দৌড় দৌড় দৌড়- এ এক দৌড়ের গল্প। পালিয়ে যাওয়ার গল্প। শুধু ‘থ্রিলার’ বললে ভুল বলা হবে, এ হল বেঁচে থাকার এক প্রবল ইচ্ছের গল্প। শুধু তাই নয়, এই গল্প সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখার গল্প, হাল না ছাড়ার গল্প আর সবচেয়ে বড় কথা গৃহচ্যুতি, বাস্তুচ্যুতি, ইংরাজিতে যাকে বলে ডিসপ্লেসমেন্ট, তার গল্প। যখন এই উদ্বাস্তুদের নিয়ে এক রাজনৈতিক তরজা আরম্ভ হয়, যখন ঠিক কে রিফিউজি আর কে নয়, তার প্রমাণ চাওয়া হয়, যখন রাষ্ট্রনায়করা দেশের সীমা বরাবর পাঁচিল তোলার কথা বলেন, তখন এই বই তাঁদের নতুন করে ভাবতে শেখায়।
‘আমেরিকান ডার্ট’ জেনিন কামিন্সের এক অবিস্মরণীয় উপন্যাস। ২০২০-এর সবচেয়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী উপন্যাসগুলোর মধ্যে একটা। টানা ৩৬ সপ্তাহ নিউ ইয়র্ক টাইমসের বেস্ট সেলার লিস্টে থাকা, অত্যন্ত কঠিন বললেও কম বলা হয়। এক মা আর তাঁর ছেলের মেক্সিকো সীমানা অতিক্রম করার গল্প।
লিদিয়া বইয়ের দোকান খুলেছিলেন। বই পড়াই তাঁর প্যাশন আর তাঁর স্বামীর কাজ সাংবাদিকতা। তাঁর দোকানে বই কিনতে আসত যে সাদামাটা লোকটি, কবিতা নিয়ে গল্প করত, একটু ফ্লার্টও করত যে লোকটি, তাঁর নাম জ়েভিয়ার ক্রেসপো ফুয়েন্তেস, মেক্সিকোর সেই অঞ্চলের সবচেয়ে কুখ্যাত ড্রাগ চোরাকারবারি। লিদিয়ার স্বামী ভুলে গেছিলেন যে, মেক্সিকোয় বাস করে ড্রাগবিক্রেতাদের নিয়ে রিপোর্ট লেখার শাস্তি কী হতে পারে। প্রতিশোধের হিংসায় কে বন্ধু আর কে প্রকৃত শত্রু, তা কোনওদিনই ড্রাগ চোরাকারবারিরা খেয়াল রাখে না। রিপোর্ট লেখার কয়েকদিনের মধ্যে একদিনে ষোলোজন নিশানা হল স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রের।

জন্মদিনের উৎসব চলছিল। আট বছরের লুকা বাথরুমে গেছিল। লিদিয়া লুকাকে বাঁচানোর জন্য সেখানেই ঢুকে পড়েন, বাথটাবে শুয়ে পড়ে বেঁচেও যায় দু’জনে। আর তারপর আরম্ভ হয় তাদের দৌড়। মেক্সিকো ছেড়ে বেরুতে হবে। রয়ে গেল ষোলোটি আপনজনের মৃতদেহ। মা, বোন, বোনের পরিবার- তাঁর ভালবাসার লোকজন সব মৃত। কিন্তু তাঁর শোকপ্রকাশের সময় নেই। যে স্বামীর সঙ্গে এতদিনের ভালবাসা, তাঁর মৃতদেহ জড়িয়ে ধরে একবুক কান্নার সময় পাননি লিদিয়া- নিজে বাঁচার চেয়েও ছেলেকে বাঁচানো বেশি জরুরি। মা আর ছেলের গন্তব্য, বর্ডার পেরিয়ে আমেরিকা। সেই আমেরিকা, যেখানে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেছেন, মেক্সিকো সীমানায় বানাবেন এক সুউচ্চ প্রাচীর, যাতে এইসব ঘরছাড়া মানুষেরা না ঢুকতে পারে।
এক মা আর তাঁর আট বছরের ছেলের জীবনের দাম সেই রাষ্ট্রনায়কের কাছে কিছুই নয়। কিন্তু এই দরিদ্র, উদ্বাস্তু মানুষগুলো যে বেঁচে থাকার লড়াই চালাচ্ছে আমেরিকায় এসে, তা সহ্য করা ‘প্রকৃত’ আমেরিকানদের জন্য অত্যন্ত কঠিন। নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছেন, মা আর ছেলের কী হবে। তার মধ্যে জুটে যায় আবার প্রায় লুকার বয়সী দুই বোন। একেই নিজেকে, ছেলেকে বাঁচানো অত্যন্ত কঠিন। তার উপর আট বছর আর বয়ঃসন্ধির আর দু’টি মেয়েকে বাঁচিয়ে আমেরিকায় নিয়ে আসা! বয়ঃসন্ধির মেয়েটিকে পুরোপুরি বাঁচাতে পারেননি লিদিয়া। কিন্তু সে দুঃখ করার সময়ও তাঁদের ছিল না। একদিকে ড্রাগ কারবারিরা, অন্যদিকে মেক্সিকোর সরকারি কর্মচারিরা- কাউকেই তাঁরা বিশ্বাস করতে পারেন না। গোটা মেক্সিকো শহরে ছড়িয়ে আছে ড্রাগ চোরাকারবারিদের জাল। তাদের হাত থেকে পালানো প্রায় অসম্ভব।
উত্তর আমেরিকায় ওপরা উইনফ্রের শো-তে বিশদ আলোচনা হয় এই বই নিয়ে। আমেরিকার নিউ ইয়র্ক টাইমসে বেস্টসেলার হওয়া বা ওপরার শো-তে আলোচনা হওয়া বেশিরভাগ লেখকের কাছেই অলীক কল্পনার মতো। আর সেখানে জেনাইন কামিন্সের এই প্রথম উপন্যাসের এ হেন খ্যাতি প্রাপ্তি প্রায় ধূমকেতুর মতো। সমালোচকরা এ বইকে ২০১৯-এর সবচেয়ে আলোড়নকারী উপন্যাস বলে অভিহিত করেন। গার্ডিয়ান পত্রিকায় লেখা হয়
‘এ বই আপনাকে খাদের কিনারে এনে দেবে, স্নায়ু শান্ত করার জন্য গভীরভাবে শ্বাস নিতে হবে, পালসের গতি বাড়িয়ে দেবে, অশান্ত করে তুলবে- কিন্তু তবুও পড়ে যান। জেনাইন কামিন্সের বই লেখার আগে এই বই নিয়ে রীতিমতো হইচই পড়ে যায়। ষোলোজন নামকরা প্রকাশকের মধ্যে লড়াই আরম্ভ হয়, কে এই বই ছাপবে! যে কোনও লেখকের কাছেই স্বপ্ন- সাত অঙ্কের ডলার অ্যাডভানস পান তিনি। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে সিনেমা রাইট বিক্রি হয়ে যায়। জেনাইন কামিন্সের এই বই আমেরিকার স্বপ্ন ঘিরে, কিন্তু এ তাঁর লেখক সত্তার এক স্বপ্নের উত্থানও বলা চলে।’
মুখবন্ধে লেখক বলছেন, আমেরিকা এক অভিবাসীদের জায়গা। লোকে স্বপ্নের খোঁজে যায় আমেরিকা। সবার নিজের নিজের স্বপ্ন। কিন্তু মেক্সিকো সীমানার তিহুয়ানাতে গ্রাফিটি লেখা “এই পারেও কিন্তু স্বপ্ন আছে।” এই দৌড় সাফল্যের দৌড়, এই দৌড় বেঁচে থাকার লড়াই। আমরা প্রতিনিয়ত দৌড়ে চলেছি জীবনে আরও কিছু পাওয়ার জন্যে। এর মধ্যে কেউ দৌড়য় আরও বেশি কিছু পাওয়ার আশায়, আর কেউ দৌড়য় শুধু প্রাণরক্ষার তাগিদে। এই বই শুধু স্বপ্নালু মানুষের প্রতিও উৎসর্গ করা যেত, যাঁদের হারাবার কিছুই নেই, শুধু দু’চোখ ভরে এক সুন্দর, সচ্ছল ভবিষ্যতের স্বপ্ন আছে।

কিন্তু আজকাল সমালোচনা এবং সামাজিক মাধ্যমে লোকের ক্ষুব্ধ হওয়া অত্যন্ত সাধারণ ঘটনা। এমন কোনও ঘটনা নেই, যা কিছু লোককে বিক্ষুব্ধ করে না। এই বইয়ের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কিছু সমালোচকদের মতে কামিন্স অভিবাসীদের দুঃখদুর্দশাকে পণ্য হিসেবে বিক্রি করেছেন। জুলিসা আরসে রায়া (‘আমেরিকান ড্রিম’-এর লেখক) এর চূড়ান্ত সমালোচনা করেন। তিনি নিজে মেক্সিকো থেকে বেআইনিভাবে অনুপ্রবেশ করেন আমেরিকায়। তিনি বলেন “harmful, stereotypical, damaging representation of our experience.” আর এক বিখ্যাত লেখক সেলেস্ত ইং টুইটারে বলেন “হাস্যকরভাবে ভুলভাল!” এঁদের কারুর কথাই ফেলে দেওয়ার মতো নয়, আধুনিক আমেরিকান সাহিত্যে সেলেস্ত ইং অত্যন্ত প্রতিভাবান লেখক বলেই পরিচিত। তিনি আরও বলেন, এসব কল্পনা করে লেখা উচিত নয়, ওঁদের সঠিক দুর্দশা যদি সঠিক না জানেন, তাহলে কাউকে জিগ্যেস করলেই তো হয়!”
আরও বেশ কিছু কঠিন সমালোচনার মুখোমুখি হন কামিন্স। বেআইনি অভিবাসীদের দুঃখ দুর্দশা বিক্রি করে নিজে উপার্জন করছেন, কিছু লোকের কাছে এ বেশ বিবমিষার উদ্রেক করে। এই অভিযোগ আমাদের কাছে নতুন কিছু নয়- অনেক চিত্রপরিচালক বা বিদেশি পর্যটকেরা ভারতের দুঃখ, দৈন্য এবং দুর্দশা দেখাতেই নাকি বেশি আগ্রহী- এ আমরা বিশ্বায়নের আগে, আশি বা নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে প্রায়শই শুনতে পেতাম। একবারও মনে হত না এই দৈন্য, দুর্দশা আছে কেন? যাই হোক, সমাজবিজ্ঞানের কথা অন্যত্র হবে। এই বই যদি মেক্সিকোর ড্রাগ আর অপরাধের প্রতিচ্ছবি হয়, হোক। পাঠক হিসেবে নিঃসন্দেহে বলতে পারি, এই বই শেষ না করা অবধি শান্তি পাওয়া কঠিন।
লাতিন আমেরিকার আধুনিক কালের একজন শক্তিশালী সাহিত্যিক মিরিয়াম গুর্বা অভিযোগ করেন যে, এই বইয়ের প্রচার এতো বেশি যে কোনও রকম বিরূপ সমালোচনা খবরের কাগজ বা পত্রপত্রিকায় ছাপতে চাইছে না। তার উত্তরে সাংবাদিক পল ব্রেমনার লেখেন “ এত হইচই হচ্ছে শুধু একজন সাদা লেখক বাদামি লোকদের নিয়ে লিখেছে বলে?” আবার উচ্ছ্বসিত জন গ্রীশাম বলেন “rich in authenticity”.
এই পর্যন্ত বলে থেমে যেতে পারতাম। কিন্তু আজকের এই মেরুকরণের সমাজে, স্মার্টফোনের যুগে, সমালোচনা করে অনেক লোক থেমে যেতে পারেন না। এরপর আরম্ভ হল হুমকি। প্রকাশক অন্তত দুটো রাইটার্স মিট বাতিল করতে বাধ্য হলেন। সলমন রুশদিকে একবার বলতে শুনেছিলাম “আমার লেখার কথা, আমি লিখব, তোমার ভাল না লাগলে পড়বে না।” (এডিনবরা ২০১৬) কিন্তু এখানেই বহু লোক যে থামতে জানেন না, তার সবচেয়ে প্রকৃষ্ট উদাহরণ রুশদি নিজেই। জেনাইন কামিন্সের এই বই পড়তেই হবে- শুধুমাত্র থ্রিলার হিসেবেই পড়তে পারেন। সত্যি না আজগুবি, অত ভেবে কী লাভ?
গ্রন্থ: আমেরিকান ডার্ট
লেখক: জেনাইন কামিন্স
প্রকাশক: ফ্ল্যাটিরন বুকস
বিনিময়: ২০১৫ টাকা (হার্ডকাভার), ৫০৩ টাকা (পেপারব্যাক)
*ছবি সৌজন্য: Amazon, Getty Images
ডাঃ শুভায়ু বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম আসানসোলে। সেখানে স্কুলের পড়াশোনা শেষ করে কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করা। অতঃপর প্রবাসী। কর্মসূত্রে সুদূর স্কটল্যান্ডের বাসিন্দা। স্কটল্যান্ডের অন্যতম বিখ্যাত অ্যাবার্ডিন রয়্যাল ইনফার্মারি হাসপাতালে মহিলা ও শিশুবিভাগে ক্লিনিক্যাল ডিরেক্টর। বইপড়া, বই সংগ্রহ বাতিক! লেখার অভ্যেস ছোট থেকেই। দেশ, আনন্দবাজার, সন্দেশ, সৃষ্টির একুশ শতক, কবিতীর্থ-তে লেখালিখি করেন। বই নিয়ে লিখতে ভালবাসেন।