নকল হইতে সাবধান। এ কথা যে কত খাঁটি, তা বাঙালি তালমিছরির বহর দেখলেই বোঝা যায়। সুতরাং সে অন্যের দেখে নিজের চরিত্র-চলন মোটেও বদলায় না। সে বাজার গেলে দেখে দেখে পোকা বেগুন কেনে কারণ একমাত্র পোকা ধরা বেগুনেই নকল সারের উপদ্রব নেই, সে খাস ক্যাথলিক ইসকুলে বাচ্চাকে পাঠায় কারণ ওখানেই আসল শিক্ষা পাওয়া যায়, সে গিল্টি করা গয়নায় নেই, ২৪ ক্যারট সোনা ছাড়া মন ওঠে না, সে চেয়ারম্যান ও দাঁতের ডাক্তার ছাড়া অন্য কোনও চিনা দ্রব্যে ঘোর আপত্তি করে। কিন্তু ব্যতিক্রম-ই একমাত্র নিয়মের পরিচায়ক, এ কথাটির ব্যত্যয় সে কখনও করে না। তাই পরীক্ষার খাতায় সে অন্যের খাতা থেকে নকল করে, অজানা অবজেকটিভ প্রশ্নের হল কালেকশন করে, রাত জেগে সিগারেটের রাংতার পেছনে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অক্ষরে সে আসন্ন প্রশ্নের উত্তর লিখে, সেই টুকলি-পত্রকে একটি কুটির শিল্প পর্যায়ে নিয়ে যায়। সে অত্যন্ত পরিশ্রম করে টুকলি-পত্র লুকনোর ফাঁকফোকর আবিষ্কার করে পরীক্ষককে চমকে দেয়। এবং চিন্তা করে দেখলে চমৎকৃত হতে হয় যে, ঠিক এ রকম ভাবেই পরের পর ধাপ নকল করে সে নিজের জীবন অতিবাহিত করে।
শুনতে খানিক খটকা প্রাথমিক ভাবে লাগতে পারে, কিন্তু আদতটা এক্কেবারে বিশুদ্ধ। সে অত্যন্ত নৈপুণ্যে শৈশবে নকল করে তার চেয়ে বড় কোনও দাদা-দিদিকে, যৌবনে রণবীর-দীপিকাকে কিংবা অন্য ক্ষেত্রে সফল ব্যক্তিদের, বিয়ের পর বয়োজ্যেষ্ঠ পূর্ব নারী-পুরুষদের এবং বার্ধক্যে সে পুনরায় নকল করতে চায় যৌবনকে। সমস্যা সেখানেই। তখন সে বোঝে যে, যে জীবনটা সে টুকলি করে চালাল, তা ষোলো আনা না হলেও চোদ্দো আনাই বৃথা। এক বার যৌবন হাতে ফিরে পেলে সে নিজের মতো বাঁচবে, অন্যের মতো নয়, সমাজের চাহিদা অনুযায়ী নয়, মা-বাবার বাধ্য সন্তান, সংসারের বাধ্য স্বামী-স্ত্রী, সন্তানের মুখ চেয়ে শ্রেষ্ঠ মা-বাবা হওয়ার তাড়নায় নয়। সে সফল বন্ধুর জীবন থেকে, দাপুটে বসের জীবন থেকে, সুন্দরী বান্ধবীর গয়না থেকে, ফুরফুরে মেয়ের জেল্লা থেকে টুকে নিজের জীবনে কপি-পেস্ট করবে না। সে বুঝবে যে অন্য কারও থেকে নকল করে নিজের জীবনে সেঁটে দিলে, তা কেবল মাত্র হয়ে দাঁড়ায় ব্যর্থ কিংবা উন্নততর টুকলি কিন্তু কখনই আসলি সোনা-চাঁদির দেখা মেলে না।
সুতরাং টুকলি বাঙালি জাতীয় জীবনের অঙ্গ। বাঙালি অত্যন্ত দক্ষতায় তার শিক্ষা-সংস্কৃতি-যাপন বদলে পুরোপুরি গ্লোবাল ধাঁচে টুকলি করে জীবন অন্য ছাঁচে ঢালার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। গ্লোবাল না হলেও খানিক বলিউডি, ব্যর্থ ইউরোপীয়ান ও হুবহু মার্কিনি জীবনযাত্রাকে সে টুকে চলার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ খেলায় কত দিনে সম্পূর্ণ অসফল হবে, তা সময়ই বলবে।
সঞ্চারী মুখোপাধ্যায় হাসিখুশি, এমনকী যখন সেই মোড-এ থাকেন না, নিজেকে ঠেলে হিঁচড়ে হিহিহোহো’তেই ল্যান্ড করানোর চেষ্টা করেন। জাপটে ভালবাসেন আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, সিরিয়াল, গান, রাস্তায় নেড়িবাচ্চার লটরপটর কান। পড়াশোনার সময় ফিল্ড করেছেন, হাতুড়ি দিয়ে পাথর ভেঙেছেন, গ্রামবাসীদের তাড়া খেয়েছেন, এক বার পাহাড় থেকে অনেকটা হড়কে পড়ে মুচ্ছো গেছিলেন, উঠে দেখেন, কবর! এক বার ম্যানেজমেন্ট কোর্সের অঙ্গ হিসেবে চিন গেছিলেন, রাত্তির দুটোয় সাংহাইয়ের রাস্তায় হারিয়ে গিয়েও কাঁদেননি। ফিউজ সারাতে পারেন, পাখার কার্বন বদলাতে পারেন, কাগজের চোঙ পাকিয়ে গাড়িতে পেট্রল ঢালতে পারেন, চিনেবাদাম ছুড়ে দিয়ে মুখে নিপুণ লুফতে পারেন। ব্যাডমিন্টন খেলার ইচ্ছে খুব, কিন্তু জায়গা ও র্যাকেট নেই। অরোরা বোরিয়ালিস যারা দেখেছে, তাদের একাগ্র ভাবে হিংসে করেন। দেশের বাড়িটা উনি বড় হওয়ার পর ছোট হয়ে গেছে বলে, আর আমির খান এক বার কার্টুন এঁকে দিয়েছিলেন— সে কাগজ হারিয়ে গেছে বলে, জেনুইন কষ্ট পান। এক বার ঈগলের রাজকীয় উড়ান আগাগোড়া খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন।
অনবদ্য ।
একদম সঞ্চারী style ।
‘নকল হইতে সাবধান’ – লেখাটি বলিষ্ঠ; লেখিকাকে অভিনন্দন ও শভেচ্ছা l
ধন্দ : আত্মসমালোচনা ভাল, তবে এত বেশি আত্মনিন্দা আমাদেরকে ‘পিছনের দিকে আরও এগিয়ে যেতে’ (যাওয়া-আসার পথে বাসে কন্ডাকটার ভাইয়ের নির্দেশের মাধ্যমে শোনা) সহায়তা ক’রবে না ত’?