দ্বিতীয় দিন সকালে গিয়ে হানা দিলাম পোস্ট-অফিসে। ছোট্ট খুপরি একটা ঘর। তার ভেতরে একটা লাল গদিওলা চেয়ারে বসে রিংঝিং বাবাজি দেখি দিব্যি খোশগল্প জুড়েছে বাইরে দাঁড়ানো এক ঘাড়েগর্দানে চেহারার লোকের সঙ্গে। আমাকে দেখে ছটফটিয়ে উঠল রিংঝিং… ‘এই তো, এতক্ষণ আপনার কথাই হচ্ছিল। ওই স্কেচ খাতাটা যদি এঁকে একটু দেখান…।’ বুঝলাম প্রচার সচিবটিকে ভালোই জুটিয়েছি। পিঠের ব্যাগ থেকে খাতাটা বের করে বাড়িয়ে দিলাম ঘাড়েগর্দানের দিকে। যেন রাষ্ট্রপতির হাত থেকে পুরস্কার নিচ্ছেন, এমন একটা পরমানন্দ ভঙ্গিতে ওটা হাতে তুলে নিয়ে উনি একের পর এক পাতা উল্টোতে লাগলেন।
আমি সেই ফাঁকে পিছনের একফালি দরজা দিয়ে ওই খুপরির মধ্যে ঢুকে দেখলাম, খাতায় কলমে পোস্ট অফিস হলেও রিংঝিং আসলে এটাকে একটা জেনারেল স্টোর্স বানিয়ে ফেলেছেন। একপাশে কম্পিউটার, প্রিন্টার আর বান্ডিল করা খাম-পোস্ট কার্ড রাখা। বাকি জায়গা জুড়ে সাজানো রয়েছে তেল, সাবান, চুলের কলপ, ব্যাটারি, চানাচুর, দুধ আর চাউয়ের মতো আরও হাজারটা নিত্য দরকারি জিনিস। বাদ যায়নি শীতের রংচংয়ে সোয়েটার, টুপি কিংবা মাফলার জাতীয় জামাকাপড়ও। হঠাৎ মনে পড়ে গেল সত্যেন দত্তর সেই লাইনটা ‘পাঠশালাটি দোকান ঘরে, গুরুমশাই দোকান করে।’

এক ফাঁকে ঘাড়েগর্দানের সঙ্গে আলাপটাও হল। ভদ্রলোক এখানকার স্কুলের হেডমাস্টার মিস্টার প্রধান। শীতের ছুটি পড়াতে গ্যাংটকে নিজের বাড়ি ফিরবেন, তাই মনটা খুশি খুশি। আমার স্কেচগুলো দেখে উনি এতই উল্লসিত হলেন, মনে হল ক্ষমতা থাকলে এখনই হয়তো আমাকে ললিতকলা অ্যাকাডেমির ডিরেক্টর বানিয়ে দিতেন! ওঁর একটা স্কেচ করলাম আর তক্ষুনি সেটা মোবাইলে তুলে রাখলেন প্রধান সাহেব। রিংঝিং এবার দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে বলল ‘চলুন পিপনের বাড়ি।’ কাল বিকেলে যাওয়া হয়নি উনি ব্যস্ত ছিলেন বলে। এমনিতে এখানকার গন্যিমান্যি লোক হলেও পিপন কিন্তু থাকেন খুব সাদাসিধে ভাবেই। ওঁর স্যাঁতস্যাঁতে ঘরের মধ্যে যত্রতত্র মুর্গিরা ঘুরে বেড়ায়, একটা মান্ধাতা আমলের টিভির ঘোলাটে পর্দায় সারাক্ষণ নেপালি গান চলে আর স্ত্রী কোমরে তোয়ালে বেঁধে পাশের রান্নাঘরে বিটকেল গন্ধ ছড়িয়ে কী যেন রাঁধেন। তবে পিপনের চেহারাটা কিন্তু জম্পেশ! অনেকটা হিন্দি সিনেমার দাপুটে ভিলেন প্রেমনাথের মতো। তার ওপর মাথায় দারুণ একটা কাউবয় মার্কা টুপি চাপিয়ে বসেছিলেন। মন দিয়ে আমার ছবি দেখে টেখে বললেন ‘আমার এক ভাইপোও ভালো আর্ট করত, এ লাইনে ওর হত, কিন্তু কেন যে শেষে ফৌজে গিয়ে ঢুকল?’ সঙ্গে ফোঁস করে বড়সড় একটা নিঃশ্বাস বেরিয়ে এল।

মৃদু গলায় জানতে চাইলাম ওঁর একটা স্কেচ করা যায় কিনা। ‘কিঁউ নহি?’… সড়াৎ করে টুপিটা খুলে নিয়ে সোজা হয়ে বসলেন পিপন সাহেব। দেখলাম মাথা জোড়া টাক চকচক করছে। যাঃ… এ তো মুহূর্তের মধ্যে হুলিয়া বদল! টুপিটা ফিরিয়ে আনুন এ কথাটাও সাহস করে বলা গেল না, যদি আবার কিছু মনে করেন! পিপনের বাড়ির উঠোনেই বেশ জমিয়ে ইয়াক কাটা চলছে। উনি নাকি নিজেও এদের সঙ্গে হাত লাগান। তবে ব্যাপারটাকে উৎসব হিসেবে মানতে পারলেন না পিপন সাহেব। বললেন, “এটা হল আমাদের বার্ষিক অনুষ্ঠান।”
ওখান থেকে বেরিয়ে রিংঝিং বাড়ির পথ ধরল। আমাকেও দুপুরের খাওয়াটা ওর ওখানেই সারতে বলল। ওকে বোঝালাম দিনের বেলা খেয়েদেয়ে আয়েস করলে ঘুরে ঘুরে ছবি আঁকার সময় আর ইচ্ছে দু’টোতেই ঘাটতি পড়ে। তাই আমি সঙ্গে বিস্কুটের প্যাকেট রাখি। আর যদি দু এক কাপ চা জুটে যায় তাহলেই যথেষ্ট। রোদ ঝলমলে দিন। ফলে নিজের মতো করে ছবি এঁকে বেড়ালাম বিকেল পর্যন্ত। এবার হঠাৎ আকাশে মেঘ জমে অন্ধকার হয়ে এল। সঙ্গে কনকনে ঠান্ডা হাওয়া। হোটেলে ফেরার পথে চোখে পড়ল পাহাড়ের ওপর দিকটা ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছে। মনে হল ওখানে বোধহয় বরফ পড়তে শুরু করেছে। রাতের খাওয়া সেরে যখন শুতে যাচ্ছি, বাইরে তখন ঝিরঝিরে বৃষ্টি হচ্ছে।

পরদিন ভোর ছটা নাগাদ ঘুম ভেঙে গেল। জানলা দিয়ে দেখলাম, তখনও আলো ফোটেনি। কিন্তু চারদিকে কেমন যেন একটা সাদা চোখ ধাঁধানো চকচকে ভাব। কয়েক সেকেন্ড লাগল ব্যাপারটা বুঝতে… রাতে বরফ পড়েছে। ঠিক করলাম এখনই বেরোতে হবে। হুড়মুড়িয়ে তৈরি হয়ে নিলাম। আকাশ নীল। ধীরে ধীরে রোদ উঠছে। বরফ গলতে আর কতক্ষণ! হোটেলের বাইরে পা দিয়েই ঘাবড়ে গেলাম। গত দু’দিনে দেখা লাচেনকে চেনে কার সাধ্যি! টাটকা বরফের সাদা ছোপ ধরেছে সারা গায়ে। খচমচ করে এগিয়ে চললাম। স্টিল আর ভিডিও দু’টো ক্যামেরাই হাতে ঝুলিয়ে। ভোরের হলুদ আলো বরফের পাহাড়ের ওপর পড়লে যে চোখ ধাঁধানো ব্যাপারটা তৈরি হয়, সেটা জলরংয়ে ফুটিয়ে তোলা অন্তত আমার ক্ষমতার বাইরে। খুব সাবধানে পাহাড়ের ধাপ বেয়ে বেয়ে উঠছি, ঘড়িতে তখন সবে সাড়ে ছটা। চারদিক সুনসান। ঠান্ডার মধ্যে অত সকালে লোকে বেরোতে যাবে কোন দুঃখে?
নিরিবিলিতে ইচ্ছেমতো এদিক ওদিক নানা বরফিলি দৃশ্য ক্যামেরা বন্দি করে চলেছি। হঠাৎ মনে হল, এই তুষার রাজ্যের মাঝখানে আমারও তো ছবি থাকা উচিত! কিন্তু তুলবে কে? রঘু রাই-কে এখন পাই কোথায়? (হায়, সেলফির যুগ তখনও যে বহুদূর!) খানিক চড়াই উঠে পাহাড়ি রাস্তার একটা বাঁকে পৌঁছে চোখে পড়ল দূরে একটা ঝুলঝুলে চেহারার লোক এলোমেলো পায়ে এগিয়ে আসছে… অনেকটা ‘একদিন রাত্রে’ সিনেমার ছবি বিশ্বাসের কায়দায়। সামনে যখন এল, দেখলাম ঠিক ধরেছি। বাবাজির কাল রাতের নেশা কাটেনি। এখনও বেশ টইটুম্বুর।আমি তখন মরিয়া। লোকটাকে থামিয়ে আমার ডিজিটাল ক্যামেরাটা হাতে ধরিয়ে হাত-পা নেড়ে যা বোঝার বুঝিয়ে, দূরে গিয়ে দাঁড়ালাম। সে-ও দিব্যি বাধ্য ছেলের মতো কিছুটা সামলে নিয়ে পটাপট কয়েকবার শাটার টিপে দিল। আশ্চর্য ব্যাপার, ছবিগুলো কিন্তু মন্দ ওঠেনি! আজও দেখতে গিয়ে লোকটার কথা মনে পড়ে। খালি আফশোস, ওরই কোনও ছবি তোলা হয়নি বলে।

রোদ্দুর বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বরফ গলতে লাগল আর চারদিকে লোকজনের ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেল। ওরই মধ্যে একজন মা দেখলাম তাঁর বছর দশেকের ছেলেকে বাড়ির সামনে খোলা জায়গায় বসিয়ে ওই হাড়কাঁপানো ঠান্ডায় চান করাচ্ছেন। ভোর থেকে বরফে চরকি পাক খেয়ে আমি তখন বিন্দাস। কাছে গিয়ে অচেনা মহিলাকে বলেই ফেললাম ‘দেখা, ক্যায়সা বরফ গিরা?’ মগে করে জল ঢালতে ঢালতেই কিছুটা তাচ্ছিল্য আর অনেকখানি বিরক্তি মেশানো উত্তর এল…‘ইয়ে তো কুছ ভি নহি, ইসসে বহুত জ্যাদা গিরতা হ্যায়।’
বুঝলাম আমরা বেড়াতে এসে হাত-পা তুলে নাচলেও এরা কিন্তু বরফ পড়াটা মোটেই তেমন পছন্দ করে না। এরপর দেখলাম উনি ওই ন্যাংটা খোকাকে নিয়ে যেই না ঘরে ঢুকে সশব্দে দরজা বন্ধ করলেন, ওমনি চাল থেকে ঝুপ করে বড় এক খাবলা বরফ মাটিতে খসে পড়ল। কিছুটা ক্লান্ত হয়ে এবার হোটেলে ফিরছি, পথে দেখি একটা টাটা সুমোর বনেটে জমে থাকা বরফের ওপর প্লাস্টিকের ছোট ছোট জন্তু জানোয়ার সাজিয়ে কিছু বাচ্চা ছেলেমেয়ে বেশ একটা ঝুলন ঝুলন খেলায় মেতেছে। একজন আবার বড়সড় একটা স্নো-ম্যান ও বানিয়ে ফেলেছে! ভেবেছিলাম ওদের জিগ্যেস করি…‘সামনেই তো ক্রিসমাস, সান্তা দাদু কি এই পথ দিয়েই স্লেজগাড়ি চেপে তোমাদের জন্য উপহার নিয়ে আসবে?’
স্বনামধন্য এই অঙ্কনশিল্পী নিজেই এক সম্পূর্ন প্রতিষ্ঠান | তাঁর হাত ধরে নতুন করে প্রাণ পেয়েছে বাংলার কার্টুন শিল্প | সিগনেচার বেড়াল আর স্ব-নেচারটি কোমল, আত্মবিশ্বাসী, রসিক | বেড়ানো তাঁর নেশা | তাই ঝুলিতে রয়েছে বহু গল্প, সঙ্গে অসাধারণ সব স্কেচ | সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে তাঁর নিরলস সাধনার অমর ফসল ‘রঙ তুলির সত্যজিৎ’ |
“বরফিলি” ছবি খুব সুন্দর আর তার সঙ্গে- গুরু মশাই দোকান করে।
ধন্যবাদ মন্দার…
ধন্যবাদ মন্দার…