প্রায় তিন সপ্তাহের ওপর হল বোধহয় টেক্সাসে, আমার শহর হিউস্টনে লকডাউন শুরু হয়েছে। অফিস আর স্কুল তো তারও আগে থেকে বন্ধ । চুমু, হাগ্ বন্ধ বিধিনিষেধের শুরু থেকেই। সোশ্যাল ডিস্ট্যানসিং বজায় রাখার চেষ্টা ঘরে বাইরে। তা  আমরা যারা, সিনেমায় নায়ক নায়িকা চুমু পেলে গাছের আড়ালে চলে যায় আর বদলে ফুলে ফুলে ধাক্কা  খায়  দেখে দেখে বড় হয়েছি , তাদের আর ওসব নিয়ে অত চিন্তা কী!  চুমুর অত চল নেই আমাদের রক্তে! আর  হঠাৎ করে কেউ হাগ করলেও কেমন যেন বিজয়া বিজয়া ঠেকে। যাই  হোক ,শুনলাম নাকি বেশ কিছু পরিবারে, ছ ফিট দূরত্ব বজায় রাখতে বালিশ বগলে স্বামী স্ত্রীও আলাদা আলাদা ঘরে গিয়ে দরজা দিচ্ছেন।  “খেলা ছোটাছুটি বেয়াদপী সব” বন্ধ এখন।
কিন্তু আমার কৌতূহল  আমার  আমেরিকান প্রতিবেশীদের নিয়ে। তারা এ নিরামিষ আয়োজনে বাঁচে কী করে ! পাড়ায় কারওর বাড়ি থেকে আজ পর্যন্ত একটাও দাম্পত্য  ঝগড়ার আওয়াজ শুনিনি।  দুই গাড়ি নিয়ে দুজন কাজে  যাওয়ার আগে, তাদের বরং নিজের ড্রাইভওয়েকে আইফেল টাওয়ার বলে মনে করে, সাত সকালে  জবরদস্ত সব চুমু খেতে দেখেছি। গত বারো বছরে একই প্রতিবেশীর বার দুই  তিন সঙ্গী বদল হলেও চুমুর নিষ্ঠাতে  কিন্তু কোনওদিন  ঘাটতি দেখিনি। কিন্তু এখন দৃশ্য অন্যরম। চুমুতে লাল ঢ্যাড়া আর সব্বাই অচ্ছুৎ !
এহেন সোশ্যাল ডিস্ট্যানসিং এর  সময় দেখি এক অদ্ভুত দৃশ্য। সে গল্প না বলে পাচ্ছিনে! আমার একদম পাশের  বাড়ি বুঝলেন ! মালিক মালকিন ছিল জেসিকা আর অ্যালেন। যদিও তাদের  গল্প বলতে হলে, বেশ খানিকটা ফ্ল্যাশব্যাকে যেতেই  হবে আমায়। আমরা এ পাড়ায় বাড়ি কিনে আসতেই তাদের সঙ্গে আমাদের প্রথম আলাপ। তখনও তারা বিবাহিত নয়। দুজনে মিলে নতুন বাড়ি কিনেছে। সংসার পাতব পাতব করছে। বিয়ের জন্য নাকি নানা ব্যস্ততায় সময় করে উঠতে পারছে না। কোল যদিও দেখলাম একেবারে ফুল্ল কুসুমিত। তাতে দশমাসের এক ফুটফুটে বাচ্চা ড্যানিয়েল। খুব তাড়াতাড়ি , জেসিকা ও অ্যালেন দুজনেই আমাদের অতি নির্ভরযোগ্য প্রতিবেশী হয়ে উঠল। ড্যানিয়েল অর্ধেক সময় আমাদের বাচ্চাদের সঙ্গেই আমাদের বাড়িতে লুচি, চিনি, ডিমসেদ্ধ ঘি ভাত খেয়ে বড় হতে লাগল। দিনে দিনে আমাদের দুবাড়ির সম্পর্ক এমন হল, যে  হঠাৎ করে রাতের দিকে কারওর চিনি, তেল, চাল, ডিম ফুরোলে দুই পরিবারই আমাদের বাচ্চাদের হাতে বাটি কাপ ধরিয়ে পাঠিয়ে দিতাম একে অন্যের বাড়ি। ড্যানিয়েলের জন্মদিনে আমাকে পায়েস বানিয়ে দিতে বলত  অ্যালেন।  ইতিমধ্যে, তার বছর চারেক বয়স হলে তার বাবা মা এক সুযোগে টুক করে বিয়েটা সেরে ফেলে। তাদের আর একটি ফুটফুটে বাচ্চা হয়। দুটো কুকুর, দুটো বাচ্চা নিয়ে তখন ভরা সংসার। জেসিকাদের বাড়িতে গেলেই দেখতাম  সংসার, চাকর, সন্তানপালন সবেতেই দুজনার সমান ভাগ। অ্যালেন ব্যাকইয়ার্ডে ডেক বানাচ্ছে  তো জেসিকা স্টাডিরুমের দেওয়াল রং করছে। বাড়ির সব বিল পেমেন্টেও দুজনার সমান ভাগ। অ্যালেন পশুপ্রেমী নিরামিষাশী। ভারতীয় খাবার খেতে খুব পছন্দ করে। জেসিকা আবার কোনও মশলাদার খাবারই মুখে তুলতে পারে না। অ্যালেন সকালে বড় কালো কুকুরকে নিয়ে হাঁটে তো জেসিকা বিকেলে ছোট্ট সাদা কুকুর নিয়ে দৌড়তে বেরোয়। দুজনেই পাগলের মতো ভালোবাসে আমাদের সাঙ্গে,পাড়ার সবার সঙ্গে দোলের দিন রঙ খেলতে। আর দুজনেই দুজনকে  নিয়ম করে লম্বা চুমু খায় মুহুর্মুহু! আমি তখন তাদের প্রেম হ্যাংলা চোখে দেখি আর মাঝে মধ্যেই  আমার ঘরের লোকটিকে এসে শুধিয়ে যাই “হ্যাঁগা , অমন প্রেম আমার হল না কেন?” সে আমার দিকে না তাকিয়ে উত্তর না দিয়ে টিভির নিউজ শুনতে থাকে।
ওমা, এমন করে কয়েক বছর দিব্যি চলতে চলতে বছর দুয়েক আগে  হঠাৎ দেখি  “সাতমহলা স্বপ্নপুরীর নিভল হাজার বাতি!!” অ্যালেনের মুখ থমথমে। জেসিকার মেজাজ খিটখিটে।  ড্যানিয়েল এসে চুপিচুপি আমার ছেলেদের বলে গেল “মম অ্যান্ড ড্যাড বোথ ওয়ান্ট টু  লিভ সেপারেটলি।” এর পরেই শুনলাম জেসিকা এ পাড়াতেই একটু দূরের গলিতে একটা বাড়ি ভাড়া নিয়েছে। অ্যালেন একা থাকতে শুরু করল।  জেসিকার টাকায় যে ফার্নিচারগুলো কেনা হয়েছিল সেগুলো এ বাড়ি থেকে উবে গিয়ে মেঝে খাবলা খাবলা ফাঁকা হয়ে থাকল। কালো কুকুর পড়ল অ্যালেনের ভাগে । সাদা কুকুর চলে গেল  জেসিকার কাছে । ছেলে মেয়েও ভাগ হল। সোম থেকে বৃহস্পতি সকাল মা, বৃহস্পতি বিকেল থেকে সোম সকাল বাবা।  আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না কী হল! ওরাও নিজে থেকে ভেতরের খবর তেমন কিছু বলল না। শুধু জানালো, একেবারেই বনিবনা হচ্ছে না। হয়তো ডিভোর্সই হয়ে যাবে। তার আগে কিছুদিন আলাদা থেকে দেখতে চায় দুজনে। তারও পরে একদিন শুনলাম, এককালে যেমন বিয়ে করতে তারা সময় পাচ্ছিল না, সেই সময়াভাবেই ডিভোর্সটাও হয়ে উঠছে না। এর মধ্যে আমি না চাইতেও জেসিকা অ্যালেন দুজনারই স্পাই হয়ে উঠলাম । অ্যালেন সকালে বলে “জেসিকার সঙ্গে পার্কে দেখা হলে গল্পে গল্পে একটু জিজ্ঞেস করে দেখো তো  নতুন কাউকে পেল কিনা ! জেসিকা সন্ধ্যেবেলা ফোন করে বলে “একটু তোমার ড্রাইভওয়েতে গিয়ে উঁকি মেরে দেখে বলো তো অ্যালেনের বাড়ির সামনে কোনো গাড়ি দাঁড় করানো আছে কিনা !”
এমনই  চলছিল গত প্রায় দুবছর! ওমা, হঠাৎ করে আবার সপ্তাহ দুয়েক আগে দেখি এক পিক-আপ ট্রাক থেকে লোটাকম্বল নামাচ্ছে  জেসিকা! তড়াং করে সেটা থেকে লাফ দিয়ে নামল সাদা কুকুর ও দুই বাচ্চা। হাঁটতে বেরিয়ে তার দিন দুয়েক পরে দেখি, বাড়ির দরজা খোলা, জেসিকা ভেতরে বাড়ি পরিষ্কার করছে দেখা যাচ্ছে।  খাবলা মেঝে আবার ফেরত আসা জিনিসে ভরে গেছে। আমাদের ব্যাকইয়ার্ডের পাশেই তাদের ব্যাকইয়ার্ডে  সাদা কুকুর কালো কুকুর আবার একসঙ্গে দাপাদাপি করে খেলছে! বাড়ির সামনে জেসিকা ছোট ছোট গোলাপের চারা পুঁতছে। আমাকে আমার ড্রাইভওয়েতেই  একটু অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে একটু ইতঃস্তত করে জিজ্ঞেস করল  “তোমার কাছে  এক্সট্রা একদুটো ফ্রোজেন সামোসা হবে ? অ্যালেনকে ভেজে দেব।”  আমি বললাম, “হ্যাঁ আছে, এক্ষুনি দিয়ে যাচ্ছি তোমার দরজার সামনে, গ্লাভস  পরে নিয়ে প্যাকেট ওয়াইপ করে নিও।  কিন্তু তোমাদের কি ব্যাপার বলো তো  এই দুবছর পরে? একসঙ্গে থাকছ নাকি আবার ?”  একটু আমতা আমতা করে এবার জেসিকার উত্তর  “হ্যাঁ, মানে ডিভোর্স তো হয়নি আমাদের এখনও, আর  দুজনেই সত্যি আর কোনও নতুন সম্পর্কেও  জড়াইনি। আসলে আমাদের ছোট বড় কোনোওকিছুতেই মতে মিলত না, ঝগড়া হতো ! একা থাকছিলামও দিব্যি।  কিন্তু এই করোনার জন্য স্কুল অফিস এতদিন বন্ধ থাকবে! ওয়ার্ক ফ্রম হোম! বাচ্চাদেরই বা একা একা সামলাই কি করে! চাকরি বাকরিও এর পরে থাকবে কিনা সন্দেহ। খরচ খরচা সব ভেবে আমার ওই  ভাড়াবাড়ি ছেড়ে দিচ্ছি ! এখানেই থাকব। অ্যালেনও তাই চায় !  এতদিন পর নিজে থেকে ফিরে আসতে বলল, জানো। বাচ্চারাও খুব খুশি ! লেট আস ট্রাই ওয়ান্স মোর !”
পরদিন বিকেলে  হাঁটতে বেরিয়ে দেখি, অ্যালেন জেসিকার ড্রাইভওয়েতে আবার আইফেল টাওয়ার গজিয়েছে।  দৈর্ঘ্যে প্রস্থে বিশালাকার চুমু আবার! তারাও হাঁটতেই বেরোচ্ছে একসঙ্গে।  দেখতে দেখতে মনে  হল “দে উইল লিভ হ্যাপিলি এভার আফটার!”

টেক্সাসের হিউস্টনের বাসিন্দা! লেখালেখি ছোটবেলা থেকেই। গত দশ বছরে প্রবন্ধ , ছোট গল্প, কবিতা, রম্যরচনা প্রকাশিত হয়েছে দেশে বিদেশের বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকায়। এছাড়াও লিখেছেন নানান দৈনিক সংবাদপত্রে। লেখালিখির পাশাপাশি পড়তে, শুনতে, ভাবতে, জানতে, বেড়াতে ভালোবাসেন।

2 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *