‘কাকু, আর একটু সস হবে?’
এই প্রশ্নটা শোনার পর তেলঘাম-মাখা ভদ্রলোক অবধারিত ভাবে কড়া দৃষ্টি হানতেন আমাদের দিকে। তারপর অগত্যা একটু চিলি বা টোম্যাটো সস, হাতের কাছে যা পেতেন, ঢেলে দিতেন আমাদের প্লেটে। আমরা মানে, আমি আর অনির্বাণ। আমার স্কুলের বন্ধু, এবং অভিন্নহৃদয়। তখন আমরা তত ছোটও নেই আর, ক্লাস ইলেভেন। যদিও এই সময়ে দাঁড়িয়ে সেদিকে তাকালে ওই বয়সটাকেও গতজন্ম বলে ভুল হয় আমার।
সে যাই হোক, এই ব্যাপারটা ঘটত প্রায়দিন সন্ধের পরপর। স্কুল শেষ করে যার যার বাড়ি ফিরে এসেছি। আমার বাড়ি গড়িয়ায়, অনির্বাণের বাঁশদ্রোনীতে। খুব কিছু দূর নয়, কিন্তু অটোয় চেপে মিনিট দশেকটাই তখন বিরাট ব্যাপার। সেইসঙ্গে সাড়ে তিন, সাড়ে তিন সাত টাকার যাতায়াত ভাড়া। তাকে মান্যি করতে হয় বৈকি। আমি বেশিরভাগ দিনই বাড়ি ফিরে হাতমুখ ধুয়ে অনির্বাণের বাড়ি যাবার একখানা বাহানা ফাঁদতাম। সেটা খুব কষ্টকর ব্যাপার ছিল না, কেননা অনির্বাণ আমাদের ক্লাসের ফার্স্ট বয় ছিল। এহেন বুদ্ধিদীপ্ত ও মেধাবী ছাত্রের সঙ্গে আমার এই ঘনিষ্ঠতা অনেকের কাছেই তখন ব্যাখ্যাহীন। কেন অনির্বাণ সারাক্ষণ শ্রীজাত’র সঙ্গে মেশে, এ নিয়ে এমনকি শিক্ষকরাও চিন্তিত। ওর প্রভাবে আমার উন্নতির আশা তাঁরা করতেন না ঠিকই, কিন্তু আমার প্রভাবে ওর অবনতির একটা আশঙ্কা অবশ্যই ছিল। আমার বাড়িতে যদিও একটা আশার আলো, কম পাওয়ারের হলেও, জ্বলে উঠত, যখন আমি বলতাম অনির্বাণের বাড়ি যাচ্ছি। মা-বাবা মনে করতেন, সারাদিনের পড়া ঝালিয়ে নেওয়া বা আসন্ন পরীক্ষার ব্যাপারে একটু মাথা খাটানোর জন্যই এত ঘনঘন যাতায়াত নিশ্চিত।
সেই নিশ্চয়তার সুযোগ নিয়ে অনেক দিনই টিমটিমে আলো-জ্বলা রাস্তার ট্র্যাফিক কাটিয়ে, অটোর ধারে জাঁকিয়ে বসে পৌঁছতাম অনির্বাণের বাড়ি। বাঁশদ্রোনী মোড়ে নেমে, খালগঙ্গার ব্রিজ পেরিয়ে কিছুদূর হাঁটলেই ওর পাড়া, ওর ঘর। বেশিরভাগ সন্ধেতেই কাকিমা মুড়ি মেখে এনে দিতেন, খেতে খেতে আমরা গল্প করতাম বা গান শুনতাম। বলাই বাহুল্য, সেসব গান বা গল্প আমাদের উচ্চমাধ্যমিকের সিলেবাসে ছিল না। কিন্তু হপ্তায় একদিন অন্তত আমরা একটু জমিদারি মেজাজে বেরতাম, বাঁশদ্রোনী বাজারের দিকে। এমনভাবে খালপাড় দিয়ে হেঁটে ব্রিজ পেরিয়ে গম্ভীর চালে মোড়ের মাথায় এসে বাজারের দিকে হাঁটা দিতাম, যেন কোনও গোপন অভিযানে বেরিয়েছি দুই গোয়েন্দা। অবশ্য আমাদের এ-অভিযান গোপনই ছিল বটে। বাঁশদ্রোনী বাজারের মধ্যে ঢুকে, কিছু সবজি-দোকান, কিছু মাছ-মাংসের আঁশপালক ছাড়িয়ে, এ-গলি সে-গলির মোড় বেঁকে একখানা ছোট্ট স্টল। চারখানা ছোট গোল চাকার ওপর নিজের সমস্ত ভার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একখানা ঠেলাগাড়ি, তার মাথায় টিউবলাইট এমনভাবে বাঁধা, যেন কনের কপালে শোলার মুকুট। নড়বড়ে, কিন্তু শোভা বাড়াতে কসুর করছে না।

স্টলটা ছিল আমাদের সে-সময়ের ভাষায়, যাকে বলে, স্ন্যাকসবার। কথাটা মনে মনে বলেও একটা বেশ ব্যাপার হতো, মেজাজ আসত চনমনে। সম্ভবত শেষে ‘বার’ শব্দটা আছে বলেই। তখনও বারমুখো হইনি যদিও, কিন্তু ওই শব্দটাতেই বেশ একটা আচ্ছন্ন করা ব্যাপার ছিল। চলতি লোকজনের ভিড়ের ঠিক মাঝখানে স্থাণু হয়ে থাকা সেই স্ন্যাকস বারের কাটতি কিন্তু ফেলনা ছিল না। ঝরনার মধ্যে পাথর যেভাবে সম্ভ্রম নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, বহমান জনস্রোতের মধ্যে সে-ও ঠিক সেইভাবেই বিরাজমান থাকত। নিজের মর্যাদা আর রোল-চাউমিনের পূর্ণ সম্ভার নিয়ে।
মাঝবয়সী ভদ্রলোক বেশ গম্ভীর ছিলেন, দেখে বদমেজাজি বলেই ভয় হত। একজন সহকারি ছিল তাঁর, বয়সে কিশোর। রোল মুড়ে দেওয়া, পেঁয়াজ কাটা, খদ্দেরের কাছ থেকে পয়সা বুঝে নেওয়া ছিল তার কাজ। কিন্তু হাতের খেলটা ওই ভদ্রলোকই দেখাতেন। ব্যস্ত তাওয়ায় হাত ঘুরিয়ে তেলের ওপর খুন্তি নেড়ে একের পর এক নিপুণ চপচপে পরোটা তুলে এনে উড়ন্ত চাকতির মতো যখন ছুড়ে ফেলতেন পাশের লৌহচাতালে, আর তা নিমেষে সেজে উঠত মাংস, পেঁয়াজ, শসা, কাঁচালঙ্কা আর সসের প্রলেপে, আমরা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতাম। যদিও আমাদের লক্ষ্য থাকত চাউমিন।
মনে আছে, চিকেন চাউমিন ব্যাপারটা বিলাসিতা ছিল তখন। নিজেরা কেউ রোজগার করি না, জমিদারবাড়ির ছেলেও নই। অতএব হপ্তায় একদিন খাবারের পিছনে খরচ মানে, বুঝেশুনে এগোতে হবে। অনির্বাণই বেশিরভাগটা দিত, আমি সাধ্যমতো, যাকে বলে, কনট্রিবিউট করতাম। মাসে একদিন চিকেন চাউমিন খেতাম না তা নয়, ডিমের বদলে তখন ন্যুডল-এর এলোমেলো চুলে ভরা মাথায় ফুটে উঠত একটি দুটি মাংসের ফুল, অতি সন্তর্পণে যাকে শেষপ্রান্তে ঠেলে রাখতাম আমরা। আসলে কাবাবেরই মাংস, যা দিয়ে রোল তৈরি হয়। ওটাই চার টুকরো ছড়িয়ে দিলে ঝটপট চিকেন চাউমিন। কিন্তু তার দাম বোধহয় তখন ছিল বারো টাকা মতো। অত টাকা আমরা কোথায় পাবো? তাই জমজমাট খদ্দেরের ভিড়ে মুখচোরা একখানা এগ-চাউমিন অর্ডার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। কখনও দরদরে ঘামের গরমে, কখনও ঝমঝমে বৃষ্টির কাদায়, আবার কখনও ছিমছাম শীতের হাওয়ায়। আমাদের চাউমিন রান্না হত গনগনে আঁচে, উদার তাওয়ায়, শিল্পীর হাতের তৎপরতায়। আমরা মুগ্ধ হয়ে দেখতাম, সাত টাকার বিনিময়ে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের হাতে আসতে চলেছে পৃথিবীর সেরা খাদ্যটি।
কী সব মশলা যে দিতেন ভদ্রলোক, কে জানে। দু’হাতে দু’দিক থেকে ঢালতেন সেসব, যেন বাচ্চা ছেলে বা মেয়ের মাথায় জল ঢালছেন। আর চুলেরই মতো কিলবিলে ন্যুডল ভিজে উঠত, ছ্যাঁকছোঁক আওয়াজ ছাড়ত গরম তাওয়ার গায়ে। সস্তার ‘লোকাল’ উপকরণ সব। কিন্তু স্বাদটা দামী হতো। এক প্লেটই নিতাম আমরা, গল্প করতে করতে হাপুস হুপুস শব্দে সাবাড় করার লোভে। তাওয়া থেকে একখানা আঁকাবাঁকা, নোংরা-জলে-সদ্য-ধোওয়া স্টিলের প্লেটে নেমে আসত সেই মহার্ঘ পদ, যার নাম এগ চাউমিন। একটু বিরক্তই হতেন হয়তো ভদ্রলোক, ভিড়ের সময়ে দু’জন এসে এক প্লেট ভাগ করে খেয়ে যাচ্ছে। দু’খানা তোবড়ানো কাঁটাও জুটত আমাদের কপালে। পাতলা স্টিলের, কানাবাঁকা, নিরূপায় দু’টি কাঁটা। আর আমাদের দিকে এগিয়ে দেবার আগে, চাউমিনের ছোট্ট, গরম, ধোঁয়া ওঠা আগ্নেয়গিরির মাথায় ভদ্রলোক ঢেলে দিতেন চিলি আর টোম্যাটো সস, সঙ্গে একটু কাঁচা পেঁয়াজ আর শসা। এ-জিনিস কোনও রেস্তোরাঁয় পাওয়া যাবে না, বরং পাওয়া গেলে শেফকে জবাবদিহিই করতে হতে পারে। কিন্তু ওই ভরাবাজারের ছোট্ট গুমটি দোকানের তেলচিটে এগ চাউমিনের ওটাই ছিল ফাইনাল মেক-আপ, যাতে তাকে আরও সুন্দর দেখায়। এক প্লেট মানে একটাই ডিমের অমলেট করে তাকে ভেঙে মেশানো, খুচরোর মতো সে মিশে থাকত চাউমিনের গভীর উষ্ণ অরণ্যে। আমি আর অনির্বাণ মোহরের মতো করে কুড়োতাম ডিমের এক একটি টুকরো। শুরু হত, ওই ছোট্ট স্টিলের প্লেটে, আমাদের গোপন অভিযান।
মনে আছে, চিকেন চাউমিন ব্যাপারটা বিলাসিতা ছিল তখন। নিজেরা কেউ রোজগার করি না, জমিদারবাড়ির ছেলেও নই। অতএব হপ্তায় একদিন খাবারের পিছনে খরচ মানে, বুঝেশুনে এগোতে হবে। অনির্বাণই বেশিরভাগটা দিত, আমি সাধ্যমতো, যাকে বলে, কনট্রিবিউট করতাম।
মাঝপথে এসে ডিম শেষ, পেঁয়াজ শসা শেষ, চাউমিনও প্রায় ঠান্ডা। তখন সাহস করে আমাদেরই কাউকে বলতে হত, ‘কাকু, আর একটু সস হবে?’ নেহাত কমবয়সী ছেলে, তাই হয়তো কিছু বলতে পারতেন না। যেদিন যেটা হাতের কাছে পেতেন, ঢেলে দিতেন আমাদের প্লেটে। অনেক আড্ডা জমে থাকত আমাদের, কিন্তু অমন সুস্বাদু আর কড়াই-গরম চাউমিন জমিয়ে খেতে গিয়ে কথার জন্য মুখ খোলাই হত দায়। শেষ হলে, গুমটির পাশের মাটিতে, জলভরা বালতির কাছে নামিয়ে রাখতে হত প্লেট আর কাঁটা। কিছুক্ষণ পরপরই ওই কিশোর সেসব চটজলদি ধুয়ে রাখছে, পরবর্তী খদ্দেরদের জন্য।
দাম মেটানো শেষ হলে বাজারের ভিড় ঠেলে আমরা উঠে আসতাম বাইরের পৃথিবীতে, যেন কিছুই হয়নি, এমন ভাব নিয়ে। আমাকে অটো ধরে ফিরে যেতে হবে গড়িয়া, অনির্বাণ হয়তো নিজের ঘরে পড়াশোনায় বসবে এখুনি। কিন্তু দূরে কোথাও, চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পেতাম, সন্ধের বাজারের মধ্যে একখানা টিউব জ্বলছে। যেন গুপ্তধনের সংকেত, যেন ডাকাতদলের নিশান। আর সেই আলোর চারপাশ ঘিরে আছে এক আশ্চর্য নোনতা ঝাঁঝালো গন্ধের তপ্ত আবহাওয়া, যাকে কেবল ব্যাখ্যা করা যায় স্বাদ দিয়ে। স্বাদের স্মৃতি দিয়ে। আর কোথাও তার কোনও ঠিকানা রাখা নেই।
নাম আর আজ মনে নেই সেই গুমটি দোকানের। আছে কিনা আদৌ, তাও জানি না। স্কুলফেরত কোনও দুই কিশোর আজও লুকনো পয়সা খরচ করে সেই সস্তার চাউমিন চাখতে হাজির হয় কিনা, অজানা তাও। কেবল এইটুকু জানি, ওই কিনার-বাঁকা স্টিলের প্লেট, আর তার ওপর সাজানো দু’খানা তোবড়ানো সরু কাঁটা আজও জেগে আছে। সময়ের সাক্ষী হয়ে, ঘড়ি হয়ে। দালির ছবির মতোই হয়তো ঝুলছে কোনও গাছের কঙ্কাল থেকে, গলন্ত অবস্থায়। আমাদেরও তো অনেকখানি সময় গলে গেল ওই তাওয়ার সান্ধ্য উত্তাপে। স্টিলের প্লেটের গায়ে ঘুরতে ঘুরতে কাঁটাদুটোও এখন সন্ধেয় এসে থমকেছে কিনা, কে জানে…
শ্রীজাত জাত-কবি। লেখা শুরু করেছিলেন নব্বইয়ের দশকের শেষাশেষি। ২০০৪-এ এসেই কাব্যগ্রন্থ 'উড়ন্ত সব জোকার'-এর জন্য আনন্দ পুরস্কার। গীতিকার হিসেবেও জনপ্রিয়তার শিখরে। পাওয়া হয়ে গিয়েছে ফিল্মফেয়ারও। ২০১৯-এর বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে বই 'যে জ্যোৎস্না হরিণাতীত', গদ্যসংকলন 'যা কিছু আজ ব্যক্তিগত' এবং উপন্যাস 'যে কথা বলোনি আগে'। এ যাবৎ প্রকাশিত বাকি কাব্যগ্রন্থের তালিকা এপিকসদৃশ দীর্ঘ। ট্রোলিংয়ের তোয়াক্কা না-করেই ফেসবুকে নিয়মিত কবিতা লিখে পাঠকদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রাখতে পছন্দ করেন টেক স্যাভি কবি।
বাঃ।হারিয়ে গেলাম ছোটবেলায়
বড় সুন্দর লেখা। মোম হয়ে গ’লে যাওয়া স্মৃতি যেন চুঁইয়ে নামছে সময়ের গা বেয়ে। এত সুন্দর সব উপমা কোন গোপন স্বর্গ থেকে যে লুট করে নিয়ে আসেন, অবাক মুগ্ধতায় ভাবতে থাকি তাই।
বাহ্.. খুব ভালো লাগলো আপনার লেখা.. আসলে কিশোর বেলায় তো বিচার থাকে না . থাকে শুধু আকাশের মতো বিশাল এক জীবনের কৌতুহল আর ভালোলাগা..
khub bhalo lagche porte.
পড়তে গিয়ে নিজের কিশোর বেলায় আবার ফিরে গেলাম।