শহরে জন্মেছি, বাড়িতে একটা শিউলি গাছ ছিল, সে প্রকৃতির নিয়মে ফুল ঝরাতে শুরু করত। কিন্তু আমাদের কাছে পুজোর আগমনী বার্তা বয়ে আনত পাতা-জোড়া বিজ্ঞাপন ‘পুজোয় চাই নতুন জুতো’। ওটা বেরলেই ভাই-বোনে মিলে ঠিক করে নিতাম এবারে কোনটা কিনতে হবে! আমাদের ছোটবেলায় পরিকল্পিত অর্থনীতির যুগ- রেশনের চাল থেকে আরও নানারকম অপ্রতুলতার মধ্যে জীবনযাপন। কিন্তু ওই বিজ্ঞাপনের সঙ্গে পুজোকে এক করে ফেলে না বুঝেই আমরা ঢুকে পড়তাম এক ব্যূহে – অর্থনীতির পরিভাষায় যাকে বলা হয় ভোগবাদ।

ভোগবাদ বা কনজ্যুমারিজম হল এমন একপ্রকারের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অনুক্রম যেখানে মানুষকে নিয়ত ক্রমবর্ধমান পণ্য ও সেবা অধিগ্রহণকে উৎসাহিত করা হয়। এটা হল ভোগবাদের আভিধানিক অর্থ। সোজা বাংলাতে বললে জিনিসপত্র কেনা বা কোনও সেবা পাবার জন্য প্রয়োজনের বেশি টাকা খরচ করা – টাকা খরচের ফাঁদে পড়ে যাওয়া।

আচ্ছা, এরকম ফাঁদে মানুষ পড়বে কেন? বেঁচে থাকতে হলে আপনাকে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে হবে, কিছু পরিষেবা নিতে হবে – তা মানুষের থেকেই হোক আর পরিকাঠামোরই হোক। এবং সবাই তা করেও থাকে নিজের আয় অনুযায়ী। অর্থনীতি প্রথমেই ধরে নেয় –মানুষ অর্থনৈতিক কাজকর্ম করে যুক্তি মেনে। তাই তার আয়ে যা পোষাবে, তাতেই তার উপযোগিতা সর্বোচ্চ স্তরে নিয়ে যেতে হবে। আম্বানি আট্টিলা বানাবেন আর মধ্যবিত্তকে বর্গফুটের হিসেবে মাথাগোঁজার ঠাঁই জোগাড় করতে হবে।

এভাবেই চললে ভোগবাদের গল্পই আসে না। সেই উনবিংশ শতাব্দীর শেষে থরস্টাইন বান্ড ভেবলেন বলেছিলেন অন্যের অনুকরণে ভোগ করার কথা। আপনার পাশের বাড়ির লোক যা করছে, আপনাকেও তাইই করতে হবে, ওপাড়ার সেনবাবুর বউ যদি অমুক দোকানের অমুক শাড়ি কিনে থাকে, তাহলে আপনাকেও তাই কিনতে হবে। পাড়ার সব ছেলে যে ইস্কুলে যাচ্ছে, আপনার ছেলে সে ইস্কুলে পড়বে না, তাকে পাঠাতে হবে আপনার বড়লোক আত্মীয়ের ছেলের ইস্কুলে।

হঠাৎ দুর্গাপুজোর গল্পে এসব নিয়ে আসছি কেন বলুন তো? দুটি কারণে – এক হল এই সময়ে কেনাকাটা বেড়ে যায় – যতটা প্রয়োজনে তার চেয়ে বেশি অপ্রয়োজনে; দ্বিতীয়তঃ এই পুজর সময়ের ভোগবাদ এখন আর সাধারণ মানুষের মধ্যে আবদ্ধ থাকছে না। এ ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র, এমন কি পুজোর মধ্যেও।

মানুষ বেশি কেনাকাটা করলে ক্ষতি কি? অর্থনীতির তত্ত্ব বলে যত চাহিদা বাড়বে তত উৎপাদকেরা উৎসাহী হবেন, বিনিয়োগ বাড়বে। বিনিয়োগ আর অধিক উৎপাদন মানেই চাহিদা বাড়বে কাঁচামালের, শ্রমিকের আর অর্থনীতির চাকা আরও দ্রুতগতিতে চলবে। সেইদিক থেকে ভোগবাদ মোটেই সামগ্রিক অর্থে খারাপ জিনিস নয়। আর পুজোতে কেনাকাটা তো বাঙালি একা করে না, সারা পৃথিবীর মানুষ তাদের নিজেদের উৎসবের সময়ে চুটিয়ে বাজার করেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ লিখে গেছেন কলকাতার কলেজে–পড়া ছাত্র পুজোর ছুটিতে বাড়ি যাবার আগে ফর্দ করছে কী কী কিনতে হবে। বা অপু-দুর্গা দিন গুনছে পুজোর সময়ে বাবা আসবে, কী কী নিয়ে আসবে। মানুষ সামাজিক জীব। তাই শুধু নিজের ঘরের লোক নয়, আশপাশের সকলকেও এই সময়ে একটু দিতে থুতে হয়। তাই আর-একটু বেশি কেনা। আর শুধু তো পরনের পোষাক নয়, মধ্যবিত্ত ভাবে ঘরের পর্দাটা একটু পাল্টাই, আর-একটা বিছানার চাদর কিনে রাখি। বোনাসের টাকা এলে একটা ফ্রিজ কিংবা মাইক্রোওয়েভ কেনা যাক। বোনাস তো বটেই, কিছু সংস্থায় বিনা সুদে উতসবের আগাম দেওয়ারও চল আছে। ব্যাবসায়ীরাও তৈরি হয়ে যান –‘এবার পুজোয় বিপুল আয়োজন’ বলে ব্যানার টাঙানো শুধু নয়, ক্রেতাদের আকর্ষণ করার আরও নানারকম ব্যবস্থা তারা করে থাকেন।

ছোটবেলায় বাটার দোকানে গেলে মুখোশ, বেলুন কত কিছু পাওয়া যেত। তখনও অবশ্য দুটো কিনলে একটা ফ্রি দেওয়া শুরু হয়নি। অনেকে বলে থাকেন দুর্গাপুজো তো শুধু একটা ধর্মীয় ব্যাপার নয়, এটা একটা ইন্ডাস্ট্রি।প্যান্ডেল বাঁধা থেকে শুরু করে মূর্তিনির্মাণ, তার সাজপোশাক, ঢাকি-ঢুলি এমনকি পুজোতে যারা খাবারের দোকান দেন, তারা সবাই চেয়ে থাকেন এই তিনটি দিনের দিকে। মেনে নিতেই হবে। কর্মকান্ড যত বড় হবে, তার সামনে পেছনে যোগাযোগও তত বেশি হবে – সহযোগী, অনুসারী সব শিল্পই সমৃদ্ধ হবে। কিন্তু এ তো অর্থনৈতিক দৈন্যের লক্ষণ – যেখানে তিনদিনের ওপরে ভরোসা করে চালাত হয় তিনশো বাষট্টি দিন। আবার এখানেও কাজ করে ওই পাল্লা দেবার মানসিকতা আর বিষম প্রতিযোগিতা। গত কয়েক বছর একটি প্রতিযোগিতার বিচারক হবার সুবাদে দেখেছি এই মানসিকতা ছড়িয়ে পড়েছে ছোটতম পুজোগুলোতে। আপনি হয়তো বলবেন সত্তরের দশকের মত চাঁদার জুলুম তো আর নেই, এখন সব কর্পোরেট স্পন্সর। তা হতে পারে। কিন্তু তারা তো ব্যবসাই করবে, দান-ধ্যান নয়। তাদের এই খাতে যা বরাদ্দ, তার চেয়ে বেশি তারা করবে না, যদি করে তাহলে আপনাকেই তা ফেরত দিতে হবে, তখন আর মূল্যবৃদ্ধি বলে চেঁচালে হবে না।

ভোগবাদ দিন দিন বাড়ছে এতে কোনও সন্দেহ নেই। মানুষের আয় বাড়ছে, ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে, পরিবার ছোট হওয়ার ফলে মাথাপিছু খরচও আগের চেয়ে বেশি করা যায়। আর ভোগব্যয় বাড়লে অর্থনীতির উন্নতি হয় সে তো আগেই বলেছি। কিন্তু ভোগবাদের খপ্পরে একবার ঢুকে গেলে কিন্তু আয় বুঝে ব্যয় করা আর হয় না। প্লাস্টিক মানি হাতে থাকা মানেই ‘ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ’। এবারে যদি এই দেনা শোধ না করতে পারেন, তাহলে তো ক্রমশ আরও জড়িয়ে যাবেন ঋণের জালে। ক্রেডিট কার্ড দেনেওয়ালা ব্যাঙ্কেরা কিন্তু বড় কাবুলিওয়ালা। তাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই, অনাদায়ী ঋণের বোঝা বেড়ে গেলে তাদেরও লালবাতি জ্বালতে হবে!

আবার ফিরে আসি ছোটবেলার গল্পে। ওই পাতা-জোড়া বিজ্ঞাপন দেখে প্রথমে আমাদের দিশেহারা অবস্থা হত, মনে হত প্রতিটি জুতোই অসাধারণ, সব কটাই কিনলে ভাল হয়। তারপরে মনে হত সব কুড়িয়ে-বাড়িয়ে তো দুইয়ের বেশি হবে না – তার একটা কালো জুতো – যা ভদ্র সাজের, সাদা মোজার সঙ্গে পরতে হবে। অন্যটা একটু খোলামেলা – তখনকার ভাষায় কাবলি জুতো। তাও পছন্দ করা হয়ে যেত আমাদের দুজনের। কিন্তু তারপরে সব উতসাহে জল ঢেলে দিয়ে মা বলতেন – না না ওসব হবে না, এবারে কেডস কিনতে হবে, স্কুলের জুতো আর বেশিদিন চলবে না। ব্যস! ভোগবাদ থেকে আমরা একেবারে ফিরে আসতাম আয় অনুযায়ী উপযোগিতা কতটা বাড়ানো যায় সেই তত্ত্বে!

তাই পুজোতে বাজার করবেন অবশ্যই। বাজার করাটা দরকার। কিন্তু আপনার আয়ে যদি ছিটের জামা হয়, তাতেই বিধুর মত খুশি থাকুন, রায়বাবুদের গুপির জরির টুপি আর সাটিনের জামার দিকে না তাকানোই ভাল। সব জায়গাতে তো আর বদান্য জমিদারবাবু থাকেন না, যারা থাকেন তারা জামার দাম কড়ায়-গন্ডায় উসুল করে নেবেন। আর সব বাড়িতেই থাকা দরকার এমন একজন মা, যিনি কিনা বাহুল্যের চেয়ে প্রয়োজন বুঝবেন আর মধুকে বাবার সামর্থের কথা বুঝিয়ে বিধুর সমাদর করবেন।

মহালয়া চট্টোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির অধ্যাপক। নগর অর্থনীতি, মহিলা শ্রম এবং লিঙ্গবৈষম্য বিষয়ে ওঁর লেখা একাধিক দেশি বিদেশি জার্নালে প্রকাশ পেয়েছে। মূলত ইংরেজিতে লেখালেখি করেন। ইকোনমিকস অফ আরবান ল্যান্ড ইউজ, এনভায়রনমেন্টাল ম্যানেজমেন্ট ইন ইন্ডিয়া, ওঁর লেখা গবেষণামূলক কিছু বই।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *