– চারবার, এই নিয়ে চারবার আমার আবেদন নাকচ হল। আই কান্ট টেক ইট এনিমোর। ডাক্তারবাবু, প্লিজ, আমি মরতে চাই!
একনিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে হাঁপাতে লাগলেন স্বেচ্ছামৃত্যুর আবেদনপ্রার্থী সাগররঞ্জন পুরকায়স্থ। টেবিলের ওপারে বসে থাকা মানুষটি মোটেই উত্তেজিত হলেন না, বরং অল্প হেসে সামনে রাখা জলের গ্লাস এগিয়ে দিলেন। ‘মার্সি মেন্টাল হেলথ কেয়ার’-এর চিফ সাইকায়াট্রিস্ট তথা স্টেট সাইকায়াট্রিক কাউন্সিলের সেক্রেটারিকে এটুকু ধৈর্য রাখতেই হয়।
– রিল্যাক্স, মিঃ পুরকায়স্থ। আপনাকে তো আগেই বলা হয়েছিল, বারবার আবেদন করে লাভ হবে না। শুধু শুধু পয়সা আর সময়ের অপচয়।
একটু থামলেন ডাঃ নীলোৎপল সেন, তারপর শান্ত স্বরে বলে চললেন,
– আপনি শিক্ষিত মানুষ, ক’দিন আগেও কলকাতার নামী কলেজে পলিটিক্যাল সায়েন্সের প্রোফেসর ছিলেন। এদেশের আইন তো আপনার অজানা নয়। সরকারের কঠোর নিয়ম, স্বেচ্ছামৃত্যুর আবেদন মঞ্জুর হওয়ার ভ্যালিড গ্রাউন্ড থাকতেই হবে। নাহলে অনুমোদনকারী ডাক্তারের লাইসেন্স তো যাবেই, হাজতবাসও আশ্চর্য নয়।
ঘড়িতে চারটে বেজে পঁচিশ, চেম্বারের দেয়ালে গোলাপি নকশা বুনছে শেষ বিকেলের রোদ। জলে ডুবন্ত মানুষের মরিয়া আকুতি নিয়ে সাগরবাবু বলে উঠলেন,
– কিন্তু আমার তো ভ্যালিড রিজন রয়েছে, ডাক্তারবাবু। আমি অকেজো মানুষ, সমাজের জঞ্জাল। রিটায়ার করেছি তিনবছর হয়ে গেল। সরকারি পেনশন নিয়ে, আশপাশের লোকজনের ওপর বোঝা হয়ে আছি। ফালতু একটা লোক আমি…
– সাগরবাবু, প্লিজ, ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করুন। টার্মিনাল ডিজিজে আক্রান্ত বা কোমায় চলে যাওয়া রোগীদের জন্য ইউথ্যানেশিয়া আজকের দিনে ঘটে। কিন্তু স্বেচ্ছামৃত্যু সেরকম নয়, বরং স্টেট অ্যাসিস্টেড মার্সি কিলিং বলতে পারেন। অনেক কিছু বিচার বিবেচনা করে তবেই অনুমোদন দেওয়া হয়। তারপর রিভিউ হয়, অনুমোদনকারী ডাক্তারকে সার্টিফাই করতে হয় যে আবেদনকারীর মৃত্যুতে তাঁর পরিবার এবং বৃহত্তর সমাজের কোনও ক্ষতি হবে না। এত কিছুর পরেও আবেদন বাতিল হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। গত পাঁচবছরে আমাদের রাজ্যে মাত্র এগারোজনের আবেদন অ্যাপ্রুভড হয়েছে, যেখানে পেন্ডিং কেস দেড় হাজার…
– না, ডাক্তারবাবু, আপনি শুনুন! আমার স্ত্রী… বিনতা… আমার সন্দেহপ্রবণতাই ওকে আত্মহত্যায় বাধ্য করেছিল। আমার একমাত্র মেয়ে টুসির ডিভোর্স হতে চলেছে, তার জন্য আমি দায়ী। ওর কলেজেরই একটা ছেলেকে খুব ভালোবাসত, কিন্তু আমি জোর করে অন্য জায়গায় ওর বিয়ে দিই…
বাচ্চা ছেলের মতো হাউহাউ করে কেঁদে ফেললেন তেষট্টি বছরের বৃদ্ধ।
– কাউকে সুখ-শান্তি দিতে পারিনি আমি। আমার বেঁচে থাকার কোনও অধিকারই নেই। আপনার পায়ে পড়ছি ডাক্তারবাবু…
চেয়ার ছেড়ে উঠে এলেন ডাঃ সেন, হাত রাখলেন সাগররঞ্জনবাবুর কাঁধে।
– এ কী করছেন! প্লিজ একটু শান্ত হয়ে বসুন। সবকিছু শেষ হয়ে যায়নি। আপনার সমস্যার একটা সমাধান… না, আমার পুরো কথাটা শুনুন। আপনার স্বেচ্ছামৃত্যুর আবেদন আমি অ্যাপ্রুভ করতে পারব না, কিন্তু আপনার ডিপ্রেশনের চিকিৎসা নিশ্চয়ই সম্ভব।

চোখ মুছে ডাঃ সেনের দিকে তাকালেন সাগরবাবু।
– ডিপ্রেশন… মানে? কী বলতে চাইছেন আপনি? আমি পাগল?
– আমি তা বলিনি সাগরবাবু। তবে এটাও সত্যি, আপনি মানসিক দিক দিয়ে সম্পূর্ণ সুস্থ নন। মাত্র তেষট্টি বছর বয়স আপনার, যা এখনকার গড় আয়ুর চেয়ে পঁচিশ বছর কম। জীবনে সফল, আর্থিকভাবে স্বচ্ছল, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। তবু আপনি স্বেচ্ছামৃত্যু চাইছেন। একজন সাইকায়াট্রিস্ট হিসেবে যেটুকু বুঝতে পারছি, আপনি অবচেতনে নিজের অস্তিত্বকে ঘৃণা করেন। এই ঘৃণার পেছনের কারণটাই আমাকে খুঁজতে হবে। তারপরের কাজটা বেশ সোজা, হিপনোটিক সাজেশন ব্যবহার করে আপনার অবসাদ দূর করা।
– হিপনোটিক সাজেশন? আমি তো শুনেছিলাম হিপনোটিজম অবসোলিট একটা ট্রিটমেন্ট, আধুনিক সময়ে আর ব্যবহারই হয় না।
মুচকি হাসলেন ডাঃ সেন।
– অনেকটাই ঠিক শুনেছেন, মিঃ পুরকায়স্থ। এখন কেউই প্রায় এটা নিয়ে চর্চা করে না। আমাদের দেশে হাতে গোনা কয়েকজন স্পেশালিস্ট আছেন যাঁরা বিষয়টা বোঝেন। কেন জানি না, ছাত্রজীবনের একদম শুরু থেকেই আমি এটা নিয়ে উৎসাহী ছিলাম। বই পড়ে, দুষ্প্রাপ্য ভিডিও দেখে বারো বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে নিজে নিজেই হিপনোটিজ়ম শিখেছি, মনোচিকিৎসায় প্রয়োগ করে ফলও পেয়েছি। আপনাকে যিনি আমার নাম রেকমেন্ড করেছিলেন সেই মিঃ বসাকের অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার-এর চিকিৎসায় হিপনোথেরাপি দারুণ রেজাল্ট দিয়েছিল। এটা সত্যি যে একসময় আমাদের এখানে হিপনোটিজ়মের নামে বুজরুকি চলত, একদল অর্ধশিক্ষিত ফেরেব্বাজ ‘পাস্ট লাইফ রিগ্রেশন থেরাপি’-র নামে লোক ঠকানোর ব্যবসা খুলে বসেছিল। সাইকায়াট্রিক কাউন্সিল এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রকের যৌথ প্রচেষ্টায় সেসব বন্ধ হয়েছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আপনার ক্ষেত্রে হিপনোটিজ়ম ভালো কাজ দেবে। আপনি যদি রাজি থাকেন তাহলে আমি আজ, এখনই আপনার সঙ্গে একটা সেশন করতে চাই। কথা দিচ্ছি, আপনার ডিপ্রেশন নির্মূল করার সবরকম চেষ্টা করব।
টার্মিনাল ডিজিজে আক্রান্ত বা কোমায় চলে যাওয়া রোগীদের জন্য ইউথ্যানেশিয়া আজকের দিনে ঘটে। কিন্তু স্বেচ্ছামৃত্যু সেরকম নয়, বরং স্টেট অ্যাসিস্টেড মার্সি কিলিং বলতে পারেন। অনেক কিছু বিচার বিবেচনা করে তবেই অনুমোদন দেওয়া হয়। তারপর রিভিউ হয়, অনুমোদনকারী ডাক্তারকে সার্টিফাই করতে হয় যে আবেদনকারীর মৃত্যুতে তাঁর পরিবার এবং বৃহত্তর সমাজের কোনও ক্ষতি হবে না। এত কিছুর পরেও আবেদন বাতিল হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।
– আপনি সত্যি বলছেন, ডাঃ সেন? আমার এই হতাশা, মনের এই যন্ত্রণা সেরে যাবে? আমি আবার জীবনকে ভালবাসতে পারব?
– হ্যাঁ সাগরবাবু। যদি সবকিছু ঠিকঠাক চলে তাহলে হয়তো এই সেশনেই আপনার সমস্যার মূলে পৌঁছে যেতে পারব। তারপর প্রয়োজনমাফিক কাউন্সেলিং আর ওরাল মেডিসিন। ইন নো টাইম আপনি সুস্থ, স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাবেন।
– তাহলে তাই করুন ডাক্তারবাবু। আমি রাজি…হিপনোথেরাপিতে রাজি। মৃত্যুকে যখন পাব না, তখন জীবনকেই আঁকড়ে ধরার ঝুঁকি নেব।
– ভেরি গুড! আমি থেরাপি রুমের দরজা খুলে দিচ্ছি, আপনি গিয়ে কাউচে শুয়ে পড়ুন। ঘরে আলো জ্বলবে না, তাই বলে ঘাবড়ানোর কিছু নেই। আসলে হিপনোটিজ়মের জন্য বিশেষ একধরনের পরিবেশ লাগে, অনেকটা ফটোগ্রাফ ডেভেলপ করার ডার্করুমের মতো। মেক ইয়োরসেল্ফ কমফর্টেবল। প্রয়োজনীয় কয়েকটা জিনিস নিয়ে মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই আমি আসছি।
গাঢ় অন্ধকার থেকে আস্তে আস্তে উজ্জ্বলতায় ফিরে এলেন সাগররঞ্জন পুরকায়স্থ। চোখের ঝাপসাভাব কেটে যাওয়ার পর বুঝলেন, থেরাপি রুমেই শুয়ে রয়েছেন তিনি। ভেজিয়ে রাখা দরজা বেশ খানিকটা ফাঁক হয়ে গেছে, সেখান দিয়ে ভেতরে আসছে আলো। বিছানা থেকে নেমে পাশের চেম্বারে গেলেন সাগরবাবু। ডাঃ সেনকে ধন্যবাদ জানানোর তর সইছিল না তাঁর।
– থ্যাংক ইউ সো মাচ ডক্টর! আপনি কথা রেখেছেন। বদলটা স্পষ্ট বুঝতে পারছি। আমার আর মরতে ইচ্ছে করছে না। মনখারাপটাও কোথায় যেন মিলিয়ে গেছে। বউ, মেয়ে – কারওর কাছে নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে না। জীবনটা সুন্দর লাগছে, এই যে এত আলো, ওই যে বাইরের সন্ধে…এসব প্রাণভরে উপভোগ করতে মন চাইছে। আপনি নিশ্চয়ই যাদুকর, নাহলে এমন মিরাকেল কখনও সম্ভব হত না।
আরও পড়ুন: কাবেরী রায়চৌধুরীর ছোটগল্প: মায়া খেলা
টেবিলের দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়ে ছিলেন ডাঃ সেন। জানলার বাইরে তখন গোধূলির মৃত্যু। সাগরবাবুর গলার আওয়াজ পেয়ে ফিরে তাকালেন। মুখ থমথমে, দৃষ্টি ঠান্ডা।
– রেমব্রান্ট পছন্দ ছিল আপনার। হেরোনিমাস বশ-এর পেইন্টিং। বাড়িতে খুঁজলে নিশ্চয়ই আপনার আঁকা কয়েকটা ছবিও আমরা পাব, তাই না মিঃ পুরকায়স্থ? সবকটা নিশ্চয়ই পুড়িয়ে ফেলেননি?
মুহূর্তের মধ্যে ফ্যাকাসে হয়ে গেল সাগররঞ্জনবাবুর মুখ, যেন কেউ তার দেহ থেকে সমস্ত রক্ত শুষে নিয়েছে। কিছু একটা বলতে গিয়েও পারলেন না।
– আমি নিজের বিবেকের কাছে পরিষ্কার থাকতে চাই। আপনি বলেছিলেন আপনি ফালতু লোক, সমাজের জঞ্জাল। সেটা হলেই আমি খুশি হতাম। এখন জেনে গেছি, সমাজের পক্ষে অত্যন্ত বিপজ্জনক আপনি। সব মানুষ সমান, সৃজনশীলতার আড়ালে নৈরাজ্যের অভিশাপ এই দেশের বুকে আর কখনও নেমে আসবে না– দেশের দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে এই শপথ আমরা সবাই নিয়েছি। সংবিধানের সংশোধিত ধারা ৬১২ অনুযায়ী শ্রেণিহীন, বৈষম্যহীন, শোষণহীন ভারতবর্ষে যে কোনও ধরনের ক্রিয়েটিভ আর্টের চর্চা গর্হিত ক্রিমিন্যাল অফেন্স। দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে আমি পারব না। আপনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা আমাকে নিতেই হবে।
– এসব কী বলছেন ডাঃ সেন? আপনার নিশ্চয়ই কোথাও ভুল হচ্ছে। আমি কোনোদিনই ছবি আঁকতাম না। ক্রিয়েটিভ আর্ট… হতে পারে না…
আমাদের দেশে হাতে গোনা কয়েকজন স্পেশালিস্ট আছেন যাঁরা বিষয়টা বোঝেন। কেন জানি না, ছাত্রজীবনের একদম শুরু থেকেই আমি এটা নিয়ে উৎসাহী ছিলাম। বই পড়ে, দুষ্প্রাপ্য ভিডিও দেখে বারো বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে নিজে নিজেই হিপনোটিজ়ম শিখেছি, মনোচিকিৎসায় প্রয়োগ করে ফলও পেয়েছি। আপনাকে যিনি আমার নাম রেকমেন্ড করেছিলেন সেই মিঃ বসাকের অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার-এর চিকিৎসায় হিপনোথেরাপি দারুণ রেজাল্ট দিয়েছিল।
– মানুষ ভুল বলতে পারে, সাগরবাবু, কিন্তু স্মৃতি কখনও ভুল বলে না। আপনার হিপনোথেরাপি সেশনের পুরোটাই আমার কাছে রেকর্ড হয়ে আছে। সঙ্গে ব্রেন ম্যাপিংয়ের রেজাল্ট, যা স্পষ্ট দেখাচ্ছে আপনার বলা প্রতিটা কথা সত্যি। কী কুক্ষণেই যে আপনি থেরাপিতে রাজি হয়েছিলেন, মিঃ পুরকায়স্থ! হিপনোটিজ়ম-এর কাজই হল মানুষের চেপে রাখা স্মৃতিকে জাগিয়ে তোলা। আপনার অতীতকে খোলা বইয়ের মতো দেখেছি আমি। শুধু ছবি আঁকাই নয়, তরুণ বয়সে বেআইনি একাধিক সংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন আপনি। ডিবেট ক্লাব, লিটারেচার সোসাইটি, ফ্রি থিঙ্কার্স গ্রুপ— আর কত বলব। আপনি যে এখনও আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন এতেই অবাক হচ্ছি। ন্যাশনাল কারেকশনাল ফ্যাসিলিটির স্যাঁতস্যাঁতে কনডেমড সেল-ই আপনার উপযুক্ত জায়গা।
– কিন্তু আমার যে কিচ্ছু…।
– মনে পড়ছে না, তাই তো? যা যা মনে আছে, সেগুলো বলি? জুলাই রায়টস, যখন রাইট টু ক্রিয়েটিভ থিঙ্কিং-এর জিগির তুলে ভারতবর্ষে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চেয়েছিল একদল বিষাক্ত বুদ্ধিজীবী। ব্লাডি থার্সডে, যেদিন দেশের বড় শহরগুলোতে নৈরাজ্য নামিয়ে আনার চেষ্টা হয়েছিল, নির্মমভাবে খুন করা হয়েছিল নিরপরাধ সরকারি কর্মীদের। ভাড়াটে খুনি লাগিয়ে রাষ্ট্রনায়ককে হত্যার ষড়যন্ত্র, বিদেশি শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে হামলার ছক…

– এসব মিথ্যে, অপপ্রচার…
চেঁচিয়ে উঠলেন সাগররঞ্জনবাবু।
– ন্যায্য দাবিতেই আন্দোলন করেছিল জুলাই বিপ্লবীরা। রাষ্ট্রই বরং নিষ্ঠুর অত্যাচার চালিয়েছিল নাগরিকদের ওপর, প্রতিবাদীর কণ্ঠরোধ করতে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছিল।
– হ্যাঁ, এসব তো বলবেনই! আপনিও যে কথায় কথায় দেশের বিরোধিতা, বিপ্লবের নামে বেলাগাম উচ্ছৃঙ্খলতা, সমাজকে অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দেওয়াতেই বিশ্বাসী। রাষ্ট্রকে আন্ডারএস্টিমেট করা আপনাদের স্বভাব, যেমনটা সেবারও করেছিলেন। ফল কী হয়েছিল? প্রত্যাঘাত করেছিল প্রশাসন, মারের বদলে পালটা মার। ষড়যন্ত্রকারীদের ঘর থেকে টেনে বের করে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিল প্যারামিলিটারি ফোর্স, ধুয়েমুছে সাফ করে দিয়েছিল দেশদ্রোহীদের। তারপর সংবিধান সংশোধন হল। নতুন আইনে নিষিদ্ধ হল সৃজনশীলতা, ক্যাপিটাল অফেন্স ঘোষিত হল শিল্প-সাহিত্য-পারফর্মিং আর্টস। কিন্তু আপনারা রক্তবীজের বংশধর! তলে তলে আবার সক্রিয় হলেন, পাড়ার ক্লাব থেকে কলেজ ইউনিয়ন, ছড়িয়ে পড়লেন সবজায়গায়। ভাঙা শিরদাঁড়া নিয়ে সরাসরি সংঘাতে যাওয়ার ক্ষমতা আপনাদের ছিল না, লুকিয়ে চুরিয়ে যতটা আইন ভাঙা যায়।
– আইন ভাঙা…আমি? স্মৃতি মুছে ফেলা? এসব কীভাবে সম্ভব?
সাগরবাবুর প্রশ্নগুলো তাঁর নিজের কানেও বোধহয় হাহাকারের মতোই শোনাল।
– অব্লিডোজ়-এর নাম শুনেছেন? মায়োসিন ২ ইনহিবিটর, গত এগারো বছর ধরে পুরো পৃথিবীর সর্বত্র ব্যানড। এই ওষুধ খেয়ে একজন মানুষ ‘সিলেকটিভ মেমরি রিপ্রেশন’ ঘটাতে পারে, অবাঞ্ছিত ঘটনার স্মৃতি ভুলে যেতে পারে। আমার ধারণা, আজ থেকে প্রায় পঁয়তিরিশ বছর আগে ওষুধটা খেয়েছিলেন আপনি, চাকরির ইন্টারভিউয়ের আগে। কারণ আপনি জানতেন, সাইকোলজিক্যাল ইভ্যালুয়েশন টেস্টে পাশ করতে পারবেন না।
– অব্লিডোজ়-এর প্রভাব সম্বন্ধে তখন খুব কম লোকেরই ধারণা ছিল। আজ থেকে বছর পনেরো আগে যখন একের পর এক ক্রিমিনাল লাই ডিটেক্টর মেশিন-কে ধোঁকা দিয়ে বেকসুর খালাস পেতে শুরু করল, তখন সরকারের টনক নড়ল। তিন বছরের চেষ্টায় সত্যিটা সামনে এল, নিষিদ্ধ ঘোষিত হল অবলিভিয়ন ড্রাগ।
– অব্লিডোজ়-এর প্রভাবে তরুণ বয়সের কুকর্মের কথা ভুলে গিয়েছিলেন আপনি। কিন্তু আপনার সাবকনশাস-এ রয়ে গিয়েছিল সেই রেশ। ভদ্র, শিক্ষিত কলেজ প্রোফেসরের মুখোশ পরে আপনি সমাজে ঘুরে বেড়াতেন, এদিকে আপনার অবচেতন অপরাধভোগে ভুগত। প্রথমে তেমন অসুবিধে হয়নি। কিন্তু যত বয়স বাড়তে লাগল, মানসিকভাবে ততই দুর্বল হয়ে পড়তে লাগলেন আপনি। তারপর এল ট্রিগারিং ইন্সিডেন্ট, আপনার রিটায়ারমেন্ট। ভেঙে গেল বালির বাঁধ। নিজেই নিজের শত্রু হয়ে উঠলেন, প্রতিমুহূর্তে মৃত্যু খুঁজতে লাগলেন। আত্মহত্যার কথা যে একবারও আপনার মাথায় আসেনি তা নয়, কিন্তু বেসিক্যালি আপনি কাপুরুষ। এখনকার আইন অনুযায়ী কেউ যদি সুইসাইড অ্যাটেম্পট করে বেঁচে যায়, তাহলে জীবনের বাকি সময়টা তাকে জেলে কাটাতে হয়। ষাটোর্ধ্ব বয়সে নতুন করে আইন ভাঙার সাহস জুটিয়ে উঠতে পারলেন না আপনি। তাই স্বেচ্ছামৃত্যুর জন্য মরিয়া হয়ে ছুটে এলেন আমার কাছে…

দিনে দ্বিতীয়বারের জন্য সাগররঞ্জন পুরকায়স্থর চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এল। টলতে টলতে কয়েক পা পিছিয়ে গেলেন তিনি, পরক্ষণেই চেয়ারের পায়ায় হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলেন মেঝেতে। কপালটা টেবিলের কোনায় ঠুকে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দরদর করে রক্ত ঝরতে লাগল। ঠোঁটদুটো একটু ফাঁক হল, কিন্তু অস্পষ্ট গোঙানি ছাড়া আর কোনও আওয়াজ বেরলো না।
– কেঁদে লাভ হবে না, মিঃ পুরকায়স্থ। দেশের আইনানুযায়ী আপনি গর্হিত একজন অপরাধী, এবং তার শাস্তি আপনাকে পেতেই হবে। তবে কী জানেন, আপনারা আমাদের ডাক্তারদের যতটা পাষণ্ড ভাবেন, ততটা আমরা নই। আমাদের মধ্যেও মনুষ্যত্ব আছে, তাই পুলিশ স্টেশনে ফোন করে আপনাকে ধরিয়ে দিতে মন সায় দিচ্ছে না। পাবলিক এনিমি বলে যখন ওরা আপনাকে কেন্দ্রীয় সুরক্ষাবাহিনীর হাতে তুলে দেবে, তখন আপনার অবস্থা কী হবে ভাবতে পারছেন? দিনরাত টর্চার– চোখ কান উপড়ে নেবে, হাত পা ভাঙবে। তারপর একদিন সকালে রাষ্ট্রীয় মঞ্চে নিয়ে গিয়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেবে। আপনার স্ত্রীর ভাগ্য ভালো তাই মরে বেঁচেছেন…আপনার মেয়ে, জামাই কিন্তু ছাড় পাবে না। ওদেরও…
আপনি বলেছিলেন আপনি ফালতু লোক, সমাজের জঞ্জাল। সেটা হলেই আমি খুশি হতাম। এখন জেনে গেছি, সমাজের পক্ষে অত্যন্ত বিপজ্জনক আপনি। সব মানুষ সমান, সৃজনশীলতার আড়ালে নৈরাজ্যের অভিশাপ এই দেশের বুকে আর কখনও নেমে আসবে না– দেশের দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে এই শপথ আমরা সবাই নিয়েছি। সংবিধানের সংশোধিত ধারা ৬১২ অনুযায়ী শ্রেণিহীন, বৈষম্যহীন, শোষণহীন ভারতবর্ষে যে কোনও ধরনের ক্রিয়েটিভ আর্টের চর্চা গর্হিত ক্রিমিন্যাল অফেন্স। দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে আমি পারব না। আপনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা আমাকে নিতেই হবে।
– প্লিজ না! ওদের কোনও দোষ নেই। অপরাধ যদি কেউ করে থাকে সে আমি। আমাকে শাস্তি দিন, মেরে ফেলুন, কিন্তু দোহাই আপনার, ওদের কিছু করবেন না।
কান্নাভেজা গলায় ককিয়ে উঠলেন বিধ্বস্ত মানুষটা।
– হ্যাঁ সাগরবাবু, আমিও সেটাই মনে করি। আপনার অপরাধের শাস্তি শুধুমাত্র আপনারই প্রাপ্য। কিন্তু এই বয়সে আপনার ওপর অকথ্য অত্যাচার হোক, সেটা আমি চাই না। উপায় একটাই; আপনার স্বেচ্ছামৃত্যুর আবেদন আমি মঞ্জুর করছি। মরবিড ডিপ্রেশনের পেশেন্ট আপনি, সমাজের পক্ষে বিপজ্জনক – ফাইলে এটুকু লিখলেই হবে। ফাইনাল অ্যাপ্রুভাল দিতে রিভিউয়িং কমিটি দু’বার ভাববে না। এতদিন ধরে তো এটাই চেয়েছিলেন। আর এখনকার বিজ্ঞান যথেষ্ট উন্নত, লিথ্যাল ইঞ্জেকশনের তিরিশ সেকেন্ডও সময় লাগে না নিজের কাজ সারতে। নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, একেবারেই যন্ত্রণাহীন মৃত্যু হবে আপনার।
হঠাৎ খুলে গেল চেম্বারের দরজা, দ্রুতপায়ে ভেতরে ঢুকল কালো পোশাকে পরা দু’জন লোক। কোমরে টেজার গান, হাতে ব্যাটন, চোখের দৃষ্টি সতর্ক। ডাঃ সেনের ইশারায় রোবটের মতো নির্লিপ্তভাবে সাগরবাবুর দু’পাশে দাঁড়িয়ে পড়ল ওরা।
– আমাদের ইন্সটিটিউশনের গার্ডস, আপনাকে নিতে এসেছে। আপনি যখন হিপনোটিক ট্রান্স-এ ছিলেন তখনই আমি ওদের ডেকে পাঠাই। বাধা দেওয়ার চেষ্টা করবেন না, ওদের মায়াদয়া নেই। বিল্ডিংয়ের সেকেন্ড ফ্লোরে হোল্ডিং সেল আছে, ভায়োলেন্ট পেশেন্টদের রাখার জন্য। যতদিন না ফর্মালিটি সব শেষ হচ্ছে ততদিন আপনি ওখানেই থাকবেন। থাকা খাওয়ার যাতে কোনও অসুবিধা না হয় সেটা আমি খেয়াল রাখব।
– আপনার নিয়ারেস্ট কিন, অর্থাৎ মেয়েকেও আজই খবর পাঠিয়ে দেওয়া হবে। ও হ্যাঁ, আরেকটা কথা। মৃত্যুর ঠিক আগের দিন গভর্নমেন্টের নিয়ম অনুযায়ী আপনাকে কনফেশন বক্সে ঢোকানো হবে। সেখানে আবার এসব কথা বলে বসবেন না যেন। আমার খুব একটা ক্ষতি হবে না, কিন্তু আপনার জীবনের শেষ ক’টা দিন নরকযন্ত্রণায় কাটবে।
গার্ড-দের মধ্যে একজন পাঁজাকোলা করে তুলে দাঁড় করিয়ে দিল সাগররঞ্জনবাবুকে। বৃদ্ধের সারা শরীরটা কেঁপে উঠল থরথর করে। ডাঃ সেনের দিকে তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে বললেন তিনি,
– যখন আমি বারবার করে মরতে চেয়েছিলাম, আপনি আমাকে মৃত্যু দেননি। আর আজ যখন বাঁচার মানে খুঁজে পাচ্ছি, তখন আপনিই আমার মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠলেন…
– আমি এটা নিজের জন্য করছি না সাগরবাবু, করছি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভেবে। আমি চাই না আমার ছেলেমেয়ে ধ্বংস আর বিক্ষোভের মধ্যে বেড়ে উঠুক। নিহিলিজমের অভিশাপ, বুদ্ধিজীবীতার ভণ্ডামি, ভেদবুদ্ধির অসুস্থতা যেন ওদের শৈশবকে ছুঁতে না পারে। আপনার মতো একজন বৃদ্ধকে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে আমার ভালো লাগছে না। কিন্তু আমি নিরুপায়। গার্ডস, নিয়ে যাও ওকে।
আপনার অপরাধের শাস্তি শুধুমাত্র আপনারই প্রাপ্য। কিন্তু এই বয়সে আপনার ওপর অকথ্য অত্যাচার হোক, সেটা আমি চাই না। উপায় একটাই; আপনার স্বেচ্ছামৃত্যুর আবেদন আমি মঞ্জুর করছি। মরবিড ডিপ্রেশনের পেশেন্ট আপনি, সমাজের পক্ষে বিপজ্জনক – ফাইলে এটুকু লিখলেই হবে। ফাইনাল অ্যাপ্রুভাল দিতে রিভিউয়িং কমিটি দু’বার ভাববে না। এতদিন ধরে তো এটাই চেয়েছিলেন। আর এখনকার বিজ্ঞান যথেষ্ট উন্নত, লিথ্যাল ইঞ্জেকশনের তিরিশ সেকেন্ডও সময় লাগে না নিজের কাজ সারতে। নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, একেবারেই যন্ত্রণাহীন মৃত্যু হবে আপনার।
সাগরবাবুকে নিয়ে গার্ড দুজন চেম্বার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর নিজের চেয়ারে কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে রইলেন ডাঃ নীলোৎপল সেন। তাঁর মনের ভেতর ঝড় চলছিল। বাইরে ততক্ষণে সন্ধে পেরিয়ে রাত নেমেছে, সিটি লাইনের ওপর হিরের কুঁচির মতো জ্বলজ্বল করছে অজস্র তারা।
সাল ২৩৭০। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার পর পেরিয়েছে চারশো তেইশ বছর। বদলেছে অনেক কিছু, অতীতের ভিতের ওপর গড়ে উঠেছে নতুন যুগের ইমারত। তবু কিছু জিনিস আগের মতোই আছে। সমষ্টি নির্ধারিত নিয়ম ভাঙার বেপরোয়া উল্লাস, নিজেকে বাকিদের চেয়ে আলাদা দেখানোর লোভ, যে কোনও মূল্যে ব্যক্তিগত সুখ ছিনিয়ে নেওয়ার লালসা আজও ঘুণপোকার মতো কুরে কুরে খাচ্ছে পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রকে। এর জন্য দায়ী বিপথগামী মানুষদের চিহ্নিত করাটা কঠিন, আরও কঠিন আদর্শে স্থির থেকে তাদের উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া। কিন্তু কাউকে না কাউকে সেই কঠিন সিদ্ধান্তটা নিতেই হয়। দেশের, সমাজের, মানবতার স্বার্থে! দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামনে পড়ে থাকা ফাইলটা কাছে টেনে নিলেন ডাঃ সেন। সাগররঞ্জন পুরকায়স্থর স্বেচ্ছামৃত্যুর আবেদনপত্র। কয়েক সেকেন্ডের দ্বিধা, তারপর নিস্তব্ধতা খানখান করে কালো অক্ষরে সাজানো কাগজগুলোর ওপর নেমে এল রাবার স্ট্যাম্প-এর আঘাত। একবার… দু’বার…তিনবার…
‘অ্যাপ্রুভড।’
*ভিতরের ছবি সৌজন্য: Reddit, Shutterstock
সৌভিক চক্রবর্তীর জন্ম ১৯৯০ সালে, কলকাতায়। 'গভর্মেন্ট কলেজ অফ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড সেরামিক টেকনোলজি' থেকে প্রযুক্তিবিদ্যায় স্নাতক, বর্তমানে 'স্টিল অথরিটি অফ ইন্ডিয়া'-য় কর্মরত। বিদেশি সাহিত্য, বিশেষ করে পাশ্চাত্য হরর, থ্রিলার, সায়েন্স ফিকশন ও ফ্যান্টাসির প্রতি আকর্ষণ ছেলেবেলা থেকেই। ‘আনন্দমেলা’, ‘কিশোর ভারতী’, ‘শুকতারা’, ‘চির সবুজ লেখা’, ‘নবকল্লোল’, ‘অনুবাদ পত্রিকা’-র মতো নামী পত্রিকায় মৌলিক এবং অনুবাদ কাহিনি লিখেছেন সৌভিক, নিবন্ধ লিখেছেন ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’, ‘সংবাদ প্রতিদিন’, ‘তথ্যকেন্দ্র’-র পাতায়। বিগত কয়েক বছরে ‘বি বুকস’, ‘অরণ্যমন’ ও ‘জয়ঢাক’ থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সম্পাদিত একাধিক ইংরেজি ও বাংলা গল্পসংকলন। সৌভিক ভালোবাসেন গান শুনতে এবং সিনেমা দেখতে। নেশা গিটার বাজানো।