কসমিক পুরাণ
ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়
রবিপ্রকাশ
বইমেলা ২০২০
মূল্য ১২৫ টাকা
সাহিত্যের চলিষ্ণুতার একটি লক্ষণ পুরাণের পুনর্নিমাণ। তা সে গল্প উপন্যাস কবিতা হোক কিংবা প্রবন্ধ অথবা নাটক। পুরাণকে নতুন করে নির্মাণ করে আসলে প্রতিটি যুগ তার অতীত ইতিহাসকে শুধু যে প্রশ্ন করে, তা নয়, পুরাণে সামান্য উল্লেখিত, বা সম্পূর্ণ অনুল্লেখিত, কাব্যে উপেক্ষিত কোনও চরিত্রকেও নতুন আলোয় সামনে এনে দাঁড় করায়। যেমন উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ইরাবতী কার্ভের যুগান্ত উপন্যাসের কথা যা দ্রৌপদীকে নিয়ে আমাদের নতুনভাবে ভাবতে শেখায়। যে উপন্যাসের অনুপ্রেরণায় নির্মিত শাঁওলি মিত্রের নাথবতী অনাথবৎ নাটক। আবার পুনর্নিমাণে শুধু যে বিগত ঘটনাকে প্রশ্ন তোলা হয়, তাই না, পুরাণের চরিত্রগুলির মধ্যে সঞ্চারিত হয়। যেমন রবীন্দ্রনাথ যখন কর্ণ কুন্তী সংবাদ লেখেন তখন তাঁর কর্ণ কুন্তী ব্যাসদেবের কর্ণ -কুন্তীর তুলনায় ঢের বেশি মানবিক আবেগতাড়িত। এই দৃষ্টিকোণ আধুনিক কবির। একইভাবে বুদ্ধদেব বসুর অনাম্নী অঙ্গনায় উঠে আসে নামহীন দাসীর আনন্দ বেদনা, যা ইতিহাসে লেখা নেই।
নাট্যকার মণীশ মিত্র যখন মহাভারত অবলম্বনে সারারাতব্যাপী উরুভঙ্গম নাটকটি করেন, তখন তার মধ্যে থাকে এই সময়ের যুদ্ধবিরোধী বার্তা। এরজন্যে মণীশ আশ্রয় করেন কবি অভীক ভট্টাচার্যের কাব্যগ্রন্থ ‘আরোহলিপি’-র কবিতার অংশ, যা মহাভারতের পুনর্নিমাণ।
প্রস্তাবনা ও কথারম্ভ
“… যেহেতু জেনেছি সেই আঠেরো দিবসব্যাপী মহাযুদ্ধ, যেহেতু জেনেছি স্বর্গলাভ, নরকবাসের ইতিকথা, আর
যেহেতু কেবল মৃত্তিকার জন্যেই এই রক্তপাত ঘটাইনি আমি, সুতরাং শোন হে মরজগতের অধিবাসীবৃন্দ, হে
দেবকুল, শোন দ্যুলোক অমর্ত্যের মধ্যে স্পন্দিত হতে থাকা আর্যপুত্রেরা, আমি বলছি সেই আদিমতম ইতিহাস,
কারণ আমি জেনেছি সেই ব্রাহ্মণকে যিনি অনন্ত অন্ধকারে দাঁড়িয়ে উচ্চারণ করবেন তমোনাশ, আর অন্ধকার থেকে আলোক নির্গত হবে, অনন্ত নির্জ্ঞান থেকে উঠে আসবে ঊষা ও গোধূলি…।”
এইরকম উদাহরণ আরও দেওয়া যায়। গ্রিক নাটকের আধুনিকীকরণ হিসেবে মিল্টনের ‘স্যামসন অ্যাগনোস্টিক; মাইকেল মধুসূদনের মেঘনাদ বধ কাব্য। দীনবন্ধু মিত্রের যমালয়ে জীবন্ত মানুষ। সুবোধ ঘোষের পরশুরামের কুঠার। স্বর্ণকমল ভট্টাচার্যের জাবালি। প্রবন্ধের মধ্যে অসংখ্য উদাহরণের মধ্যে থেকে বিশেষ উল্লেখ্য বুদ্ধদেব বসুর মহাভারতের কথা, প্রতিভা বসুর মহাভারতের মহারণ্যে। নিবিড় অধ্যয়নের দাবী রাখে নানান লোক মহাভারত, যেমন সম্প্রতি প্রকাশিত জয়া মিত্র অনূদিত ভীল মহাভারত (সাহিত্য অকাদেমি)। আবার পরশুরাম মানে রাজশেখর বসু পুরাণ মন্থন করে তাকে পরিবেশন করেন হাস্যরসের মোড়কে, যার মধ্যে প্রচ্ছন্ন থাকে আধুনিক জীবনের সংকট। যেমন যযাতির জরা। নির্মোক। শেষ গল্পটিতে আছে এক অপ্সরার স্ট্রিপ টিজ নাচ দেখতে তিন মুনির আগমন। যখন খুলতে খুলতে অপ্সরার গায়ে একটি সুতো পর্যন্ত নেই, তখনো এক ঋষি অপলক চেয়ে আছেন , তাঁর প্রশ্ন এর পরের নির্মোকটি উন্মোচন কবে করবে? এই প্রশ্ন শুধু অপ্সরাকে নয়, আমাদের মেকি সভ্যতাকেও অস্বস্তির মুখে ফেলে দেয়।
এই প্রেক্ষিতেই যখন হাতে আসে গ্রহজগত ও মহাভারত আশ্রয়ী দু-দুটি নভেলা – কসমিক পুরাণ ও কাল-কাহিনি, তখন কৌতূহল না হয়ে পারে না। এ যেন একঘেয়ে বর্তমান থেকে খানিকটা রিলিফ। এবং দুটি কাহিনি নির্মাণেই লেখক ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় বেশ সাহস ও মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। “সৌরমণ্ডলে গ্রহেরা নিজ নিজ অবস্থানে বলীয়ান। কারোর তেজ কম, কারোর বেশি। কেউ শক্তিশালী, কেউ দুর্বল। কেউ দাপুটে, কেউ অপেক্ষাকৃত নম্র। ঠিক মানব সংসারের মতই তাদের সম্পর্কের টানা ও পোড়েন। প্রেম-পরকীয়া, অপত্য স্নেহ, ষড়রিপুর প্রকোপ স্বভাবেও। তারাও কারণে অকারণে একে অপরের প্রতি ক্রুদ্ধ হয়। ক্ষুব্ধ হয়। তাদেরও সুখ আছে। অসুখ আছে। দুঃখও আছে জীবনে। তাদের কামনা বাসনা আছে। লোভ হিংসা মোহ মাৎসর্য স্নেহ এসব থেকে তারাও বঞ্চিত নয়।”
চন্দ্র ও রোহিণীর পুত্র বুধের চূড়াকরণ উৎসব দিয়ে কাহিনীর সূচনা। ক্রমে এই উৎসবের আনন্দে পড়ে জটিলতার ছায়া। বুধ কি রোহিণীর গর্ভজাত নাকি তারার? লেখক যেন ইঙ্গিত করেন সারোগেট মাদার বা বিকল্প মাতৃত্ব ইস্যুটির? আবার বুধের প্রণয় ও পরিণয় ঘিরে আরও জটিলতা। অপ্সরাকে প্রত্যাখ্যান করে বুধ প্রায় যৌন ক্ষমতা হারিয়েছে। এইরকম সময়ে বৈবস্বত মনুর পুত্র ঐল তাকে কামনা করে। কিন্তু সে নদীর জলে স্নান করতে নেমে নারীতে পরিণত হয়। সে নাম নেয় ইলা। রূপান্তরিত ইলা আর বুধের শুরু হল সুখের দাম্পত্য। কিন্তু এই জীবনে সবকিছুই অস্থায়ী। সুখ, দুঃখ তো বটেই এমনকি মানুষের যৌনতাও মেরু বদল করতে পারে। তাই এই সুখের দাম্পত্যেও নেমে আসে কালো ছায়া। কী হল সেই কৌতূহল থাক পাঠকের। তবে লেখক অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং আধুনিক সমস্যাকে ছুঁয়ে এসেছেন এই সুযোগে।
“বুধের সঙ্গে ইলার বিচ্ছেদ পর্ব মিটে গেছে। এদ্দিনে পৃথিবী গ্রহের মানুষ নামে জীবটি যুক্তি দিয়ে বুঝেছে রূপান্তরকামিতা কোনও রোগ নয়। প্রকৃতির খেয়ালে লিঙ্গের বহুরূপতা মাত্র। ঐল থেকে ইলা এবং ইলা থেকে সুদ্যুম্ন হওয়াতে কোনওকিছু ভাববার অবকাশই নেই। দেহরসের হ্রাস বৃদ্ধি থেকেই এমন উপসর্গ দেখা দেয়। যার প্রভাবে মানুষ উভকামী সমকামী অথবা বৃহন্নলা…।”
কাল-কাহিনী নভেলাটি আরও আকর্ষক। কাঠগুদাম রেলস্টেশনে বসে থাকা তরুণ গল্পকার অহনা কিছুক্ষণের জন্যে পড়ে যায় সময়ের ফাঁকে। কিন্তু এখানে বারমুডা ট্র্যাঙ্গেলের উপমাটি খুব সুপ্রযুক্ত মনে হল না। বারমুডা ত্রিভুজের প্রকৃত রহস্য কী জানা নেই, তবে এখানে জাহাজগুলির অদৃশ্য হওয়াটা অনেকটা ব্ল্যাক হোলের মতো, যা সব আলোককণা শুষে নেয়, কেউ ফেরে না সেই ফাঁদ থেকে।
‘সাধারণত দুটি যুগের মধ্যে বিস্তর সময়ের ব্যবধান থাকে। কিন্তু কখনও কখনও আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদের সূত্র ধরে দেশকালের মসৃণ বিস্তারে ভাঁজ পড়ে এবং সেই ভাঁজের ফাঁকে পড়ে কালের নিয়মকে ভেঙে দিয়ে দুই যুগ এ ওর ঘাড়ে উঠে পড়ে। স্পেস টাইমের ভাঁজে ভাঁজে পড়ে এভাবেই এর একমুখিতা নষ্ট হয়। যদিও বিজ্ঞান বলে এ অসম্ভব কিন্তু অহনার মতে গল্পে সবই ঘটতে পারে’।
সময়ের এই warp এ তার কাছে এসে পড়ে উত্তরপ্রদেশের দুই নারী মৃদু এবং ঐশ্বর্য, যাদের জীবনকাহিনির সঙ্গে দ্রৌপদী আর সীতার অবিকল মিল। এখানেও একটা প্রশ্ন থাকে। এক নারীর বহুবিবাহ প্রথা ভারতের যে প্রান্তে এখনও দেখা যায়, তা কিন্তু উত্তরপ্রদেশে নয়, হিমাচলে। তাই মৃদু উত্তরপ্রদেশের বদলে হিমাচলের মেয়ে হলে ভালো হত।
এরপর লেখক দুটো চমৎকার কাজ করেছেন। এক, কালের সীমারেখা মুছে দিয়ে দ্রৌপদী আর সীতার সংলাপ রচনা আর দুই, কর্ণকে লেখা দ্রৌপদীর চিঠি। লেখককে ধন্যবাদ এমন অভিনব ভাবনার জন্যে। মহাপ্রস্থানের পথে এক পাথরের ওপর লেখা এক চিঠিতে দ্রৌপদী কর্ণকে বলে যাচ্ছেন তিনিই তাঁর জীবনের প্রকৃত প্রেম।
জীবনে শেষবারের মতো অপ্রেমের স্বামীদের যুক্তিহীন অনুগমন করে দ্রৌপদী বুঝতে পারছেন “আমার চারপাশের স্বপ্নের বর্ণালীরা, ব্যথার ঝরাপাতারা না বলা বর্ণ মালারা টুপ্টাপ ঝরে পড়ে গেল। আমার জন্য বেঁচে থাকার প্রহরগুলো আর অবশিষ্ট নেই। জীবনটাকে নিজের মতো করে পেলাম না, শেষের সেদিন সত্যি ভয়ঙ্কর।”
একইসঙ্গে এই দ্রৌপদী প্রতিবাদী। কর্ণকে তিনি ভর্তসনা করতেও ছাড়েননি। ‘নতুন সমাজ গড়বে তোমরা? ধিক তোমাদের ধিক! সেদিনই বুঝেছিলাম… নতুন দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যত গড়বে এই মানুষগুলো? যাদের ধর্ম-অধর্ম, ইহকাল-পরকাল বিসর্জন সেই মুহূর্তে।‘
পরিশেষে দুটো কথা। সাময়িকপত্রের ফরমায়েসি শব্দসীমার সীমিত লেখা অনেক সম্ভাবনার অপমৃত্যু ঘটায়, এখানেও তাই হয়েছে। বিশেষ করে কাল-কাহিনিতে। মৃদু ও ঐশ্বর্যকে নিয়ে আরও জটিল জাল বিস্তার করা যেত। আমার মনে হয় লেখক একবার ভেবে দেখুন।
আর পুরাণের পুনর্নিমাণ সবসময়ই ভাষার একটু ধ্রুপদী রূপ চায়। লেখককে এদিকে একটু মনযোগ দিতে হবে। নতুন প্রকাশনা বেশ যত্ন নিয়ে কাজটি করেছে। তা সত্ত্বেও বেশ কিছু মুদ্রণ প্রমাদ রয়েছে। কিছু ভুল বানান চোখকে পীড়া দেয়।
যাদবপুর বিশববিদ্যালয় থেকে বি.ই‚ এম.টেক । সরকারি মুদ্রণসংস্থায় প্রশাসনিক পদ‚ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিদর্শী অধ্যাপনা তাঁর লেখনীকে বিশেষ স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে।গল্প‚ উপন্যাস, কবিতার পাশাপাশি ছোটদের জন্য কল্পবিজ্ঞান লিখে থাকেন নিয়মিত। প্রকাশিত হয়েছে বহু বই। নামজাদা পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন উত্তর-সম্পাদকীয়। সাম্প্রতিকতম কাব্যগ্রন্থ: 'লাইব্রেরি শার্ট খোলো'।
খুব ভাল লাগল