প্রতি বছরই শীত আসার আগে আর শীত ছেড়ে যাওয়ার সময় সর্দিকাশিগুলো মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। প্রতি তিন-চার বছর ছাড়া এক একটা মারাত্মক সর্দিকাশির ঢেউ চলে। এ বছর সে রকম একটা ঢেউ চলছে। চেম্বারে ঢোকার সময় থেকেই নানা রকম কাশির কনসার্ট শুরু হয়। খসখসে কাশি, ঘড়ঘড়ে কাশি, ঘংঘং কাশি, খুক খুক কাশি সব একসঙ্গে শুরু হয়। তার সঙ্গে বাচ্চার কান্না, চিৎকার, ‘আমার আগে লাইন ছিল’, ‘আমি সেই সকাল সাতটা থেকে বসে আছি’ ইত্যাদি প্রভৃতি মিলিয়ে বেশ একটা মেলা-মেলা অনুভূতি তৈরি হয়।
আরও পড়ুন: ফেব্রাইল কনভালসন- জ্বরের খিঁচুনি
প্রায় দৌড়ে দৌড়ে চেম্বারে ঢুকি। কাঁধের ছোট ব্যাগটা কোনওমতে নামিয়েই রোগী দেখা শুরু করি। বুকে স্টেথো ঠেকালেই শাঁই শাঁই, ঘড়ঘড়। কেউ হাঁফাচ্ছে, মুখে দিয়ে শ্বাস নিচ্ছে। কেউ স্টেথো ঠেকানোর আগেই কেঁদেকেটে একশা। দেখতে গেলে ঠেলে সরিয়ে দেয়। দশজনের মধ্যে ন’জনেরই সর্দিকাশি। আর বিরক্তিকর কাশিগুলো কিছুতেই কমছে না। বোঝাই যাচ্ছে, বেশিরভাগই বিচ্ছিরি সব ভাইরাসের আক্রমণে হচ্ছে।
তার মধ্যেই মাঝে মাঝে রেকর্ড বাজানোর মতো ‘গ্যাস দিলে ক্ষতি হয়ে যাবে, অভ্যেস হয়ে যাবে’ ইত্যাদি শোনা যাচ্ছে। এদিকে বাচ্চা হাঁফাচ্ছে। কয়েকবার বুঝিয়ে কাজ না হ’লে মনে মনে গালাগালি দিতে দিতে সিরাপ লিখে ছেড়ে দিচ্ছি। রোজ রোজ এক কথা পাখিপড়ার মতো বলে যাচ্ছি। কবে অজ্ঞতা কাটবে কে জানে!
এত শ্বাসকষ্টের বাচ্চা দেখছি যে মনে হচ্ছে ঘুমের মধ্যেও শাঁই শাঁই, ঘড়ঘড় আওয়াজ পাচ্ছি। ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই দু’একজনের প্রেস্ক্রিপশন করে দিচ্ছি। মেসেজ পাচ্ছি, “ডাক্তারবাবু, বাচ্চার তিনদিন ধরে খুব কাশি। অমুক ওষুধ খাইয়েছি। কমেনি। কী করবো?” ডাক্তার যে মন্ত্রতন্ত্র জানে না এটা কেউ বিশ্বাস করতে রাজি নয়। সবাই দিব্যি জানেন, “ডাক্তার ব্যাটা সব জেনে-বুঝেও ওষুধের নাম বলবে না। এমনি কি আর ইয়ের বাচ্চা বলি?” ওদিকে ‘ইয়ের বাচ্চা’ ডাক্তার তার সমস্ত অনিশ্চয়তা আর অপারগতা নিয়ে গুমরে মরে। “স্টেথো ছুঁইয়েও সবসময় ধরতে পারি না। সেখানে না দেখে…”
তবু যখন বহুদিন ভোগার পর বাচ্চা সুস্থ হয়, মনে হয় ঝড়ের পরবর্তী স্বচ্ছ আকাশ ছুঁতে পারছি। স্টেথোস্কোপের তলায় সেই ঝড়ের মতো ঘড়ঘড়, শাঁই শাঁই আওয়াজ নেই। বাচ্চা খেতে পারছে। জ্বরটা নেই। বাচ্চাটা কাছে গেলেই মুখ বাঁকিয়ে কেঁদে উঠত। এখন পোকা লাগা দাঁতে একগাল হাসি৷ স্টেথোস্কোপের কসম, স্বর্গ এখানেই।
অনেকদিন বাদে বকবক করে ফেললাম। কাজের কথাগুলো বলে যাই। কাশি বেড়ে যাওয়া মানেই একটার পর একটা অ্যান্টিবায়োটিক খাইয়ে যেতে হবে এমনটা নয়। অ্যান্টিবায়োটিক ছাড়াও কাশি সারে। অ্যান্টিবায়োটিক কার দরকার এবং কখন দরকার সেটা চিকিৎসককে ঠিক করতে দিন। ইনহেলার বা নেবুলাইজার দিয়ে চিকিৎসা সংক্রান্ত ভুল ধারণাগুলো মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন। বিভিন্ন ধরনের কাশির কারণ আলাদা। চিকিৎসাও ভিন্ন ভিন্ন। কোনও কোনও কাশির চিকিৎসায় স্টেরয়েড লাগতে পারে। আঁতকে উঠবেন না। তবে পাশ করা চিকিৎসক ছাড়া নৈব নৈব চ। পুরোনো প্রেস্ক্রিপশন দেখিয়ে দ্বিতীয়বার নিজে নিজে ওষুধ শুরু করবেন না। পারলে নিউমোনিয়া (যাদের সরকারিভাবে নেওয়া নেই) আর ইনফ্লুয়েঞ্জা ভ্যাক্সিনেশন করান। অন্যান্য যে সব টিকা সরকারিভাবে পাওয়া যায় না সেগুলোও দিয়ে রাখতে পারলে ভালো।
ধৈর্য ধরুন। ক’দিন বাদেই এ ঢেউ কমে যাবে। বাচ্চাগুলোকে সাবধানে রাখুন। আর হ্যাঁ, ঠান্ডা লেগে যাবে ভেবে স্নান করানো বন্ধ করবেন না। মাত্রাতিরিক্ত গরম জামা পরাবেন না। দরদর করে ঘেমে গেলে সমস্যা বাড়বে।
খুদেগুলোকে সাবধানে রাখুন। টা টা।
দ্য ডক্টরস ডায়লগে পূর্ব-প্রকাশিত
শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ।