দাঁতের যত্ন নেওয়ার ক্ষেত্রে স্কেলিং একটি গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা পদ্ধতি। এই স্কেলিং করানো নিয়ে মানুষের মনে হাজারও প্রশ্ন রয়েছে। প্রায়ই রোগী ও বন্ধুদের এই সম্পর্কিত নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হই। আজ একে একে চেষ্টা করব সেইসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার।

১. স্কেলিং করাব কেন?
– স্কেলিং করানোর একাধিক কারণ বর্তমান। তবে মূল কারণ হল দুটি। এক, মাড়িকে সুস্থ রাখা ও দুই হাসিকে সুন্দর রাখা।

২. মাড়িকে সুস্থ রাখা বলতে? মাড়ি কীভাবে অসুস্থ হতে পারে?
– মাড়িতে নানাধরনের রোগ হতে পারে। যেমন – gingivitis, periodontitis ইত্যাদি। এর ফলে মাড়ি ফুলে যায়, দাঁতের থেকে ছেড়ে যায়, রক্ত পড়তে থাকে, দুর্গন্ধ বেরোয় ও দাঁতের হাড় ক্ষয়ে গিয়ে দাঁত আলগা হয়ে যায়। তাই মাড়িকে সুস্থ রাখতে স্কেলিং অপরিহার্য।

৩. তাহলে স্কেলিং সারাজীবনে কতবার করানো উচিত?
– বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা তথা WHO এর অনুমোদন অনুসারে, ৬মাস অন্তর স্কেলিং করানো উচিত। একান্তই সম্ভব না হলে, অন্তত প্রতিবছর একবার করে স্কেলিং করানো দরকার। এর ফলে একদিকে যেমন মুখের অণুজীবের পরিমাণ কমানো যায়, অন্যদিকে দাঁতের অন্যান্য সমস্যা থাকলেও তা চিহ্নিত করে দ্রুত চিকিৎসার রাস্তাও সুগম হয়।

৪. স্কেলিং করালে কি দাঁত সাদা হয়?
– না, স্কেলিং করালে দাঁত সাদা হয় না। প্রত্যেক মানুষের দাঁতের আলাদা আলাদা shade থাকে। স্কেলিং এর মাধ্যমে দাঁতের ওপর লেগে থাকা plaque (খাদ্যের অবশিষ্টাংশের ওপর ব্যাকটেরিয়া কলোনি স্থাপন করে), পাথর ও দাঁতের বাইরের স্তরের দাগ (সিগারেট, গুটখা, পান খাওয়ার ফলে যা তৈরী হয়) পরিষ্কার করা হয়। কিন্তু এর মাধ্যমে দাঁতের shade বদলানো হয় না।

৫. আচ্ছা, আমি শুনেছি, স্কেলিং করলে নাকি দাঁত ক্ষয়ে যায়। এটা কি সত্যি?
– এটা অর্ধসত্য। আমাদের মুখের লালায় ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম আয়ন থাকে, যার দ্বারা যদি স্কেলিং এর ফলে দাঁতের বাইরের স্তরের অতি সামান্য ক্ষয় হয়েও থাকে, তার ক্ষতিও পূরণ হয়ে যায়।

৬. বুঝলাম। কিন্তু স্কেলিং করালে তো দাঁত আলগা হয়ে যায়, নড়ে যায়। এটা তো ঠিক?
– না, এটাও ঠিক নয়। ভ্রান্ত ধারণা মাত্র। আমাদের দাঁতের একটা স্বাভাবিক মোবিলিটি থাকেই, যাকে physiological mobility বলা হয়। অনেক ক্ষেত্রেই দাঁতের পাথর জমে তার চাপে দাঁতের হাড় ক্ষয়ে যায়, সেক্ষেত্রে স্কেলিং এর পর দাঁত নড়ে যেতে পারে।

৭. তাহলে পাথরটাকে তো না সরালেই হয়।
– না, ভুল ধারণা। পাথরটা আদতে দাঁতকে সাপোর্ট দিচ্ছে না। বরং পাথরের চাপে একদিকে যেমন চোয়ালের হাড় (Alveolar bone) ক্ষয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে তেমনই এই পাথরটা নতুন করে plaque জমা হওয়ার স্থান রুপেও কাজ করছে। তাই দাঁতে পাথর জমলে তা সরানোই একমাত্র কর্তব্য।

৮. দাঁতে পাথর জমে কী করে?
– আগেই বলেছি, আমাদের থুতুতে নানাবিধ ধাতব আয়ন থাকে। যেমন – ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফেট, কার্বনেট ইত্যাদি। এগুলি দাঁতের প্লাকের ওপরে থিতিয়ে পড়তে থাকে ও ক্রিস্টাল তৈরী করে। এভাবেই দাঁতে পাথর জমে, একে Calculus বলে। দাঁতে পাথর জমলে অবশ্য কর্তব্য হল, নির্দিষ্ট সময় অন্তর ডাক্তারবাবুর মাধ্যমে তা পরিষ্কার করিয়ে নেওয়া। নাহলে দাঁতের হাড় ক্ষয়ে গিয়ে দাঁত আলগা এমনকি দাঁত পড়ে যাওয়ারও সম্ভাবনা থাকে।

৯. স্কেলিং করতে কি ব্যথা লাগে?
– দাঁত শিরশির করতে পারে কিছু ক্ষেত্রে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, লোকাল অ্যানাস্থেটিক স্প্রে দিয়ে করা হয়। ফলে ব্যথা লাগে না বললেই চলে।

১০. স্কেলিং কীভাবে করা হয়?
– বর্তমানে আল্ট্রাসোনিক পদ্ধতিতে স্কেলিং বহুল প্রচলিত। এটা একটি বিদ্যুৎ চালিত যন্ত্র, যার মাধ্যমে Scaling tip দিয়ে উচ্চচাপে জল ও বাতাসের সংমিশ্রণ দ্রুত গতিতে আসে, যা দাঁতের কোনও ক্ষতি করে না, কিন্তু দাঁতের বাইরের সারফেসে লেগে থাকা পাথর ও দাগকে বার করে দেয়।

১১. স্কেলিং কি একটা সিটিংএই হয়ে যায়?
– হতেও পারে, নাও হতে পারে। এটা সম্পূর্ণ নির্ভর করছে পেশেন্টের মুখের পরিস্থিতির উপরে।

১২. স্কেলিং করানোর আগে বা পরে কি ওষুধ খেতে হয়?
– স্কেলিং করানোর পরে সাধারণত যেকোনও একটি মাউথওয়াশ ও একটি মেডিকেটেড টুথপেস্ট প্রেসক্রাইব করে থাকি আমরা। ওষুধ খাওয়ার প্রয়োজনীয়তা সবক্ষেত্রে নেই। তবে কোনও কোনও ক্ষেত্রে প্রয়োজন হতে পারে। সেটা মূলত রুগীর মাড়ির অবস্থা ও অন্যান্য মেডিকেল হিস্ট্রির ওপর নির্ভর করছে।

১৩. স্কেলিং এর আগে বা পরে কোনও টেস্ট করাতে হয় কি? স্কেলিং কি যেকোনও মানুষ করাতে পারেন?
– রুগীর মেডিকেল হিস্ট্রির ওপর নির্ভর করছে, তার কোনও টেস্ট প্রয়োজন আছে, নাকি নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্কেলিং একটি নিরাপদ পদ্ধতি। তবে কিছু ক্ষেত্রে বেশ কিছু সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়।

১৪. যেমন?
– পেসমেকার বসানো রুগী, Infective endocarditis, প্রেগন্যান্ট, রক্তপাত জনিত সমস্যা আছে এরকম রুগীর ক্ষেত্রে কিছু সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। সেজন্যই রুগীর সাথে কথা বলে তার অন্যান্য মেডিকেল হিস্ট্রি জেনে নেওয়া হয়। প্রয়োজনে নির্দিষ্ট টেস্ট করাতে হতে পারে ও কনসালটেন্ট এর পরামর্শ নিতে হতে পারে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্কেলিং একটি অত্যন্ত নিরাপদ পদ্ধতি।

বিড়ি, সিগারেট, তামাক, জর্দা, গুটখা, পান এসব ত্যাগ করুন। সুস্থ থাকুন।

দ্য ডক্টরস ডায়লগ ওয়েব পোর্টাল থেকে পুনর্মুদ্রিত।

পেশায় দন্তচিকিৎসক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *