Demise of Shankha Ghosh
কবির কথাতেই কবিকে শেষ শ্রদ্ধার্ঘ্য। অলঙ্করণ: চিরঞ্জিৎ সামন্ত
শঙ্খ ঘোষ নেই। আজ সকালবেলা ঘুমের মধ্যেই চলে গেছেন তিনি।
আজ সকালবেলা?
আমার পাশ দিয়ে এই যে দুপুরের রোদ আস্তে-আস্তে এগিয়ে চলেছে এখন। মাঠের প্রান্তে একটু পরেই এসে দাঁড়াবে বিকেল। তারপর আরও ঘন হবে অন্ধকার। লতার আড়ালে-আড়ালে উঠে আসবে ঝিঁঝিঁডাক।
এই যে সম্পূর্ণ একটা দিন, তার মধ্যেই কিছুক্ষণ আগেও তো তিনি ছিলেন!
এখন আর কোথাও নেই।
নেই নেই নেই। এই না-থাকার অর্থ কোথায়? ‘জার্নাল’-এর ‘এই মুহূর্ত’ নামক লেখাটির প্রারম্ভেই শঙ্খ ঘোষ লিখেছেন:
‘এই একটি মুহূর্ত চলে গেল, এটা কখনোই ফিরবে না আর, মুহূর্তই মুহূর্তের শেষ। …এ-কথা জানি বলেই নিঃশেষে পেতে চাই একে, কোনোখানে ফাঁক না রেখে, ভবিষ্যতের জন্য কিছু ফেলে না রেখে।’
এখন যদি নিজের দিকেই তাকাই, তবে বলব, এই নিঃশেষে পাওয়ার অর্থ বোধহয় কেবল ফিরে তাকানো। ছুটে যাওয়া। তাঁর আজীবনের লেখার কাছে। যিনি একদিন বলেছিলেন: ‘আমার বেঁচে-থাকার অভিজ্ঞতাকেই কবিতায় বলি আর কবিতায় বলা জীবনটাকে ধরতে চাই বেঁচে থাকার মধ্যে…।’ বলেছিলেন এও: ‘সর্বগ্রাসী কবিতার মুহূর্ত তো কখনো কখনো সর্বত্যাগ চায়, সেই সময়ে সামাজিকতার চাপ বারে বারে তাকে ভ্রষ্টও করে দেয়।’
প্রশ্ন হল, এই ভ্রষ্ট হওয়ার মানে কী? নিজের লেখার সঙ্গে নিজেরই অসততা?
এখানে ‘নিজের’ কথাটি লেখামাত্র মনে হল, শঙ্খ ঘোষ ‘আদিম লতাগুল্মময়’ বইয়ে একদিন লিখেছিলেন এমনই একটি লাইন: ‘একা হও একা হও একা হও একা হও একা’।
‘আদিম লতাগুল্মময়’-এর প্রকাশকাল: ১৯৭২। আর, এর প্রায় ঊনচল্লিশ বছর পরে, ২০১১ সালে প্রকাশিত ‘হাসিখুশি মুখে সর্বনাশ’ বইয়ে পৌঁছে তিনি লিখলেন: ‘একার সঙ্গে মুখোমুখি হল একা।’
এরই সঙ্গে, অগ্নিখণ্ডের মতো আমার মনে উড়ে আসে সেই লাইন: ‘সিঁড়ি দিয়ে নেমে যেতে যেতে মনে রেখো পিছনে কী ছিল’। যে-কবিতার মধ্যপর্বে পৌঁছে আমরা দেখতে পাব:
অবসাদে ভরে আসে চোখ?
হোক, তবু তুমি তো সমস্তখানি নও
ততটা নিজস্ব পাবে যতখানি ছেড়ে দিতে পারো
কেউ এসে বসেছিল, কেউ উঠে চলে গেল, কেউ কথা বলেনি কখনো
মন তার চিহ্ন রাখে সবই।
এবং এ-কবিতার শেষ লাইনটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়:
‘জীবন তোমার কাছে দাবি করেছিল যেন প্রত্যেক মুহূর্তে তুমি কবি।’
ঠিক এইখানেই তুলে আনতে চাইব ‘কবিতার মুহূর্তে’-এর কয়েকটি লাইন। যেখানে শঙ্খ ঘোষ লিখছেন:
‘ভিড়ের মধ্যে থেকে কখনো একার কাছে, একার মধ্যে দিয়ে কখনো ভিড়ের কাছে, এপারে ওপারে যাওয়া-আসা করে মন।’

 

আরও পড়ুন: অবন্তিকা পালের কলমে: অলোকরঞ্জনের ঈশ্বর
এই-ই এসে পড়ল সেই অমোঘ শব্দটি: মন!
যে-মন, জীবনের সমস্ত অভিজ্ঞতায় নিচু স্বরে বলে যায়, ‘প্রত্যেক মুহূর্তে তুমি কবি’।
যে বলে, ‘একা হও একা হও একা হও একা হও একা।’
যার ধারণ-ক্ষমতায় এসে ধরা দেয় প্রতি মুহূর্তের অভিজ্ঞতার সমর্পণ, শঙ্খ ঘোষ যাকে বলছেন সর্বগ্রাসী কবিতার জন্য সর্বত্যাগ। এমন ত্যাগের কোনও ধারণা বা প্রস্তুতি কি আমার জীবনে আছে? নেই। কেবল তাঁর ছিল। তাঁর-ই ছিল। একটি লেখায় তিনি লিখছেন:
‘আমার তো মনে হয়, সমস্ত শিল্পই এই নিজেকে জানার শিল্প। কেননা, এক হিসেবে, নিজেকে জানার সম্পূর্ণতাই সকলকে জানারও পাথেয়।’
এই কথাগুলি খুঁজে পাওয়া যাবে তাঁর ‘মর্ত্য কাছে স্বর্গ যা চায়’ নামক প্রবন্ধে। ‘মর্ত্য কাছে স্বর্গ যা চায়’ তিনি লিখছেন ১৯৭৫ সালে। জানতে ইচ্ছে করে, এই সমসময়ে তিনি কী কবিতা লিখছেন? তিনি তখন লিখে চলেছেন ‘বাবরের প্রার্থনা’। লিখছেন, ‘জীবনবন্দী’, ‘হাতেমতাই’, ‘আপাতত শান্তিকল্যান’-এর মতো আশ্চর্য সব কবিতা। ‘তক্ষক’ নামের কবিতায় লিখছেন:
‘তোমার কোনো বন্ধু নেই তোমার কোনো বৃত্তি নেই
কেবল বন্ধন
তোমার কোনো ভিত্তি নেই তোমার কোনো শীর্ষ নেই
কেবল তক্ষক…’
অথবা, ওই একই সময়, তিনি লিখছেন সেই অবিস্মরণীয় লাইন:
‘শূন্যতাই জানো শুধু? শূন্যের ভিতরে এত ঢেউ আছে
সেকথা জানো না?’
এবার, এই সমস্ত কবিতার লাইনের পাশে আমরা যদি ‘মর্ত্য কাছে স্বর্গ যা চায়’ প্রবন্ধের ওই কথাগুলি তুলে এনে রাখি, তাহলে হয়তো কিছুটা বুঝতে পারব তাঁর মনের অন্তর্ভূমির সেই সূর্যসম বিকিরণকে। হয়তো বুঝতে পারব ‘সমস্ত শিল্পই এই নিজেকে জানার শিল্প’— কথাটি কতদূর সত্য ছিল তাঁর কাছে।
শঙ্খ ঘোষের প্রথম কবিতার বই ‘দিনগুলি রাতগুলি’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫৬ সালে। আর, এখনও পর্যন্ত তাঁর শেষ প্রকাশিত কবিতার বই ‘সীমান্তবিহীন দেশে দেশে’ বেরিয়েছে মাত্র এক বছর আগে, ২০২০ সালে। এই চৌষট্টি বছরের ব্যবধানে ধরা রয়েছে তাঁর সমগ্র কবিতা-জীবন, এবং পঁচিশটি কবিতার বই। তার পাশেই রয়েছে তাঁর একাদশ খণ্ড গদ্যসংগ্রহ। যেখানে আমরা দেখতে পাই ‘শব্দ আর সত্য’, ‘নিঃশব্দের তর্জনী’, ‘নির্মাণ আর সৃষ্টি’, ‘কবির অভিপ্রায়’, ‘কবিতার মুহূর্ত’, ‘উর্বশীর হাসি’, ‘এ আমির আবরণ’ এবং ‘জার্নাল’-এর মতো এমন আশ্চর্য সব বই।
আমরা জানি, তিনি পছন্দ করতেন না কোনো কোলাহল। আর, ঠিক তা-ই হল। যাঁর শেষ-যাত্রায় পথে-পথে ভেঙে পড়বে জন-সমুদ্র, রাজার মতো যাঁকে বিদায় দেওয়ার কথা, মারণ-ব্যাধি জন্য তাঁর সেই অন্তিম-যাত্রাটিও আমরা দেখতে পেলাম কই?
নির্জনে, একা-একা, চলে গেলেন তিনি।    

 

আরও পড়ুন: জয় গোস্বামীর কলমে: শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা- অবচেতনের উদ্ধার
কণা-সামান্য আড়ম্বর কিংবা প্রাচুর্যের বদলে যে-জীবনের ভেতর তিনি সর্বক্ষণ বেঁচে রইলেন, সেই জীবনের একপ্রান্তে দাঁড়িয়েছিল এই দেশ-কালের প্রতি তাঁর সচল বিবেক, এবং যার অন্য প্রান্তে সবসময়য় জাগ্রত ছিল একজন কবির অন্তরের সৃষ্টি-রহস্য। এখন মনে হয়, কেবল শঙ্খ ঘোষ-কেই যদি পড়ব বলে মনে করি, এই একটা আয়ুষ্কাল কি যথেষ্ট আমার?
বোধহয়, না।
কিন্তু তাঁর লেখা কথাগুলিকে সামনে রেখে যদি এগোই, তাঁকে অবলম্বন ভেবেই পথ হাঁটি যদি, তাহলে হয়তো কোনওদিন প্রকৃত শিল্পের অর্থ ও তার সত্যের স্পর্শটুকু এই জীবন পাবে!

অভিরূপ মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৯৩ সালে, নদিয়ার কৃষ্ণনগগরে। বাংলা সাহিত্যে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বিশ্বভারতী থেকে এম.ফিল। বর্তমানে এশিয়াটিক সোসাইটি-র গবেষণা-প্রকল্পে যুক্ত। ২০২০ সালের কলকাতা বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে অভিরূপের প্রথম কবিতার বই ‘এই মন রঙের কৌতুক’, সপ্তর্ষি প্রকাশন থেকে।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *