বেঙ্গালুরুর ঝাঁ চকচকে কর্পোরেট অফিস। বিশ্বস্ত সূত্রে পাওয়া খবর অনুযায়ী, গত সপ্তাহের রিভিউ মিটিংয়ে যখন ওপরওয়ালা বাছা বাছা কিছু শব্দের পাথর ছুড়তে শুরু করেছেন তাঁর কোনও এক অধস্তনকে, সেই বেচারা সাবঅর্ডিনেট টুক করে একবার হেঁচে ফেলেন। মুহূর্তে খালি হয়ে যায় মিটিং রুম। 

কাট টু কলকাতা মেট্রো। এক শীতাতপনিয়ন্ত্রিত রেক। প্রবল ভিড়। সিটের সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে এক ক্লান্ত লোক, বার দু’য়েক খুক খুক করে কাশলেন। পকেট থেকে রুমাল বের করে একবার মুছে নিলেন তাঁর নিরীহ নাক। ঠিক পরের স্টেশনেই সামনের সিটের গোটাটা কেন খালি হয়ে গেল তার উত্তর তিনি এখনও খুঁজে বেড়াচ্ছেন।

মুম্বই-বেঙ্গালুরুর খবর চলকে চলকে পড়ছে দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। আর ‘প্রান্তিক’ লোকেরা ভেবে চলেছেন, ডব্লুএফএইচ, এ শহরে হবে কবে?

করোনাভাইরাসের দৌলতে এই শব্দটা দিব্যি শিখে গিয়েছি আমরা। ডব্লুএফএইচ। মানে ওয়ার্ক ফ্রম হোম। কথা শোনও, হাত ধোও, অফিসেতে যেও না। করোনায় প্রথম করণীয় কী, আঁচ করতে পেরেই একের পর পর এক অফিসে দিন পনেরোর ছুটি হয়ে গিয়েছে দেশের বেশ কয়েকটা শহরে। নামী কোম্পানির দামি সিইও বড় মুখ করে মিডিয়ায় বলছেন, প্রেস নোট দিচ্ছেন, ‘আমরা আমাদের কর্মীদের উপরে পূর্ণ ভরসা রাখি। আমরা জানি, অফিসে বসে তাঁরা দিন রাত এক করে যে কাজ করেন, একই উদ্যমে তাঁরা কাজ করে যাবেন বাড়িতে বসেও।’ মানবসম্পদ নিয়ে কাজ করেন, এমন কয়েকটি সংস্থা আবার এই বাজারে কী সব সংখ্যাতত্ত্বের উপরে নিয়ন আলো ফেলে প্রমাণ করার চেষ্টা করছে, কর্মীদের প্রোডাক্টিভিটি নাকি অফিসের বদ্ধ দেওয়ালের থেকে বেশি হয় নিজের বাড়িতে বসে কাজ করলে। কর্মীরা ছুটিতে যাওয়ার আগে বসদের বলে আসছেন, ‘কোনও চিন্তা নেই স্যার। নিশিদিন ভরসা রাখুন হবেই হবে।’ মনে মনে বলছেন, ‘এখন অনেক রাত, তোমার ঘাড়ে আমার নিঃশ্বাস’-এর দিন চুকল, অন্তত দিন কয়েকের জন্য। আর অন্য দিকে ডেটিং অ্যাপের কর্তাব্যক্তিরা এক গাল হেসে মিডিয়া ডেকে বলছেন, ‘গত দিন দশেকে আমাদের অ্যাপে অ্যাক্টিভিটি অন্তত পঁচিশ শতাংশ বেড়েছে।’ এর মানে হল, বাড়িতে বসে ডেটিংয়ে মজেছেন কর্মীরা!

সংস্থার ফিনান্স ম্যানেজাররা আবার কষতে শুরু করে দিয়েছেন এক অন্য অঙ্ক। তাঁরা ইতিমধ্যেই হিসাব কষে বের করে ফেলেছেন, লোকগুলোকে বাড়িতে বসে কাজ করালে কোম্পানির আখেরে কত টাকা লাভ। ইলেকট্রিকের খরচা নেই, চা-কফিখোরদের উৎপাত থেকেও বেঁচে যায় প্রফিট অ্যান্ড লস অ্যাকাউন্ট। সাহেবদের গাড়িভাড়া পেট্রোল খরচ মুছে যায় বিলকুল। তাঁরা বলছেন, ‘বেশ তো। অফিস রাখার তো তাহলে কোনও দরকারই নেই।’ ওদিকে নিজের ফাঁকিবাজ টিমকে শায়েস্তা করার জন্য কোনও কোনও বস নাকি আবার ঘণ্টা হিসেবে কাজ দেওয়া শুরু করে দিয়েছেন। মানে সকাল নটা থেকে দশটায় এটার সাবমিশন। দশটা থেকে এগারোটায় এটার। এ রকমভাবে বেঁধে দিচ্ছেন পুরো দিনটাই। বাড়ি বসে আমার ফাঁকিবাজ টিম মস্তি করবে তা হতে দেওয়া যায় না। আবার কানাঘুষোয় শুনলাম, ফ্যামিলি প্ল্যানার যাঁরা আছেন, তাঁদের অনেকে নাকি এই সময়টার পূর্ণ সদ্ব্যববহার করার পরামর্শ দিয়েছেন তাঁদের মক্কেলদের!

সুখের যদি কোনও শেয়ার মার্কেট থাকে, তাহলে এ বাজারে তার রেকর্ড উত্থান দেখতে পাচ্ছেন স্যানিটাইজারের প্রস্তুতকারকরা। ডেঙ্গু, পেঁপের ট্যাবলেটকে জগদ্বিখ্যাত করেছিল। আর করোনাভাইরাস স্যানিটাইজারকে। জানতে পারলাম, কোম্পানিগুলো নাকি স্যানিটাইজার বানাতে বানাতে ক্লান্ত। আর সেলস ম্যানেজাররও ভেবে ভেবে ক্লান্ত, এ বছরের ইনসেনটিভের টাকায় কোন দেশে গিয়ে পার্টি করবেন! ঘণ্টাতিনেক আগের ঘটনা। আজ বাস থেকে নামার আগে এক ভদ্রলোককে তাঁর কোনও এক শুভানুধ্যায়ী বললেন, ‘অফিসে গিয়েই কিন্তু অ্যালকোহল বেসড্ স্যানিটাইজার দিয়ে ভাল করে হাতটা ধুয়ে নেবেন, দাদা।’ ভদ্রলোক বিধ্বস্ত সিরাজদৌল্লার মতো বললেন, ‘নেই, নেই, নেই, কোথাও নেই।’ শুভানুধ্যায়ী বললেন, ‘ওটা না পেলে খাঁটি বাংলা দিয়েও ধুয়ে নিতে পারেন। একই এফেক্ট। ওটা তো আছে।’ ভদ্রলোক চাঁদ দেখা আলোয় কনের মতো বলে উঠলেন, ‘যাঃ!’

বন্ধু, কী খবর বল্, বলে এক হারিয়ে যাওয়া মুখ চমকে দিল যখন, তখন ‘ভাই রে, পনেরো বছর পর’ বলে ওকে জড়িয়ে ধরতে গিয়েছিলাম। দুটো সমমেরুর চুম্বকের মতো দশ-বারো সেকেন্ড ধরে একটা দৌড় চলল প্রকাশ্য রাজপথে। আমি যত এগোই, বন্ধু তত পিছোয়। তারপরে ও ট্রাফিক সার্জেন্টের মতো হাত দেখাল। বলল, ‘থাম, থাম, থাম, থেমে থাক। নো লাভ ইন দ্য টাইম অফ করোনা।’ বুঝেছিলাম, দেরি করে। দু’মিটার দূরে দাঁড়িয়ে কথা হল বেশ কিছুক্ষণ। কিন্তু পনেরো বছরের দূরত্বের এক ইঞ্চিও পূরণ হল না যেন। এখন অবশ্য এটাই নিয়ম। সংবাদপত্রে দেখলাম, ইতালির একজন নিজের কোমরের চারদিকে চার-পাঁচ ফুটের বেড়ি লাগিয়ে রাস্তায় নেমেছেন। ‘দূরকে করিলে নিকট, বন্ধু, পরকে করিলে ভাই’ এই লাইন ক’টা কিছুদিনের জন্য ব্রাত্য এখন। 

দুঃখের দিকটা আপাতত সরিয়ে রেখে বলছি, করোনা বহু অফিসবাবুকে শান্তি দিয়েছে যেমন, বহু লোকের শান্তি কেড়েওছে। মাল্টিপ্লেক্সের কর্মীরা এ বাজারে প্রোজেক্টারের আলোর সামনে হাতের আঙুল রেখে বিরাট পর্দায় শেয়াল-কুকুর-হরিণের ছায়া দেখালেও কারও কিছু বলার নেই। বহু ছোট রেস্তোরাঁর কর্মীরা মাছি তাড়াচ্ছেন। মুরগিরা বলে চলেছে, ‘আর কত ছোট হব ঈশ্বর?’ দোকানের বাইরে বোর্ডে লেখা, কাটা ৮০ টাকা। দেশের জিডিপির মতো এর দামও তলানিমুখো ক্রমশ। ভক্ত মন্দিরে না গেলে মন্দিরকেই ভক্তের কাছে আসতে হয়। ছোঁয়াচ লাগার ভয়ে সোশ্যাল গ্যাদারিং অর্থাৎ, সামাজিক মেলামেশার দরজায় আগল টেনে দিচ্ছি আমরা। বাজারে যাচ্ছি না বলে বাজার আমাদের কাছে আসছে। অনলাইন ফুড ডেলিভারি অ্যাপে অর্ডার বাড়ছে, বেডেই চলেছে। অনলাইন মুদির দোকানেও কাটা হয়ে চলেছে একের পর এক বিল। আর এর মূল্য দিচ্ছেন ডেলিভারি বয়রা। করোনা কাণ্ডের আগে যাঁরা দিনে গড়ে পনেরো-ষোলোটা ডেলিভারি করতেন, আজ তাঁদের কপালে এই সংখ্যাটা তেইশ-চব্বিশ। হয়তো আরও বেশি। পরিস্থিতির যদি উন্নতি না হয় কোনও, তাহলে আর কিছু দিন পরে হয়তো রাস্তায় ডেলিভারি বয় ছাড়া অন্য কাউকে দেখা যাবে না। ওঁদের ছোঁয়াচ লাগতে নেই।

ছোটবেলা থেকে শেখা এটিকেটগুলোর মধ্যেও যে ‘শর্তাবলী প্রযোজ্য’ শব্দু দুটো লেগে রয়েছে প্রচ্ছন্নভাবে, তা নতুন করে শিখতে হচ্ছে আবার, করোনাভাইরাসের দৌলতে। প্লে-স্কুলের ম্যামরা শিখিয়েছিলেন, কেউ হেঁচে উঠলেই বলতে হবে, ব্লেস ইউ। এটা নাকি ভদ্রতা। দিনদুয়েক আগে এক সহকর্মী যখন হাঁচলেন, তখন ওই দুটি শব্দ বলে ফেলেছিলাম। বহুদিনের অভ্যেস। চোখের পাতা পড়ার আগে পাতা কি চোখকে জিজ্ঞেস করে? সহকর্মী ফোঁস করে উঠলেন। বললেন, ‘হাউ ডেয়ার ইউ? আমি হাঁচছি আর তুমি ইয়ার্কি মারছ?’ শিক্ষা হয়েছে। আর বলিনা। 

কলকাতারই এক বহুজাতিকে আমার এক বন্ধু তার আশ্চর্য আবিষ্কারের গল্প শোনালো। বন্ধুটি নাকি গত দেড় বছরে একটাও ছুটি পায়নি। এদিকে অফিসে ঢোকার গেটে সিকিউরিটির হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে থার্মাল স্ক্যানার। স্ক্যান পরীক্ষায় পাশ করলে তবেই সেদিনের মতো কাজ করার অনুমতি। ওর কথায়, ‘কাল হাসতে হাসতে এলাম। স্ক্যান করালাম। বাড়ি চলে গেলাম।’ শুনলাম, ‘হাউ টু ইনক্রিজ বডি টেম্পারেচার’ লিখে আগের রাতে ও প্রশ্ন করেছিল গুগলকে। অনেক পরামর্শের মধ্যে সবচেয়ে পছন্দসই যেটা হয়েছিল তা হল, আন্ডারআর্মসে (বাংলাটা বড় বাজে শোনায়) হাফ করে চিরে দেওয়া রসুন কোয়া রেখে দেখতে পারেন। শরীরের তাপমাত্রা বাড়বেই।

স্ক্যানার বোঝেনি!

অম্লানকুসুমের জন্ম‚ কর্ম‚ ধর্ম সবই এই শহরে। একেবারেই উচ্চাকাঙ্খী নয়‚ অল্প লইয়া সুখী। সাংবাদিকতা দিয়ে কেরিয়ার শুরু করলেও পরে জীবিকার খাতবদল। বর্তমানে একটি বেসরকারি সংস্থায় স্ট্র্যাটেজি অ্যানালিস্ট পদে কর্মরত। বহু পোর্টাল ও পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। প্রকাশিত হয়েছে গল্প সংকলন 'আদম ইভ আর্কিমিডিস' ও কয়েকটি অন্য রকম লেখা নিয়ে 'শব্দের সার্কাস'।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *