বাংলা সবাক ছবির ৯২ বছরের ইতিহাসে তারকার ছড়াছড়ি সেখানে নারী-পুরুষ সমান সমান প্রমথেশ বড়ুয়া-কানন দেবী, উত্তম-সুচিত্রা-সুপ্রিয়া-সাবিত্রী, সৌমিত্র-শর্মিলা-মাধবী, শুভেন্দু-অপর্ণা, বিশ্বজিৎ-সন্ধ্যা, তাপস-মহুয়া-দেবশ্রী, প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণা-শতাব্দী কিন্তু এর পাশাপাশি বহু অভিনেতা-অভিনেত্রী, প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও নায়ক বা নায়িকা হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন অল্পই তাঁদের সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে সেকেন্ড লিড অথবা ক্যারেক্টার রোল নিয়েই 

এর কারণ অনেক কখনও বক্স-অফিসের দাবি, কখনও পরিচালক বা প্রযোজকের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ, কখনও বা অদৃষ্টের পরিহাস আজ কথা হবে বাংলা বাণিজ্যিক সিনেমার এমন কয়েকজন নায়িকাকে নিয়ে আলোচনার পরিসরকে ছোট রাখতে, বেছে নিয়েছি উত্তমকুমারের সময়কালটুকু (১৯৫২-৮০), মহানায়কের প্রথম সফল ছবি ‘বসু পরিবার’ থেকে তাঁর শেষ ছবি ‘ওগো বধূ সুন্দরী’ পর্যন্ত

বঙ্গদেশ থেকে যাঁরা বলিউডে পাড়ি দিয়েছেন, সেই মালা সিনহা, শর্মিলা ঠাকুর, রাখি গুলজার ও মৌসুমি চট্টোপাধ্যায় স্বাভাবিকভাবেই তালিকায় থাকছেন না প্রবাসী বাঙালি জয়া ভাদুড়িও বাদ বলিউড থেকে বাংলা ছবিতে আসা সব থেকে সফল নায়িকা তনুজাও ব্যক্তিগত পছন্দকেও দূরে ঠেলতে হল তাই বাদ অরুন্ধতী দেবী, মঞ্জু দে, সুমিত্রাদেবী এবং অনুভা গুপ্তা তবে কোনও তালিকাই পূর্ণাঙ্গ হয় না চলুন সেটে ঢোকা যাক  

Movie projector

প্রথম নাম লিলি চক্রবর্তী। প্রথম ছবি, প্রায় সাত দশক আগের ‘ভানু পেলো লটারী’। এখনও চুটিয়ে অভিনয় করছেন বড় ও ছোট পর্দায়। অথচ নায়িকার ভূমিকায় হাতে গোনা কয়েকটি ছবি। ‘কাঁচ-কাটা হীরে’, ‘কেদার রাজা’, ‘ভানু গোয়েন্দা জহর অ্যাসিস্ট্যান্ট’। তিনটি ছবি ‘দেয়া নেয়া’, ‘ফুলেশ্বরী’ ও ‘জন অরণ্য’ দেখার পর বলা যায় যে বাংলা ছবির সর্বকালের সেরা বৌদি লিলি চক্রবর্তীই। 

মঞ্চে লিলি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের নায়িকা হন ‘নামজীবন’ এবং ‘আত্মকথা’ নাটকে। তাঁর সাফল্যের চাবিকাঠি স্পষ্ট উচ্চারণ ও নীচু গ্রামের অভিনয়। এরই চূড়ান্ত রূপ দেখি লাবণ্য হিসাবে ‘শেষের কবিতা’ শ্রুতিনাটকে। এটি লং-প্লেয়িং রেকর্ডে বেরোবার পর বিপুল জন-সমাদর পায়।   

Lily Chakraborty
লিলি চক্রবর্তী

অভিনয়, সংগীত ও নৃত্যের ত্রিধারা এসে মিশেছিল রুমা গুহঠাকুরতার মধ্যে। এমন বহুমুখী প্রতিভা বাংলা ছবিতে আর আসেনি। অথচ নায়িকা হিসাবে সুযোগ পেয়েছেন অল্পই। অভিনেত্রী হিসাবে তাঁর বিস্তার বা রেঞ্জ ছিল বিশাল। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের নায়িকা হিসাবে তাঁকে পাই ‘পার্সোনাল  অ্যাসিস্ট্যান্ট’ এবং ‘আশিতে আসিও না’ ছবিতে। দ্বিতীয়টিতে, জাদুপুকুরে ডুব দিয়ে তাঁর বৃদ্ধা থেকে তরুণীতে রূপান্তর বাংলা হাসির ছবির এক চিরস্থায়ী ফ্রেম। অন্য দিকে স্বামী অরূপ গুহঠাকুরতার পরিচালনায় অভিনয় করেন দুটি সিরিয়াস ছবি ‘বেনারসি’ ও ‘পঞ্চশর’-এ। নায়ক ছিলেন যথাক্রমে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়। রুমার কৃতিত্ব, এর কাছাকাছি সময়েই তিনি শুভেন্দুর মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করেন ‘আরোগ্য নিকেতন’-এ। এর কিছু আগে, ১৯৬৩ সালে দিল্লি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘নির্জন সৈকতে’ ছবিতে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর শিরোপা হিসাবে রৌপ্য ময়ূর রুমা ভাগ করে নেন চার সহশিল্পীর সঙ্গে।

গানেও তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়া। তাঁর গাওয়া উল্লেখযোগ্য প্লে-ব্যাক ‘বাজে করুণ সুরে’ (মণিহারা), ‘চিনিতে পারিনি বঁধু’ (পলাতক), ‘শুক বলে সারী রে তোর’ (অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি)। কিশোর কুমারের সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে গাওয়া ‘এই তো হেথায় কুঞ্জছায়ায়’ (লুকোচুরি) ছায়াছবির গানের হল অফ ফেম-এ চলে গিয়েছে অনেকদিন। আর নাচের কথা উঠলে মনে পড়বেই ‘পলাতক’ ছবির ঝুমুরশিল্পী ময়নার কথা। 

আরও পড়ুন: নায়িকার আগে ছিলেন মানবতাবাদী

রুমারই সমসাময়িক, বাসবী নন্দী ছিলেন একাধারে অভিনেত্রী ও গায়িকা। নায়িকা হিসাবে তাঁর উল্লেখযোগ্য ছবি ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’, ‘সখের চোর’, ‘রাজা রামমোহন’ ও ‘রোদন ভরা বসন্ত’। উত্তমকুমার পরিচালিত ছবি ‘বনপলাশির পদাবলি’তে অসাধারণ অভিনয়ের জন্য বিএফজেএ-র তরফ থেকে পান শ্রেষ্ঠ সহ-অভিনেত্রীর সম্মান। এর পাশাপাশি মঞ্চ ও রেডিও নাটকে তিনি ছিলেন অত্যন্ত পরিচিত মুখ। হাতিবাগান থিয়েটার পাড়ায় তাঁর ‘শ্রীমতী ভয়ঙ্করী’র কথা আজও লোকের মুখে মুখে ফেরে। শ্যামল মিত্র, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, শৈলেন মুখোপাধ্যায়ের সুরে কিছু আধুনিক গানও গেয়েছিলেন তিনি। 

Ruma Guhathakurata & Basabi Nandi
সমসাময়িক দুই অভিনেত্রী রুমা গুহঠাকুরতা ও বাসবী নন্দী (ডানদিক থেকে)

অকালে চলে যাওয়া কাবেরী বসুর মতো মায়াভরা কণ্ঠ বাংলা ছবি বেশি পায়নি। ‘রাইকমল’ থেকে ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র জয়া ত্রিপাঠি, সেই পরিচয়ই বহন করেন। আর যে ছবিতে তিনি নির্বাক, সেই ‘শ্যামলী’ও সুপারহিট। কাবেরীর সৌভাগ্য, বেশিরভাগ ছবিতেই তাঁর নায়ক ছিলেন উত্তমকুমার। আর দর্শকদের দুর্ভাগ্য, তাঁর একেবারে শেষ দিকের ছবি ‘যে যেখানে দাঁড়িয়ে’র প্রিন্টই পাওয়া যায় না।  

বাংলা ছবির সেরা সুন্দরী কে, জিজ্ঞেস করলে অবশ্যই ভোট দেব কণিকা মজুমদারকে। সত্যজিৎ রায়ের ‘মণিহারা’, ‘চিড়িয়াখানা’, মৃণাল সেনের ‘পুনশ্চ’, অসিত সেনের ‘আগুন’, দীনেন গুপ্তর ‘বসন্তবিলাপ’প্রতিটি ছবিতেই তাঁর স্ক্রিন প্রেজেন্স ছিল অসাধারণ। জীবন সায়াহ্নে তিনি থাকতেন আলিপুরের কাছে এক বৃদ্ধাবাসে। দশ বছর আগে, সেখানে এই প্রতিবেদকের সুযোগ হয়েছিল তাঁর সাক্ষাৎকার নেওয়ার। উঠেছিল রেডিও নাটক ও উত্তর কলকাতার থিয়েটারের কথা। দুই মাধ্যমেই তিনি ছিলেন সমান দক্ষ।

সুমিতা সান্যাল তাঁর প্রথম ছবি ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’-এ নায়ক হিসাবে পান উত্তমকুমারকে। ‘দেয়া নেয়া’ আর ‘তিন ভুবনের পারে’ ছবিতে নায়িকা তনুজার পাশে তিনি ছিলেন সমান উজ্জ্বল। ‘কুহেলি’ এবং ‘সাগিনা মাহাতো’য় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল তাঁর। তবে বাংলার দর্শক তাঁকে মনে রেখেছেন ‘নায়ক’-এর প্রমীলা হিসাবেই। সেখানে তাঁর এক মুহূর্তের হাসি-কান্না, হীরা পান্না হয়ে ঝরে পড়ে বাংলা ছবির গয়নার বাক্সে। বাংলা ছবিতে নায়িকা হিসাবে বিশেষ সুযোগ না পেলেও ‘বলিউড’ সুমিতাকে দিয়েছিল দু’হাত ভরে। ‘আশীর্বাদ’-এ তাঁর নায়ক ছিলেন সঞ্জীবকুমার, ‘আনন্দ’-এ অমিতাভ বচ্চন।

3 actresses of Bengali cinema
তিন নায়িকা- কাবেরী বসু, সুমিতা সান্যাল, কণিকা মজুমদার (বাঁ-দিক থেকে)

১৯৬৬ থেকে ১৯৭৩, উত্তমকুমারের ছ’টি ছবির নায়িকা ছিলেন অঞ্জনা ভৌমিক। সব কটি সুপারহিট। ‘নায়িকা সংবাদ’-এর উর্মিতা স্টেশনমাস্টার ঘরণির আটপৌরে জীবনেই খুঁজে পায় অমৃতের স্বাদ। ভুলব কেমন করে ‘চৌরঙ্গী’র হাসিখুশি এয়ারহোস্টেস সুজাতা মিত্রকে? ‘শুক-সারী’র গ্রাম্য বধূ থেকে ‘কখনও মেঘ’-এর আধুনিকা সব চরিত্রেই তিনি সাবলীল। উত্তমকুমার ছাড়াও নায়ক হিসাবে পেয়েছেন বসন্ত চৌধুরী (‘দিবারাত্রির কাব্য’) এবং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে (‘মহাশ্বেতা’)। অঞ্জনা আজ অভিনয় জগৎ থেকে দূরে থাকলেও তাঁর কন্যা নীলাঞ্জনা একাধারে অভিনেত্রী ও নানা টিভি অনুষ্ঠানের প্রযোজক। জামাই যিশু সেনগুপ্ত বড় ও ছোট পর্দায় সমানভাবে সফল।

প্রথম ছবিতেই উত্তম-সৌমিত্রর নায়িকা। ১৯৭২ সালে ‘স্ত্রী’ ছবিতে এমনই বিরল নজির গড়েন আরতি ভট্টাচার্য। এর পর তাঁকে নায়িকা হিসাবে পাই ‘পিকনিক’, ‘প্রেয়সী’, ‘অসাধারণ’, ‘জাল সন্ন্যাসী’, ‘জোব চার্নকের বিবি’র মতো ছবিতে। নেগেটিভ রোলেও আরতি তাঁর দক্ষতার পরিচয় রাখেন ‘আমি সে ও সখা’ ও ‘জন অরণ্য’তে। অভিনয়ে অবশ্য তিনি আগে ব্রেক পান মঞ্চে, ‘নহবত’ নাটকে, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৌজন্যে। ব্যক্তিত্ব ও প্রতিভার সঠিক মিশেল থাকা সত্ত্বেও, টলিউড আরতিকে যোগ্য স্বীকৃতি দেয়নি। তাই খ্যাতির মধ্য গগনেই তিনি বিয়ে করে স্থিতু হন মুম্বইয়ে। ভোজপুরি ছবির জগতে চিত্রনাট্যকার হিসাবেই এখন তিনি বেশি পরিচিত।

Anjana Bhoumick & Arati Bhattacharya
ব্যক্তিত্ব ও প্রতিভার মিশেল— অঞ্জনা ভৌমিক ও আরতি ভট্টাচার্য

সাত আর আটের দশকের আর এক জনপ্রিয় অভিনেত্রী মিঠু মুখোপাধ্যায়েরও ঠিকানা এখন মুম্বই। পঞ্চাশ বছর আগে ‘মর্জিনা আবদাল্লা’ ছবিতে ‘বাজে গো বীণা’ এবং ‘হায় হায় প্রাণ যায়’ গানের সঙ্গে তাঁর নাচ ঝড় তুলেছিল বাঙালি দর্শকের হৃদয়ে। এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, মহুয়া রায়চৌধুরী ও দেবশ্রী রায়ের আগে মিঠুই ছিলেন বাংলা ছবির শ্রেষ্ঠ নৃত্যশিল্পী। এর সঙ্গে যোগ করুন তাঁর কণ্ঠসম্পদ। তাঁর সুমিষ্ট সংলাপে সমৃদ্ধ হয়েছে ‘মৌচাক’, ‘স্বয়ংসিদ্ধা’, ‘নিশিকন্যা’, ‘হোটেল স্নোফক্স’-এর মতো ছবি। মিঠু-রঞ্জিত মল্লিক জুটি এক সময় ভীষণ জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু আটের দশকে মিঠু-জয় সেনগুপ্ত জুটি সেভাবে দর্শক আনুকুল্য পায়নি। আবার ন’য়ের দশকে ‘আশ্রিতা’ ছবিতে কনওয়ালজিতের সঙ্গে জুটি বেঁধে মিঠু প্রমাণ করেন ‘এভাবেও ফিরে আসা যায়’, আর তার পরেই চলে যান স্বেচ্ছা-নির্বাসনে। 

লিলি চক্রবর্তীর মতোই নিচু গ্রামে অভিনয় পছন্দ সোমা দে’র। নায়ক হিসাবে পেয়েছেন শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়, শমিত ভঞ্জ, দীপঙ্কর দে’কে। ‘জন্মভূমি’, ‘বিল্বমঙ্গল’, ‘বারবধূ’, তাঁর চরিত্রগুলিকে জড়িয়ে থাকে এক ধরনের বিষণ্ণতা। আবার তাঁকে কিছুটা হালকা মেজাজে পাওয়া যায় ‘হারায়ে খুঁজি’ বা ‘সেলাম মেমসাহেব’ ছবিতে।  ‘এক আকাশের নীচে’, ‘যমুনা ঢাকি’, ‘জগদ্ধাত্রী’-র মতো টেলিসিরিয়ালের মাধ্যমে আজও অভিনয় জগতের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ অটুট। 

বক্স আইটেম

অন্যান্য নায়িকা ও তাঁদের উল্লেখযোগ্য ছবি

সুলতা চৌধুরী — শেষ পর্যন্ত, নতুন তীর্থ

তন্দ্রা বর্মণ —  অতল জলের আহ্বান, এক টুকরো আগুন

ললিতা চট্টোপাধ্যায় — বিভাস

রিনা ঘোষ — রাজকন্যা

নন্দিনী মালিয়া — ছুটি, মাল্যদান

জুঁই বন্দ্যোপাধ্যায় — ননীগোপালের বিয়ে

সোনালি গুপ্ত বসু — প্রথম প্রতিশ্রুতি, এক যে ছিল দেশ

গায়ত্রী মুখোপাধ্যায় — সমাধান 

শকুন্তলা বড়ুয়া — সুনয়নী

 

 

 

ছবি সৌজন্য: Wallpaper Flare, Istock

দু’দশক ইংরেজি সংবাদপত্রের কর্তার টেবিলে কাটিয়ে কলমচির শখ হল বাংলায় লেখালেখি করার। তাঁকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন কয়েকজন ডাকসাইটে সাংবাদিক। লেখার বাইরে সময় কাটে বই পড়ে, গান শুনে, সিনেমা দেখে। রবীন্দ্রসঙ্গীতটাও নেহাত মন্দ গান না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *