ্বর নামের এক মিথ্যেকে ব্যবহার করে কিছু ঠগ মানুষকে বোকা বানিয়েছে আর তাদের শোষণ করেছে। ধর্মের নেশায় তাদের অন্ধ করে তাদের দিয়ে নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধি করিয়েছে। আর এখন তুমিও তাই করছ।  Religion is the opium for the masses – কার্ল মার্ক্স কথাটা মিথ্যে বলেন নি। মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে সেই ওপিয়াম তুমি এখন তোমার ভক্তদের পরিবেশন করছ।  

অতুলানন্দ: ভুল! ভুল বলছেন আপনি। ঈশ্বর বিশ্বাস মানুষকে শক্তি জুগিয়েছে। মানুষকে সহনশীল করেছে, দয়ালু করেছে। 

বৃদ্ধা: রাগ করিস না খোকা। তুই তো জানিস তোর বাবা নাস্তিক, ভগবান মানে না। তুই ফিরে চল, দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। 

বৃদ্ধ: আমার আগেই বোঝা উচিৎ ছিল। মর্নিং শোজ দ্য ডে। তোমার মনে পড়ে, অমিতের তখন দশ এগার বছর বয়স হবে। আমরা দার্জিলিং বেড়াতে গিয়েছিলাম। অমিত রাস্তার ধারের দোকানদার দের সকলকে বুঝিয়েছিল ওর বাবা পুলিশের বিরাট অফিসার। রাস্তার ধারের সমস্ত দোকান তুলে দেবে ওর বাবা। ও বাবাকে বলে ওদের দোকান বাঁচিয়ে দিতে পারে যদি ওরা ওকে যথোপযুক্ত দক্ষিণা দেয়। ভয়ে সেই ব্যবসাদার গুলো যে যা পেরেছিল, উজাড় করে দিয়েছিল। কেউ খাবার, কেউ খেলনা, কেউ টাকা। ছি ছি, কি লজ্জা কি লজ্জা।

বৃদ্ধা: খবর পেয়ে কি শাসনটাই করেছিলে তুমি। ওইটুকু ছেলেকে কি মার মেরেছিলে। 

বৃদ্ধ: কোনও লাভ হয়নি পরমা, কোনও লাভ হয়নি। সেই ছোট্ট বয়স থেকেই লোক ঠকানোর খেলায় মেতে উঠেছিল তোমার ছেলে।  তখন বাবার ভয় দেখিয়ে মানুষের কাছ থেকে পয়সা লুটেছে, এখন ঈশ্বরের ভয় দেখিয়ে পয়সা লুটছে।  

অতুল: চুপ করুন! আপনি চুপ করুন।  আপনি ভুলে যাচ্ছেন আপনি কোথায় দাড়িয়ে কথা বলছেন।

বৃদ্ধা: হ্যাঁ তুমি চুপ কর। কেন সবার সামনে এই সব কথা বলছ? অমিত তোমার নিজের সন্তান। ওর অপমান মানে তো তোমারও অপমান। 

বৃদ্ধ: যে নিজের পিতা মাতা কে দারিদ্র্যের মুখে ঠেলে দিয়ে পালিয়ে যায়, তারপর সন্ন্যাস নেবার আছিলায় বিলাসব্যসনের জীবন যাপন করে, মিথ্যে আশ্বাস জুগিয়ে মানুষকে ভুল পথে চালনা করে, তাদের বিভ্রান্ত করে, বিপথগামী করে,  তাকে আমার সন্তান বলে মেনে নিতে আমার ঘেন্না হয়। 

অতুলানন্দ: আপনি চলে যান। এখুনি এখান থেকে বেরিয়ে যান। 

বৃদ্ধ: নিশ্চয়ই যাব। (ভক্তদের উদ্দেশ করে) কিন্তু যাবার আগে আপনাদের সাবধান করে যাই। সময় থাকতে আপনারা এখান থেকে পালান। যে বিষ এই লোকটা আপনাদের পান করাচ্ছে, খুব শীঘ্র সেই বিষ আপনাদের স্বাধীন চিন্তাশক্তি বিলুপ্ত করবে। আপনাদের বোধশক্তিহীন অমানুষ করে তুলবে সেই বিষ। এই লোকটা, যে এককালে আমার ছেলে ছিল, অত্যন্ত মেধাবী ক্ষুরধার বুদ্ধিসম্পন্ন ছিল, বিজ্ঞানের ছাত্র ছিল, যুক্তিবাদী ছিল, সে এখন পৃথিবীর প্রাচীনতম বৃত্তি বেছে নিয়েছে – হ্যাঁ বেশ্যাবৃত্তির চেয়েও প্রাচীন – ধর্ম যাজকের বৃত্তি। যে বৃত্তির একটাই ধর্ম, মানুষকে অন্ধ করে রাখা। পালান, সময় থাকতে পালান। চল পরমা। 

(বৃদ্ধার হাত ধরে বৃদ্ধ বেরিয়ে যেতে উদ্যোগী হন) 

অতুল: মৃণাল বার করে দাও এই বুড়ো বুড়িকে। আর কোনওদিনও যেন দেখতে না পাই। এত বড় আস্পর্ধা – আমাকে অপমান করে?   

বৃদ্ধা:nরাগ করিস না খোকা। রাগ করিস না। আমরা চলে যাচ্ছি। তুই ভাল থাকিস। আমরা চলে যাচ্ছি। 

(বৃদ্ধ বৃদ্ধা বেরিয়ে যান) 

সুদীপ্ত ভৌমিক একজন প্রতিষ্ঠিত নাট্যকার, নির্দেশক ও অভিনেতা। ওঁর নাটক অভিবাসী জীবনের নানা দ্বন্দ ও সংগ্রামের কথা বলে। সুদীপ্তর নাট্যদল একতা (ECTA) উত্তর আমেরিকা ও পশ্চিমবঙ্গের নাট্যপ্রেমীদের কাছে এক পরিচিত নাম। ভাষানগর পুরস্কার, নিউ জার্সি পেরি এওয়ার্ড নমিনেশন, সিএবি ডিস্টিংগুইশড সার্ভিস এওয়ার্ড ইত্যাদি সম্মানে ভূষিত সুদীপ্ত ড্রামাটিস্ট গিল্ড অফ আমেরিকার পূর্ণ সদস্য। ওঁর পডকাস্ট স্টোরিজ অফ মহাভারত অ্যাপল আইটিউনস-এ শ্রেষ্ঠ পডকাস্টের স্বীকৃতি পেয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *