“আচ্ছা, তোর মনে আছে কি.. ইজিপ্ট এ কুসকুস খেয়েছিলি?” হঠাৎ দিদির প্রশ্ন এল মেসেজে।
“যদ্দুর মনে পড়ছে, খেয়েছি… কেন?”
“ইউনেস্কো চারটে দেশ ইনক্লুড করেছে, তাতে ইজিপ্ট নেই…”
“কিসে?”
Intangible cultural heritage লিস্টে কুসকুস…সুক্ষ্ম সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য… ইউনেস্কো…”

ব্যাস। এইটুকু বলেই চেশায়ার ক্যাটের মতো হেসে মিলিয়ে গেল দিদি। ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ? সেটা আবার কী বস্তু! কিওয়ার্ড ধরে সার্চ করে সোজা ইউনেস্কোর সাইটে…

“কুসকুস ঐতিহ্যকে তালিকাভুক্ত করা হল, আন্তর্দেশীয় সাংস্কৃতিক সহযোগিতার উদাহরণ হিসেবে” গত বছর ডিসেম্বরের লেখা। তারপর ছবিগুলো দেখতে দেখতে মন চলে গেল কোন সুদূর আফ্রিকায়। আফ্রিকা বরাবর টানে, সেই চাঁদের পাহাড় আর কিং সলোমন্স মাইনস থেকে শুরু… সাহারা মরুভূমি ছুঁয়ে চার শহর, আলজেরিয়া, তিউনিশিয়া, মরিটানিয়া, মরক্কো.. মরুভূমির সঙ্গে এরা বাঁধা কুসকুস-এর ঐতিহ্যেজন্ম থেকে মৃত্যু, বিয়েবাড়ি থেকে শ্রাদ্ধবাড়ি, গরিব থেকে বড়লোক, বানজারা থেকে অট্টালিকাবাসী, সবাইকে এক সূত্রে বেঁধে ফেলেছে কুসকুস…

Couscous making picture from UNESCO
ইউনেসকোর ওয়েবসাইটে কুসকুস বানানোর ছবি

একটা খাবার সামগ্রি, তা নিয়ে এত হৈ হৈ কেন! চাল গম তো আমাদেরও আসমুদ্র হিমাচল বেঁধে রেখেছে! কিন্তু যেখানে দিনের পর দিন আমরা প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে অমিল খুঁজতে ব্যস্ত, খুঁত ধরতে ব্যস্ত, সেখানে, একটা খাবারের ঐতিহ্য চার চারটে দেশকে এক সূত্রে বেঁধে রাখল, সে কি কম কথা! দুরুম গম চাষ করা থেকে, ঘরে ঘরে সেই গম ভাঙা, আর প্রসেস করা, তারপর একসঙ্গে খাওয়া। ভাব তো, যে খাবার সারাদিনের পরিশ্রমের পর বানজারা পরিবার খাচ্ছে, সেই খাবারই তখন মরোক্কোর নীল প্রাসাদে পরিবেশন করা হচ্ছে!

বরাবর আমার কনফিউশন হত, এই দূরুম গম থেকে তৈরি কুসকুস, সেমোলিনা আর বালগাঢ় এই নিয়ে। ছবি দেখতে দেখতে আর খুঁজতে খুঁজতে বুঝলাম সেমোলিনাকে প্রসেস করে বানানো কুসকুস। তাই কুসকুস রান্নাটা চটপট হয়ে যায়, বালগার এর চেয়ে কম সময়ে। আমি তো আবার ভীষন কুঁড়ে কিনা, তাই কুসকুস রান্না একদম আদর্শ, ৫-৭ মিনিটেই রেডি খাবার। 

তাহলে চল, আজ চার দেশ ঘুরে ঘুরে সেরে নিই কটা রান্না…। সঙ্গে আমার দিদির আক্ষেপ মেটাতে, ইজিপশিয়ান কুসকুস ডেসার্ট শেষ পাতে।

আলজেরিয়া, মরক্কো এইসব দেশে কুসকুস রান্না হয় কখনও সবজি দিয়ে, কিম্বা মাংস দিয়ে, সে বিফ হোক বা চিকেন। আজ চিকেন দিয়েই করে দেখি। আর হ্যাঁ, কুসকুসটা আমি অনিয়েছি অনলাইন, এখন বেশ সহজলভ্য সেটি…

যা যা লাগবে:

১ টা পেঁয়াজ
২ কোয়া রসুন
এক বাটি মতন লম্বা কাটা গাজর, বিনস, বা পছন্দ মত পাঁচ সাতটি সবজি
১ বাটি কাবুলি ছোলা ভিজিয়ে রেখে সেদ্ধ
১/২ কাপ টমেটো পেস্ট
১ চা চামচ ধনেগুঁড়ো
১ চা চামচ জিরে গুঁড়ো
দারচিনি
এক দু’ চামচ লেবুর রস
ধনেপাতা কুচি
অলিভ অয়েল বা যে কোনও সাড়া তেল
চাইলে এতে বাদামও দেওয়া যেতে পারে

Couscous
উত্তর আফ্রিকার না-সুজি, না-ময়দা, না-চাল কুসকুস

কী কী করতে হবে পর পর: 

গোটা গরমমশলা ফোড়ন দিয়ে একটু পেঁয়াজ-রসুন ভেজে নিয়ে তাতে চিকেন দিয়ে নেড়েচেড়ে, চিকেন হালকা সেদ্ধ করে রাখতে হবে, আর চিকেন ব্রথ আলাদা করে রাখতে হবে। তারপর সবজিগুলো হালকা অলিভ অয়েল আর টমেটো পেস্টে নেড়ে নিয়ে ওই ব্রথে সেদ্ধ করে নিতে হবে…

ওরা এর ওপরে স্টীমার এ কুসকুস সেদ্ধ করে। আমি করলাম কী, কুসকুস-এর প্যাকেটের ইনস্ট্রাকশন অনুযায়ী, যতটা কুসকুস ঠিক ততটা গরম জলে কুসকুস ভিজিয়ে রাখলাম। তারপর মাখন বা অলিভ অয়েল এ নুন দিয়ে কুসকুস দিয়ে হালকা ভেজে নিলাম, একদম হালকা ঝুরঝুরে কুসকুস রেডি!

ওদিকে সবজির সাথে মাংস মিশিয়ে আর কাবুলি ছোলা মিশিয়ে সব রেডি। থালায় কুসকুস দিয়ে পাশ দিয়ে সবজি আর চিকেন সাজিয়ে পরিবেশন করে দিলেই হল! সঙ্গে একটা কুসকুস সালাদ হতেই পারে…

সালাদ এর জন্যে…

কুসকুস সেদ্ধ করে মাখন দিয়ে নাড়িয়ে রেডি করা, সঙ্গে শশা, পেঁয়াজ, বাদাম, কাবুলি ছোলা, টমেটো, লাল বেল পেপার, কটেজ চিজ বা ছানাধনেপাতা, পুদিনাপাতা সব কিছু কুচি, আর ড্রেসিংয়ে লেবুর রস, অলিভ অয়েল, গোলমরিচ গুঁড়ো মেশানো।

Couscous Salad
কুসকুস স্যালাড বানানোর উপকরণ (বাঁ দিকে), বানানোর পর কুসকুস স্যালাড (ডাইনে)

আর বললাম যে কুশকুশ মিষ্টি বলব আর একটা…!

মিষ্টির জন্য লাগবে:

ফলের রস এক কাপ
কুসকুস এক কাপ
গোলাপজল দু চামচ
চিনি স্বাদমতো (যতটা মিষ্টি করতে চান) 
সাজানোর জন্যে কাঠবাদাম, নারকেলকোরা আর বেদানা

Couscous sweets
কুসকুস দিয়ে মিষ্টি

কুসকুস কে ফলের রস আর চিনি দিয়ে সেদ্ধ করে নেওয়া, তারপর একটু শুকনো নারকেল কোরা আর গোলাপজল মিশিয়ে নামিয়ে দেওয়া।

ওপরে চিনিগুঁড়ো, আর কাঠবাদাম ও বেদানা দিয়ে সাজিয়ে পরিবেশন করা। আমি টাটকা কমলালেবুর রস দিয়ে বানিয়েছি, তাই একটু হলদেটে, মিহিদানা বলে ভুল কোরও না কেউ!

 

*ছবি ও রান্না সৌজন্য: লেখক

Shruti Gangopadhyay Author

শ্রুতি অনেকদিন ধরে চক ডাস্টার নিয়ে স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ডে ফিজিক্স লিখতেই স্বচ্ছন্দ। সামান্য ও এত ক্ষুদ্র মানুষ, যে জীবনেও কখন হাইজে়নবার্গস আনসার্টেনটি প্রিন্সিপল কাজে লেগে গেছে অজান্তে। বর্ধমানে থাকার অবস্থানটি এতটাই সুনিশ্চিত, যে পিএইচডি উত্তর, উচ্চশিক্ষার মোমেন্টাম সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। হাজার মানুষের সঙ্গে কথা বলা শেষ হলেও বাকি থাকে নিশ্চিন্তে আকাশ নদী পাখি আর প্রজাপতির গল্প শোনা।

2 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *