আগের পর্ব পড়তে: [১] [২] [৩] [৪] [৫] [৬]
মহান অনিশ্চয়
‘স্বপ্ন আজ কোনদিকে গড়ালে
আমাদের ছাদের বাগান আয়ু পাবে
না বুঝেই মন্ত্রমুগ্ধ সিঁড়ি দিয়ে নামছি পাতালে।’
–অঞ্জলি দাশ
লিটল ম্যাগাজিনে আমার প্রথম গল্প বেরিয়েছিল ২০০৩ সালের জানুয়ারি মাসে ‘পরিকথা’ পত্রিকায়। তখন কলেজের সেকেন্ড ইয়ার, এবং স্কুল ম্যাগাজিনের বাইরে ছাপার অক্ষরে নিজের নাম প্রথম দেখা। গল্প বেরল, কিন্তু তারপর কী করতে হয় জানি না। সম্পাদককে চিনি না কারণ গল্পটি নিয়ে গিয়েছিলেন আমার কলেজের শিক্ষক। সৌজন্য সংখ্যা কি পাব? অত সাতপাঁচ না ভেবে রাসবিহারীতে কল্যাণদার বুকস্টল থেকে কিনেই ফেললাম এক কপি। লিখননৈপুণ্য মাথায় থাকুন, তার আগে ছাপার অক্ষরে নিজের নাম দেখা মানে লেজিট লেখক হয়ে যাওয়া। আমরা তখন ক্ষুধাপ্রবণ। ফলত হ্যাংলা।
কিছুদিন বাদে ফোন নাম্বার সংগ্রহ করে সম্পাদক দেবব্রত চট্টোপাধ্যায়ের ফোন। ‘তুমি যোগাযোগ করোনি কেন? আমরা সবাই তোমাকে খুঁজছি। যাই হোক, পার্থপ্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায়কে একবার ফোন কোরো, নম্বর দিচ্ছি। লেখাটা পড়ে তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চেয়েছেন।’ আমরা যারা তখন লিটল ম্যাগাজিনের লেখাপত্র পড়ি, তাদের কাছে পার্থপ্রতিম বিরাট এক নাম। ফোনে কথা হল। পার্থদা স্নেহময় আমন্ত্রণ জানালেন কলেজস্ট্রিটে আসার। প্রৌঢ় দীর্ঘদেহী মানুষটি তখন শেয়ালদহ স্টেশন থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে র্যাডিকালের দোকানে গিয়ে বসতেন। সেখান থেকে তাঁকে নিয়ে হেঁটে যাওয়া কফিহাউস। সেখানে সেদিনকেই আলাপ হল কিন্নর রায়, শাহজাদ ফিরদাউস এবং ‘কবিতীর্থ’র সম্পাদক উৎপল ভট্টাচার্যর সঙ্গে এবং কী আশ্চর্য, প্রথম দুজন আমার গল্পটা ইতিমধ্যেই পড়ে ফেলেছেন! শিহরণ কীভাবে মহাজাগতিক হয়, টের পেলাম। বিশ্বাস হল, এই একটা গল্প লিখেই আমি বিখ্যাত হয়ে উঠব, বেঁচে থাকব অনেকদিন। আমার সমাধি থেকে ভেসে আসবে ভেজা মাটির গন্ধ।

এবং হায়, গল্পটা কেউ মনে রাখল না। খুব স্বাভাবিক নিয়মে হারিয়েও গেল একসময়ে, এবং প্রায় হৃদয়ভঙ্গের কাছাকাছি বেদনা আমাকে যা শিক্ষা দিয়ে গেল তা হল, পাঠক কী মনে রাখবে বা রাখবে না, তুমি কিছুতেই স্থির জেনে নিতে পারো না যদি তুমি একা হও। বিগ হাউজের ভল্ল তোমার তূণে যদি না থাকে, যদি না থাকে চিরাচরিত ভাষাবিভঙ্গে প্রণিপাত হবার বাসনা, তাহলে পুরোটাই অনিশ্চয়। আর এখানেই অবাণিজ্যিক লেখালেখির আকর্ষণ।
অনিশ্চয়তার আকর্ষণ পুরোটাই কিন্তু স্বল্পমেয়াদি খেলায়। কালের হিসেবে কোন বই টিকবে তার রাশ কারোও হাতে নেই। কিন্তু বিগ হাউজ অথবা পরিকল্পিত প্রমোশন যে একটা দুর্বল বইকেও কিছুদূর পর্যন্ত বিক্রি করাতে পারত, তার অজস্র উদাহরণ দেখেছি। উল্টোদিকে অনামী প্রকাশনা থেকে অনেক সময়েই নিজের খরচে বার করা বই, শক্তিশালী হলেও, চলবে কী চলবে না তার ঠিক ছিল না। বেশিরভাগ সময়েই বিক্রি হত না। খাটের নীচে অথবা প্রকাশকের গুদোমঘরে পড়ে থাকত বাণ্ডিল হয়ে। প্রেসের টাকা ধার থাকত। বন্ধুদের কাছে বিলিয়ে টিলিয়ে, প্রায় নির্লজ্জ হয়ে চেনা পরিচিতদের গছিয়েও সে টাকা উঠত না। অনেক সময়েই, যদি লেখকের খরচে বই করা হয় তাহলে প্রকাশকও উদাসীন থাকেন বিক্রিতে, কারণ টাকা তোলার ড্রাইভ তাঁর থাকার কথা নয়। কিন্তু আকর্ষণের দিকটা হল, এই সব ভুলে যাওয়া লেখাদের দল দুম করে কোথায় কবে বিখ্যাত হয়ে উঠবে ও পরিণত হবে কাল্টে, কেউ জানে না।
একটা উদাহরণ দিই। প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, আমাদের সময়কার অলোকসামান্য কবি। কিন্তু ‘বালি ও তরমুজ’-এর মতো অসাধারণ একটা কবিতার বইও সমসময়ে জনপ্রিয় হয়নি। প্রসূন দীর্ঘ বিরতি নিয়ে ফিরলেন এবং ম্যাজিশিয়ানের টুপির ভেতর হাত ঢুকিয়ে খরগোশ বার করে আনার অনায়াস নৈপুণ্যে উপস্থিত করলেন উত্তর কলকাতার কবিতা, যা কিংবদন্তিতে পরিণত হতে সময় লাগেনি বেশি। কিন্তু অবাক করা কাণ্ড হল, তারই কিছুদিন বাদে দেখি আমাদের বন্ধুবান্ধবদের হাতে হাতে ঘুরছে ‘বালি ও তরমুজ’। কী ব্যাপার? প্রসূনকে কি পুনরাবিষ্কার হল, নাকি এ নিছকই হুজুগ? আমাদের বন্ধুরা নিজেদের মধ্যে রসিকতার ছলে বলাবলি করে যে বাংলা কবিতায় নানা রকম কাল্টের যুগ আসে। নব্বই দশকের জয় গোস্বামী সম্পর্কিত হাজারো প্রবাদ–রূপকথা ও বাংলা কবিতায় তাঁর প্রভাব পেরিয়ে এসে আমরা ভাস্কর চক্রবর্তীর কাল্ট দেখেছিলাম। তারপর দেখলাম প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়কে। এখন শম্ভু রক্ষিত ও বীতশোক ভট্টাচার্যকে নিয়ে চর্চা হচ্ছে। যেটা বলার, ভাস্কর, শম্ভু বা বীতশোক কিন্তু সমসময়ে জনপ্রিয়তা পাননি। শেষের দুজন তো একেবারেই পাননি, একটা খুব ছোট গোষ্ঠীর মেধাবী নির্জনতার মধ্যে তাঁরা স্বস্তিতে ছিলেন। হঠাৎ করেই যেন বা জনপ্রিয় হলেন। তাঁদের অগ্রন্থিত কবিতা, গদ্যের কালেকশন পরের পর বেরতে শুরু করল। আবার অদ্ভুতভাবে, সমপরিমাণ মেধা ও ক্ষমতা নিয়েও কেদার ভাদুড়ী জনপ্রিয় হলেন না। হলেন না আরও অনেক ভাল কবি-লেখক। ছাদের বাগান আয়ু পেল, তবু সব ফুল নয়।
এই অনিশ্চয়তা, রোগা মানুষদের ব্যক্তিগত বিষণ্ণতা। সে খেলতে নামছে এটা জেনেই যে নিরানব্বই শতাংশ সম্ভাবনায় মাঝপথে ফাউল খাবে। তবু খেলার ধর্মে মাঠ অবিচল। সোশাল মিডিয়া এসে ব্যাপারটা আরও ঘেঁটেছে। এখন বহু ক্ষেত্রেই তরুণ লেখক বা কবির বই বিক্রি হয় ব্যক্তিগত যোগাযোগের সূত্রে। তিনি সোশাল মিডিয়াতে কত অ্যাক্টিভ তা একটা গুরুত্বপূর্ণ হিসেব। আবার পঞ্চাশ কপি বই বিক্রি করেই পরবর্তী এডিশনের ঘোষণা অথবা বইমেলাতে সব বই নিঃশেষিত হবার কাড়া-নাকাড়া, এই প্রয়াসকাতর ছায়াচ্ছন্নতায় আমাদের গুলিয়ে যায় পাঠক কাকে মনে রাখলেন, আর ভুললেন কাকে। বহু অলেখক লেখক হলেন, কবিতার ন্যূনতম কাঠামো না বুঝে লেখা কবিতা হল বেস্টসেলার, এমন সব বইয়ের যাদের পেছনে কিন্তু কনভেনশনাল অর্থে প্রতিষ্ঠান ছিল না। ছিল ভিড়, অন্ধত্বে দুর্নিবার। কে বেশি বিপজ্জনক ছিল, কে বলবে?
আবার বিচিত্র নিয়মে মাথায়ও তুলে নেয় মানুষ। বিজয়গড়ের বর্ণনা প্রেসের অন্ধকারে ডাই করে ফেলে রাখা অনুজপ্রতিম সাহিত্যিকের ‘গদ্যলেন’ হাতে তুলে দেখেছি কী ঐশ্বর্যময় তার সমারোহ, এবং বিষণ্ণ হয়েছি কেন এ বইকে শুধুমাত্র অপ্রাতিষ্ঠানিক হওয়ার কারণে ভুলে যাবে মানুষ। তারপর চুপিচুপি ব্যাগে পুরে নিয়েছি এক কপি। কিছুদিন পর থেকে লক্ষ করলাম, বইটা কাল্ট হয়ে উঠছে। এতে আমার হর্ষ হবে না? আমরা সবাই তো একই অনিশ্চয়তার ভেলায় যাত্রী ছিলাম, কাজেই তার বসন্তে আমার উদযাপন। সেই নিয়মে দেখেছি তমোঘ্ন মুখোপাধ্যায়, জগন্নাথদেব মণ্ডল, কুণাল বিশ্বাস, স্বর্ণেন্দু সেনগুপ্তদের মত মেধাবী নির্জনদের পঠিত হতে, তাদের উজ্জ্বল অজস্র সম্ভার ফেসবুকের মাধ্যমেই আমাদের কাছে প্রথমে এসেছিল। লুৎফর রহমানকে পুনরাবিষ্কার করেছি, হয়ত বহু পাঠকই করেছেন, সোশাল মিডিয়ার কল্যাণেই। কাজেই এখানেও অনিশ্চয়তা। সে কাকে ফেলবে আর কাকে তুলবে, যোগ্যকে রাখবে না অযোগ্যকে, তার কোনও সহজ পাটিগণিত নেই।
কিন্তু সেই ভেবে তো আমরা লিখতে আসিনি ! তাহলে তো বাণিজ্যিক পত্রিকাতেই লিখতাম না কি? আমরা চেয়েছিলাম ছাপার অক্ষরে নিজেদের নাম দেখতে। একটু খ্যাতি ও পরিচিতি অতি সংকোচে গোধূলিতে চুরি করা একমুঠো সূর্যালোকের মত হাতের মুঠোয় ধরতে চেয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু মুষ্টির বহরও তো জানাই ছিল আমাদের। চাইনি তা দিগন্তে প্রসারিত হোক। একটু বয়েস হতেই বুঝে গেছিলাম আমাদের পাঠকসংখ্যা তিরিশ কি পঞ্চাশের ওপর যাবে না। আর সেই নিয়ম মেনেই খেলতে এসেছিলাম। এ-ও জেনেছি যে সেই তিরিশজন পাঠককেও আমরা খুঁজে পাব না। জানব তাঁরা আছেন, অগম্য থাকবে তবু তাঁদের বাসগৃহ। ধ্যানবিন্দুতে ভয়ে ভয়ে গিয়ে হয়ত শুনব পঁয়ত্রিশ কপি বিক্রি হয়েছে সারা বছরে। আরিব্বাস, তিরিশ ভেবেছিলাম, পাঁচজন বাড়তি? এবারে আমার অমর হওয়া আটকাতে পারবে না কেউ। এটুকুই আমাদের দিনান্তের খুদকুঁড়ো। নাস্তিকের হৃদয়, সন্তানের মুখ !

আবার দুম করে পাঠক ভেসে ওঠেন, যেভাবে ভাসানপ্রতিমার স্থির মুখ অন্ধকার কুয়াশার নদীতে দেখা দেয় আচমকা। শান্তিপুরের একটি সাহিত্য অনুষ্ঠানে গিয়েছিল এক গল্পকার। তার প্রতি বইয়ের গড় পাঠক-সংখ্যা কখনও পঁচিশের বেশি ওঠে না। কেউ আলোচনা করে না তার গল্প নিয়ে কোথাও। কোনও উজ্জ্বল সেমিনার অথবা ফেসবুকের পাতায় যশোদীপ্ত সাহিত্যিক তার প্রশংসা করেননি। সে মাঝে মাঝেই ফ্রাস্ট্রেটেড হয়েছে। হ্যাংলার মত পুরস্কারের দিকে তাকিয়ে ভেবেছে আমারও চাই, তারপর হালকা হেসে নিজের মনেই মাথা নেড়েছে। যাই হোক, শান্তিপুরের অন্যতম লিটল ম্যাগাজিন পাবার দোকান হল একটি পান বিড়ির দোকান, যেখানে কলকাতার বহু লিটল ম্যাগ আসে। দোকানের মালিক সুবীর দাস প্রতি বছর নিজের বাগানে দোল উৎসব করেন, সম্পূর্ণ নিজের খরচায় একটি সাহিত্য পুরস্কারও দেন। তাঁর বাড়ির মানুষেরা মিলে একসময়ে রীতিমতো ভাল মানের একটি পত্রিকা বার করতেন। এই পর্যন্ত শুনেই শিহরিত হবার কথা ছিল, কিন্তু গল্প তার পরে কিছু বাকি আছে। সেই অনুষ্ঠানে গল্পকারের সঙ্গে আলাপ হল এক ছাপোষা মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোকের। মলিন জামাকাপড় পরা। বিড়ি খাচ্ছেন খুব। পরবর্তী কথোপকথন এরকম–
‘দাদা আপনি কলকাতায় থাকেন? কোথায় যেন দেখেছি।’
‘রাস্তাঘাটে দেখে থাকবেন হয়ত।’
‘না সল্টলেক এএমআরআই-এর কাছে আসেন কি? হাসপাতালের পাশের ওষুধের দোকানটা দেখেছেন? ওখানে আমি খাতা লিখি। হয়ত দেখেছেন, খেয়াল নেই। তবে আপনার বই কিন্তু আমি পড়েছি।’
‘তাই? কোথায় পড়লেন?’
‘ধ্যানবিন্দু থেকে কিনেছিলাম। আপনার (…) গল্পটার সঙ্গে অসীম রায়ের একটা গল্পের মিল খুঁজে পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম দেখা হলে জিজ্ঞাসা করব। ভালই হল, আলাপ হয়ে গেল।’
এই অবিশ্বাস্য পাঠকের সামনে দাঁড়িয়ে লেখা নতজানু হয়। মনে হয়, মহান অনিশ্চয় নশ্বরতাকে অতিক্রম করুন। (চলবে)
*পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ২১ নভেম্বর ২০২২
*ছবি সৌজন্য: Flickr, The Indian Express
শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৮২ সালে কলকাতায়। প্রথম গল্প বেরিয়েছিল পরিকথা পত্রিকায়, ২০০৩ সালে। এ পর্যন্ত লিখেছেন সাতটি উপন্যাস ও প্রায় চল্লিশটি ছোটগল্প। মূলত লিটল ম্যাগাজিনই তাঁর লেখালেখির জায়গা। এ পর্যন্ত পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।