ভিয়েতনাম সফরের শেষ দিনেই হলো যত গন্ডগোল। হোটেলে চেক আউট হলো সকাল আটটায়। রাত আড়াইটায় ফ্লাইট। শেষ দিনে কিছু বাজারপাতি করে না নিয়ে গেলে বাড়িতে নির্ঝঞ্জাট প্রবেশ মুস্কিল। তাই এ দীর্ঘ সময় বাজারেই কাটিয়ে দেবো ঠিক করেছিলাম। বিদেশ বিভুঁইয়ে দেশি খাবার খাওয়া বেশ শক্ত। তাও খুঁজে পেতে দেশি খাবারের ঠিকানায় ভিড় জমালাম। পরিবেশনে মারাঠি যুবক। এত দেশি লোকের ভিড়ে আবেগে বোধহয় ছলছল করছিলো ভদ্রলোকের চোখ।চলে যাবার সময় হ্যান্ডশেক করে ছলছলে লাল চোখে বিদায় দিলেন আমাদের। এরপর সাইগন স্কোয়ারের বাজারে ঢোকার মুহূর্তেই কেমন যেন ম্যাজম্যাজ করে উঠলো গা। চোখে কিছু পড়লে যেমন হয়, সেরকম অস্বস্তি হচ্ছে যেন। বাজারের বাথরুমে চোখে জলের ঝাপটা দিয়ে দেখলাম, সেরকম কিছুই নেই। ডান চোখটা ঈষৎ লাল। খুব গুরুত্ব না দিয়েই বাজারে মন দিলাম। কিন্তু জ্বরজ্বর ভাব যেন কিছুতেই যাচ্ছে না। সাইগনের এত্ত আলো, ওয়াকিং স্ট্রিটের ফোয়ারা সবই যেন কিছুটা হলেও ফিকে। আজ এ দেশে শেষ দিন। সেজন্যেই হয়তো মন খারাপের বহিঃপ্রকাশ। এসব সাতপাঁচ বুঝিয়ে সাইগন এয়ারপোর্টে যখন ঢুকলাম তখন বাজে রাত এগারোটা। কলকাতায় সাড়ে ন’টা।মাথাটা ধীরে ধীরে ধরে এলো। এরপর সাড়ে তিন ঘন্টার ফ্লাইটে অস্বস্তি নিয়েই ভোরবেলায় যখন কলকাতা পৌঁছালাম, তখন ক্লান্তি ভাব জাঁকিয়ে বসেছে শরীরে। চোখের খচখচানিটাও বেশ বেড়েছে তখন। বাড়ি ফিরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম- রক্তবর্ন ধারণ করেছে ডানচোখ। কোনে জমেছে পিচুটি। জল ঝরছে অনবরত। আর বুঝতে বাকি রইলো না। ভাইরাল কঞ্জাংটিভাইটিসে আক্রান্ত হয়েছি আমি। গ্রামবাংলায় “জয় বাংলা” নামেই অধিক পরিচিত। মারাত্মক সংক্রামক এ রোগ। আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা, ইনফেক্টেড তোয়ালের ব্যবহার, মায় হ্যান্ডশেকও মুহুর্তে এ রোগের সংক্রমণ ঘটায়।

 


 

আরও পড়ুন: মাথাব্যথা যখন হাঁটুব্যথা

 


 

চোখের ওপরের প্রতিরক্ষামূলক স্বচ্ছ পর্দার নাম কনজাংটিভা। এর দুটি ভাগ। চোখের সাদা অংশের ওপরের আবরণের নাম বালবার কনজাংটিভা। চোখের পাতার ভেতরে থাকে প্যালপেব্রাল কনজাংটিভা। মূলতঃ বিভিন্ন প্রকারের ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, অ্যালার্জির কারণে কনজাংটিভার ঘা হয়ে এ রোগের সৃষ্টি। কিছুক্ষেত্রে ভিন্ন রোগের নিরাময়ের পথে (সিকাট্রিসিয়াল) কনজাংটিভাইটিস হতে পারে। কিছু টক্সিনের সংস্পর্শে আসাও এ বিপদ ডেকে আনতে পারে।

রোগের বহিঃপ্রকাশ? চোখের অস্বস্তি দিয়ে শুরু। খচখচানি, চোখে বালি পড়ার মত সংবেদন, লাল হয়ে জল পড়া, তীব্র আলোর দিকে তাকাতে কষ্ট, ঈষৎ ঝাপসা দৃষ্টি, চোখের পাতা ফুলে যাওয়া।

চোখ দিয়ে কি ধরনের চক্ষুস্রাব নির্গত হচ্ছে, তা দেখেই প্রাথমিক ভাবে চিকিৎসকেরা কারণ খুঁজে বের করেন। জলীয় চক্ষুস্রাব- ভাইরাল, শ্লেষ্মাযুক্ত পূঁজের মত স্রাব- ব্যাকটেরিয়াঘটিত। অ্যালার্জিক কঞ্জাংটিভাইটিসে প্যালপেব্রাল কনজাংটিভার দিকে নজর দিতে হয়।

এবার আসি চিকিৎসা প্রসঙ্গে। এ রোগের প্রাথমিক চিকিৎসা সবক্ষেত্রেই এক। প্রথমতঃ চোখের ভেজা ভাব বজায় রাখার জন্য কার্বক্সিমিথাইল-সেলুলোজ জাতীয় চোখের ড্রপ ব্যবহার করা হয়। এরপর কারণ অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক বা অ্যান্টি-ভাইরাল বা অ্যান্টি-ফাংগাল অথবা অ্যান্টি-অ্যালারজিক চোখের ড্রপ ব্যবহার করা হয়। বেশিরভাগ নিরীহ ইনফেকশন সপ্তাহ খানেকের ভোগান্তি দিলেও কিছুক্ষেত্রে জটিলতার কারণে অনেক সময়ই তা বিষম আকার ধারণ করে।

সমস্যা মুলতঃ এ রোগের সংক্রমণ নিয়ে। এক চোখে ইনফেকশন হবার পর,সেই চোখে ব্যবহার করা কাপড় দিয়ে অন্য চোখ মুছলে অন্য চোখে এ সংক্রমণ ছড়াতে বেশি সময় লাগে না। রোগী যদি নিজেকে আলাদা না করেন, তাহলে সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের এ সংক্রমণ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। আক্রান্ত ব্যক্তির ঘনঘন হাত ধোওয়া উচিত। নিজের ব্যবহৃত টাওয়েল, বালিশ অন্য কাউকে দেওয়া উচিত নয়। কালো চশমা দিয়ে চোখ ঢেকে রাখলে সংক্রমণের গতি যেমন বাধাপ্রাপ্ত হবে, তার সাথে দৃষ্টিপথও সুগম হবে। কনট্যাক্ট লেন্স ব্যবহারকারীদের এই ইনফেকশনের সময় লেন্স খুলে রাখাই শ্রেয়।

বিদেশ সফরের অন্তিমকালে মারাঠি যুবকের ছলছলে চোখে আবেগের লাল আলো দেখে ভুল করেছিলাম আমি। ফলাফল- এই নিয়ে তিন দিন কালো চশমা চোখে দিয়ে নিভৃতজীবন যাপন করছি আমি। দূর থেকে ট্রেনের ঝিকঝিক শব্দে “অপু” মন আন্দোলিত হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু চোখে দেখার সাধ্য এখনও নেই। আগামীকাল, অপথ্যালমোলজিষ্ট দাদার কাছে চক্ষুপরীক্ষা না করলেই নয়।

দ্য ডক্টরস ডায়লগ ওয়েব পোর্টাল থেকে পুনর্মুদ্রিত।

চিকিৎসক। ফিজিওলজি বিশেষজ্ঞ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *