ঋতু পরিবর্তনের এই সময়টায় ছোটো থেকেই দেখে আসছি রোগের প্রাদুর্ভাব। বসন্ত-গ্রীষ্ম আর বর্ষা-শরৎ সন্ধিক্ষণকে শাস্ত্রে বলে ‘যমদংষ্ট্রা।’ অর্থাৎ এই সময় মানুষের চরম রোগব্যধির ফলে মৃত্যুমুখে পড়াটাও বিচিত্র নয়। এ হল আমাদের গরমের দেশের কড়চা। শীতলামঙ্গলেও আছে শীতলাদেবীর মাহাত্ম্যকীর্তন। আজও তাই খাস কলকাতা শহরেও গ্রীষ্মের দাবদাহে দেবী শীতলাকে তুষ্ট রাখার জন্য ষোড়শোপচারে পুজো হয়। সাধারণত লোকসমাজে বসন্ত, হাম প্রভৃতি স্ংক্রামক অসুখের কবলে যাতে না পড়তে হয়, তাই শীতলাকে তুষ্ট রাখা হয়। বৌদ্ধতন্ত্রে দেবী হারিতী আর আমাদের শীতলা নাকি একই। পুরাণমতে ইনি যক্ষিণী। নেপালের বুদ্ধমন্দিরে হারিতীদেবীর পূজা হয়। ইনিই দক্ষিণভারতের শীতলাম্মা। এইভাবে দেবী নানা রূপে আমাদের ঘরের একজন হয়ে উঠেছেন। সারাবছর তাঁকে খুশি করার চেষ্টায় আমরা নানাবিধ ব্রত পালন করি।
শাস্ত্রে আছে “সৈষা প্রসন্না বরদা নৃণাং ভবতি মুক্তয়ে” অর্থাৎ তিনি প্রসন্ন হলে মানুষকে মুক্তিলাভের জন্য অভীষ্ট বর প্রদান করেন। তবে শাস্ত্রে যখন এসব বলা হয়েছিল তখন রোগবালাইয়ের ওষুধপালা বেরোয়নি। ধর্মভীরু মানুষ একদিকে জ্বরাসুর প্রতিরোধে শীতলাপুজো অন্যদিকে আজ রেঁধে কাল জল ঢালা বাসি পান্তাভাত, টক দই, চালতার টক এসবের ওপরই ভরসা করত। চড়ক পেরুতেই চৈত্রে বাসন্তী চৈতালী দুর্গার পুজো। এগুলো এখনও হয়। শরৎকালীন দুর্গাপুজোর কারণও অনেকটাই তাই। নবপত্রিকা স্নানে ব্যবহৃত ন’টি সবুজ উদ্ভিদ তো রোগের প্রতিষেধক ন’রকমের ওষধি বলেই জানি। কিন্তু ২০২০-তে এসব তাবিজ-কবচ-সুরক্ষা, জ্যোতিষীর মাদুলি, যাগযজ্ঞ, শাস্ত্রের বচন, নিম-নিশিন্দে-তুলসি সেবন, ফিনাইল-ন্যাপথলিন, ধূপধুনো সবকিছুকে ঘোল খাইয়েছে এক অতি ক্ষুদ্র ভাইরাস।
মশা-মাছি রসাতল, করোনা আরও ভয়াল।
গরম পড়ার আগেই “ফাগনে মাছি দু’হাত দিয়ে বাছি” থেকে বাঁচতে আমাদের তাবড় সচেতনতাকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে করোনাসুর থাবা বসিয়েছে। শুধু গ্রীষ্মপ্রধান দেশগুলোতেই নয়, সারা বিশ্বে। এমনকি তার সূচনা ঠান্ডার দেশেই! তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছে আমাদের নিমঝোলের মাহাত্ম্য। কাঁচা হলুদের ভরসা। চব্যনপ্রাশের অনন্তকালের অপার মহিমা। কলমিশাকের নরম আশীর্বাদ। আজ আমরা বড় অসহায়। কিস্যুটি হবে না এসবে যতক্ষণ না টীকা বেরুবে। বিজ্ঞানে আস্থা রাখতে হবে।
এইসময় আমরা দেখেছি হাম-বসন্ত। শুনেছি ঠাকুমা-দিদিমার মুখে কালাজ্বর আর প্লেগের গল্প। মন্বন্তরের দুর্বিষহ করুণ কাহিনি। শুনেছি রান্নাঘরের নর্দমার মুখে ভাতের ফ্যান খেয়ে বেঁচে থাকা মানুষের কথা। কিন্তু আজ সবাইকে গোল দিয়েছে করোনা। সে আরও মারাত্মক। তার আক্রমণে দেহের উপসর্গ অতি সাধারণ! কিন্তু যার তাকে নিজের শরীরে বরণ করে নেওয়ার ক্ষমতা নেই, অর্থাৎ চিকিৎসা পরিভাষায় যার ‘ন্যাচারাল ইমিউনিটি’ কম, সে ভালনারেবল। এই কি তবে ঘোর কলিতে কল্কির অবতরণ হল সারাবিশ্বে? মহামারী থেকে অতিমারী কি এরই নাম?
কলকাতা করোনা কথা- ১
১৯শে মার্চ, ২০২০
“অভিজাত না হাতি ”
আমাদের পন্ডিতিয়ার অভিজাত আবাসন ওয়েসিসের ট্যাগলাইন “প্রমিস অফ পিস।” নামেই অভিজাত, নামেই শান্তি সেখানে অবিশ্যি। থাক সে পরের কথা।
সেখানে প্রচুর লোকের বসবাস। আমরা বাঙালিরা সেখানে সংখ্যালঘু। শুধু অরুণিমা দে-কে দোষ দিয়ে লাভ নেই। অক্সফোর্ড থেকে ফেরা তাঁর পুত্রটি প্রথম করোনা আক্রান্ত কলকাতায়। গতকাল সন্ধেয় জানা গেল ওয়েসিসে দু’জন অবাঙালীর পুত্র ১৩ই মার্চ বিদেশ থেকে ফিরেছে। এই ডামাডোলের বাজারে তাদের এয়ারপোর্টে টেস্ট করা হল কিন্তু কিছুই ধরা পড়ল না। তাদের হোম আইসোলেশনে থাকতে বলা হল। তারা কথা শুনল না। যত্রতত্র ঘুরে বেড়াল। ধরুন তারা ফ্লাইট থেকে নামার আগেই প্যারাসিটামল, অ্যান্টি অ্যালারজিক গোছের ট্যাবলেট খেয়েছে। তাই সেখানে তাদের কোনও উপসর্গ দেখা গেলনা। এবার তারা বেরিয়ে দপদপিয়ে গাড়ি চেপে আবাসনে ঢুকে এল। লিফট ব্যাবহার করল। এতগুলো মানুষের মধ্যে চলে এল।
তার দিন পাঁচেকের মধ্যেই এদের একজনকে ১৭ই মার্চ করোনার উপসর্গ দেখে বেলেঘাটা আইডি-তে ভর্তি করা হল। জানা গেল সে পজিটিভ। সে নাকি কথা শুনছিল না! সে আমাদের বাংলায় দ্বিতীয় পজিটিভ কেস হল। তার দাদু দিদিমাকেও রোগটি দান করেছে সেই ছেলে। তাঁরাও কোয়ারান্টাইন ও সেখান থেকে বেলেঘাটায় ভর্তি হলেন। হোম মিনিস্ট্রি থেকে এসে তার বাবা-মাকে গৃহবন্দি করেছে। স্বাস্থ্য দফতর জানিয়ে গিয়েছে, আবাসনে কোনও কাজের লোক ঢুকবে না।অন্য ছেলেটি এখনও হোম আইসোলেশনে। ঈশ্বর ওদের মঙ্গল করুন। সুস্থ করুন। বাকি আর একজনের কথা জানতে চাইলেও প্রথমে সবাই চুপচাপ ছিল। পরে জোরাজুরিতে বেরুলো যে সে পর্যবেক্ষণে আছে।
আচ্ছা এতে রাখঢাকের কী আছে মশাই? রোগ হলে হবে, হয়েছে। স্বীকার করুন। সবার বাড়িতে আমাদের বুড়োমানুষেরা আছেন, হাইপারটেনশন, ডায়াবেটিসে ভোগা প্রচুর মানুষ রয়েছেন। আমাদের লিফট ইত্যাদি পরিষ্কার করা হচ্ছে সর্বক্ষণ। কিন্তু সেই ছেলেগুলি গায়ের জোরে আবার ঢুকে পড়বে না তো? সারাক্ষণ স্যানিটাইজেশন চলছে। পেপারওয়ালা, পুজোর ফুল, দোকান থেকে কয়েন ফেরত নেওয়া, স্যুইপার, মালি, ড্রাইভার সব বন্ধ করে আমরা হোম কোয়ারান্টাইনে রয়েছি। কিন্তু অবোধ এই বালকেরা? এরা এত অবাধ্য? প্লিজ কথা শুনুন সবাই। রোগ লুকোবেন না। রোগ ছড়াবেন না।
বিদেশ-ফেরতদের বাড়িতে না ফিরিয়ে সরকারি ব্যবস্থায় আইসোলেশন ও নজরদারিতে রাখার আর্জি জানাই। দরকারমতো টেস্ট হোক।তবে ঘরে ফেরত নয় মোটেও। ধুর মশাই! মুখ্যমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর এসব বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদিয়ে ফেসবুকে স্টেট্যাস দিচ্ছে F*** Corona ! অথবা ধুর বা*, আমার করোনা হবে না। এদের নিয়েই তো জ্বলছে বালিগঞ্জ থেকে বসিরহাট, উপহার থেকে ওয়েসিস। অথচ সাবধানীরা নিরূপায়।
কলকাতা করোনা কথা – ২
২০শে মার্চ ২০২০
“কারও পোষমাস কারও সব্বোনাশ”
আজ বিকেল থেকেই বিনা নোটিসে আমাদের ওয়েসিস আবাসনে বহিরাগত অর্থাৎ কাজের লোক, ড্রাইভার, সবাইকার প্রবেশ নিষিদ্ধ হল। সার্ভেন্টস কোয়ার্টারে যারা থাকে তাদেরও বাড়ি ফিরে যেতে বলা হল। এবার ১৫০০ লোকের মধ্যে অনেক বুড়োবুড়ি আছেন যাদের দু’বেলা সেন্টারের আয়ামাসি বরাদ্দ। তারা কী করবে? অশীতিপর পঙ্গু মানুষেরা সম্পূর্ণ নির্ভরশীল এই আয়াদের ওপর। সেই মওকায় আমাদের স্থানীয় কাজের লোকেদের দই নেপোয় মারল। কেউ মজায় দেশ পালাল, কেউ ঘরেই টিভি দেখতে থাকল।
কিন্তু আমার কষ্টটা অন্যখানে। শিক্ষিত নাগরিক, যাঁদের ছেলেপুলেরা বিদেশে থাকে, সেই বাপমায়েরা এখনও ত্রেতাযুগে পড়ে আছেন। দ্বিতীয় করোনা পজিটিভ বেরুনো আর একজন ঘাপটি মেরে ঘরে পড়ে থাকা সত্ত্বেও হাউজিং সোসাইটি ফিজ্যিকালি মিটিং ডাকে। অনলাইন এঁদের মাথায় ঢোকে না। মানতেও চান না। এই যদি কোনো “বাঙালি”র দেহে করোনা পজিটিভ হত, তাহলে বোধহয় সব বাঙালিকেই তাড়িয়ে ছাড়ত আবাসন থেকে। কী পরিহাস ভাগ্যের, তাই ভাবছি। এর নাম অভিজাত আবাসন, যেখানে বছর না ঘুরতেই পলাস্তরা খসে শ্রীহীন হয়ে যায় বাড়ি। যাইহোক, আপাতত আমি আর আমার পরিবার বাড়ির মধ্যে বন্দি। সব কাজের লোক, মালি এবং জমাদারের ছুটি।
ঘুম ভাঙলেই ব্রতচারীর স্রষ্টা গুরুসদয় দত্তের অমোঘ বাণীকে পাথেয় করে বলে উঠছি,
“লাগো কাজে কোমর বেঁধে খুলে দেখ জ্ঞানের চোখ,
কোদাল হাতে খাটে যারা তারাই আসল ভদ্রলোক।”
ড্রিল শুরু হবার আগে ইশকুলের পাঠ ছিল এমন । তারপরেই সম্মিলিত ভাবে বলতে হত…
“চল কোদাল চালাই।
ভুলে মানের বালাই
ফিরে অলস মেজাজ
হবে শরীর ঝালাই।
যত ব্যাধির বালাই,
বলবে পালাই পালাই
পেটে খিদের জ্বালায়
খাব ক্ষীর আর মালাই”
নাহ, কাজে ভয় পাই না, যতক্ষণ শরীর চলছে ঠিকঠাক।
কলকাতা করোনা কথা – ৩
২১শে মার্চ ২০২০
“কেউ কেউ কথা শুনছে না”
গতকাল থেকেই সম্পূর্ণ হোম কোয়ারান্টিনে রয়েছি আমরা। সমাজবন্ধুদের থেকে সম্পূর্ণ পৃথকীকরণে। কাউকে বাড়ির বাইরে বেরুতেও দেওয়া যেমন হচ্ছে না, তেমনি কাউকে ঢুকতেও দেওয়া হচ্ছেনা কমপ্লেক্সে। অসুবিধে নেই। যে যার মত হাতেহাতে কাজ করে নিচ্ছি। কাজের অভ্যেস আছে। সারা বিশ্বের বৃহত্তম স্বার্থে এইটুকুনি ক্ষুদ্রতর স্বার্থ বিসর্জনে আপত্তি নেই।
কিন্তু আজ ভোরে উঠেই দেখলাম সিকিউরিটিদের ওপর একদলের চোটপাট, হুজ্জুতি। মাথাটা গরম হয়ে গেল। তাঁরা ক্ষমতাশালী। তাঁদের অনেক প্রভাব। তাঁদের লোকে “আমলা” তকমা দেয়। তাঁদের লালবাত্তি গাড়ির আলো দেখলেই কেমন ভয় হয় সাধারণ মানুষের। তাঁরা আইন ভাঙেন। আইন গড়েন। তাঁরা সাধারণ লোকজনের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখেন। তৃতীয় এবং চতুর্থ শ্রেণীর লোকজন তাঁদের সমীহ করে চলে। বাইরে ছদ্ম-গাম্ভীর্য, ভেতরে তিমির অবগুন্ঠনে তাঁদের সীমাহীন অজ্ঞানতা, মূর্খতা।
উপহার আবাসনের অরুনিমা দে-র পর ওয়েসিস আবাসনের এক উচ্চপদস্থ প্রভাবশালী এমন আরও একজনের বাড়ির কাজের লোক বলে কথা! কিং ক্যান ডু নো রং। অতএব ঢুকতে দিতেই হবে বাইরের লোক। তাঁর গোয়ালা গোয়াল থেকে কাঁচা দুধ সমেত দুটি বিশাল ক্যান নিয়ে লিফট চড়ে বাড়ি বাড়ি দুধ দিল। ট্রেনে করে কাজের লোক এল। তাঁর চোখরাঙানিতে লালবাত্তি গাড়ির আলোর জোরে চারজন সিকিউরিটি কেঁচোর মত কুঁকড়ে গেল ভয়ে। খুলে গেল গেট। স্যানিটাইজ করে তাঁর কাজের লোককে ঢুকিয়ে দিয়ে তিনি চলে গেলেন।
টিভি খুলেই শুনি ততক্ষণে তৃতীয় করোনার কেস কলকাতায়। আবার ওদিকে বসিরহাটের ডাক্তারবাবুও চুপিচুপি বিদেশ থেকে ফিরে নিজেকে আইসোলেট না করে সার্জারি করলেন হাসপাতালে গিয়ে। এঁরা কি শিক্ষিত? লজ্জা করছে। এদিকে আবাসনে এখন মশা নিধন যজ্ঞ চলছে। কদিন পরে হবে রুদ্রাভিষেক। সবার বিশ্বাস, মশা নিধনের কেমিকালের ধোঁয়ায়, যজ্ঞের ধোঁয়ায় করোনা ভাইরাস মরবে। তখনই মনে পড়ে স্বামীজির কথা। অশিক্ষা আর কুশিক্ষাই আমাদের অগ্রগতির বাধা।
করোনা কলকাতা কথা- ৪
২২ শে মার্চ ২০২০
আজ সারা দেশ জুড়ে জনতা কারফিউ। সারা দেশের মানুষ আজ সকাল ৭টা থেকে রাত ৯টা অবধি গৃহবন্দি থাকার কথা। কিন্তু হা হতোস্মি! সারা দেশবাসী যখন করোনাসুরের কুশপুত্তলিকা দাহ করতে উদ্যত ঠিক তখুনি আইন ভাঙার দৃশ্য দেখে গা গুলোতে থাকে। যেসব অর্ধশিক্ষিত মানুষজনের কোনও হেলদোল নেই, তাদের দেখে মনে হয় কোনও কমিউনিটি আবাসনে তাদের থাকার কোনও অধিকার নেই। তারা বনে গিয়ে বাস করুক। সেখানেই তাদের নিত্য প্রয়োজনীয় পরিষেবা অব্যাহত থাক। ১৫০০ জন মানুষের স্বার্থে যখন তারা গায়ের জোরে আইন ভাঙছে তখন তাদের জোর করে গৃহবন্দি করা হোক। আমরা স্টেজ থ্রিয়ের দিকে এগুচ্ছি ক্রমাগতঃ। বিভীষিকার পারদ উঠছে আমাদের ভয়ের থার্মোমিটারে।
আজ খুব জরুরি ছিল জনতা কারফিউ। এবং আরও সপ্তাহ দুয়েক দরকার এমন। সব মানুষের স্বার্থে। যেন বনধের আবহাওয়া আমার পাড়ায়। কিন্তু তার আগের দিন? ওব্বাবা! গতকাল মাংসের দোকানে সারা সন্ধে লাইন পড়েছিল। মানুষ ঘেঁষাঘেঁষি করে মাটন কিনেছে বন্ধের বাজারে ঘরে বসে মস্তিতে মাংসভাত গিলবে বলে? ছিঃ! আপনাদের নোলা মশাই করোনাসুরের চেয়েও বেশি বোধহয়। থুতু ফেলা এখন বারণ, নয়তো ফেলে আসতাম ঐ শ্রাদ্ধের মাংসভাতে। গতকাল রাতে এক বন্ধু ফোন করলেন। তিনি মদে চুর। জব্বর প্ল্যান দিলেন বেড়ানোর। মশাই! আপনার ডিগ্রিগুলি পুড়িয়ে ফেলুন দয়া করে। আপনাকে বাতিল করলাম আমার বন্ধুবৃত্ত থেকে।আমাদের ঘটি-বাড়িতে একটা কথা বলে “ঢেউচালানি।” মানে ঘরে যাদের মন বসে না। আপনি মশাই সেই ক্যাটিগরিতে। ঘরে বসে প্রোডাক্টিভ কাজ করুন, নয়তো উচ্ছন্নে যান।
তার মধ্যে শুনি আবাসনের এক মহিলা চুপিচুপি বিউটিপার্লারের মেয়েকে দিব্য তাঁর বেডরুমে প্রবেশ করিয়েছেন। প্রৌঢ়ার বিউটিবিদুষীর দ্বারা একমাস ফেশিয়াল না করলে চামড়া ঝুলে যায়! তার অমন রূপের ক্যাঁতায় আগুন দিলাম। করোনার থাবা আমাদের দেশে তিন নম্বর পর্যায়ে পৌঁছবার আশঙ্কা শুরু হতেই আজ সকাল থেকে আমার হোয়াটস্যাপে, ফেসবুকে দেখছি নাস্তিকদের ধর্মভীরু হবার বন্যা। তাঁরা গদগদ হয়ে ঈশ্বরের কাছে কৃপা ভিক্ষা করছেন। আমি বাপু আস্তিক। আমাকে বোলও না তোমরা তোমাদের হয়ে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানাতে।
ওদিকে চিৎকার শুনে বারান্দায় গিয়ে দেখি পন্ডিতিয়া বস্তির একপাল ছেলেপুলে হাফপ্যান্ট পরে দেদার ফূর্তিতে ফুটবল খেলছে। শুনশান পথঘাট। এই ছেলেগুলোকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। আমাদের সর্ষের মধ্যেই ভূত। করোনার ভূত ঢুকে পড়েছে আমাদের ঘরে ঘরে।আর কবে সচেতন হব আমরা? ঘরে বাজার জমা করেছি, তবে তা দিন সাতেকের মত। চালডাল, শুকনো জিনিস দিন পনেরোর মত। এখন অল্প অল্প খাওয়াদাওয়াই ভালো। না হোক মুর্গী-মাটন-কোফতা-কালিয়া। ফেসবুকে দেখলাম অনেকে অনির্দ্দিষ্টকালের কারফিউতে আপত্তি জানিয়ে বলছেন, খাব কী তবে? জল খেয়ে থাকুন! পাড়ার দোকান থেকে বিস্কুট-মুড়ি কিনে খান! আপনি বাঁচলে বাপের নাম! নিকুচি করেছে খাওয়ার! করোনায় ধরলে জম্মের মত খাওয়ার দফারফা হয়ে যাবে জানেন না?
এদের জন্য উজাড় করে দিলাম একরাশ ঘৃণা! লজ্জা করছে আমার অন্ততঃ আপনারা আমার বন্ধু বলে। স্টেজ থ্রি পেরুক নির্ভাবনায়। ততক্ষণ চুপ করে থাকুন। ঘরে বসে থাকুন। গিলুন, নখ খুঁটুন, সিনেমা দেখুন। খেলা দেখুন! আর বিকেল পাঁচটায় শাঁখ, ঘণ্টা, ঢাক ঢোল যে যা পারেন বাজান। রণহুংকার ছেড়ে বারান্দা বা ছাদ থেকে বাজান, সঙ্ঘবদ্ধ হয়েও আলাদা আলাদা কিন্তু! বিপদের দিনে যে এমনি সিংহনিনাদের প্রয়োজন!
রসায়নের ছাত্রী ইন্দিরা আদ্যোপান্ত হোমমেকার। তবে গত এক দশকেরও বেশি সময় যাবৎ সাহিত্যচর্চা করছেন নিয়মিত। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায় এহং প্রথম উপন্যাস সানন্দায় প্রকাশিত হয়। বেশ কিছু বইও প্রকাশিত হয়েছে ইতিমধ্যেই। সব নামীদামি পত্রিকা এবং ই-ম্যাগাজিনের নিয়মিত লেখেন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, রম্যরচনা ও প্রবন্ধ।