আগের পর্ব পড়তে: [] [] []

মানুষ দেখার নেশা আমার। সে নেশা বুঝি ফুরোবে না কোনওদিন। মানুষের সঙ্গলাভের ইচ্ছে আসলে। সে ইচ্ছের তো ভূগোল নেই কোনও! কখন যে কার সঙ্গে আচমকা দেখা হয়ে যায়! 

সেও এক চোত-বোশেখের দিন, কলকাতা শহরে বিকেল নামবে সবে। পিঠে ব্যাকপ্যাক নিয়ে দুটি বোন আমার বাড়ির চৌকাঠে এসে দাঁড়ালো। ওদের মুখে ক্লান্তি। ওদের চোখে হাসি। সে হাসিতে বিষাদ মিশে ছিল। থাকবে না! মিনিবাসে কে জানি ওদের হাতব্যাগের টাকা চুরি করে নিয়েছে। সেসব বিষাদ পেরিয়ে ওদের জীবনের গল্পে গিয়ে পৌঁছোই অবশেষে। সেই কোন সুদূর তাইওয়ানে ওদের বাড়ি। দিদি রুহ, বোন চেলা। চেলা ছটফটে, ঝলমলে, প্রাণচঞ্চল। দিদি শান্ত, গভীর। নাই বা জানলো ইংরেজি! বোনের সঙ্গে সঙ্গে তো থাকতে পারবে! চেলা’র আয়ু আর কতদিন কে জানে! ব্লাড ক্যানসার ওর শরীরকে প্রতিদিন থামিয়ে দিতে চাইছে। এমন মৃত্যুপথযাত্রী মেয়েকে নিয়ে কী করে বাবা-মায়েরা! কী-ই বা করতে পারে! চেলা’র বাবা তাই ওকে বলেছে  – তোমার জীবন কখন যে থেমে যাবে তার তো নিশ্চয়তা নেই! তুমি দেশ দেখে বেড়াও, পৃথিবী দেখে বেড়াও। সঞ্চয়ের পুঁজি উপুড় করে দিয়েছেন তিনি আর সঙ্গে দিয়েছেন বড় মেয়ে রুহ-কে। চেলা আর রুহ তাই এশিয়া ঘুরতে বেরিয়েছে। 

Chella girl from Taiwan at Amritsar
অমৃতসরে চেলা

সন্ধে নেমে আসা কলকাতা শহরে তখন আলো জ্বলে উঠতে শুরু করেছে সবে। সেসব আলো চেলা’র মুখের কাছে ম্লান লাগে তখন। মনে হয় এই দু’দিন অন্তত ওদের পাশটিতে বসি, ওদের কথা শুনি। এমন শরীরে পথচলতি খাবার খেয়ে জুত হয় না। আমি তো তাইওয়ানের রান্না শিখিনি, তবু মনে হয় নরম ভাত আর ঝিঙে সেদ্ধ বুঝি দেওয়া যায় ওদের। আর কিছু না হোক লাউয়ের ঝোল। লোকে শুনলে বলবে, এ তোমার কেমন মেহেমানদারি! বিন্নি চালের ভাত দিয়ে ঝিঙে সেদ্ধ মেখে নিতে নিতে ওরা গল্প বলে। কত না দেশের গল্প, কত না অভিজ্ঞতার গল্প, ওদের বাড়ির গল্প, ইস্কুলের গল্প। সেসব গল্পে আসলে জীবনের কত না রামধনু থিতু হয়ে আছে। সেসব গল্প আসলে জন লেননের গান হয়ে উঠতে চায় ক্রমে। চেলার বাবা কি রবীন্দ্রনাথকে চেনেন? না বোধহয়। চিনলে তিনি জানতেন, অসুস্থ মেয়ের বিছানার পাশে বসে বসে কেমন করে গল্প বলে যান একজন। মেয়ে আর ফিরবে না জেনেও সেসব গল্পের বিকেলে কত রং এসে জড়ো হতো। মেজো মেয়ে রেণুকাকে নিয়ে পাহাড়ে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেও তো এই সব কিছু ছেড়েছুড়ে দিয়ে চলে যাবে জেনেও! মেয়েকে তিনি শিখিয়েছিলেন উপনিষদের মন্ত্র  – ‘ওঁ পিতা নোহসি..।’ ব্যাখ্যা করে বুঝিয়েছিলেন সেসব। এই পৃথিবী ছেড়ে যেতে যদি তার (রেণুকার) কষ্ট একটু কম হয়! এমন করেও একজন বাবা ভাবতে পারেন! 

column on unconventional lives by Amrita Bhattacharya
স্থানীয় মহিলাদের সঙ্গে দার্জিলিঙে

চেলা’র বাবাকেও আমার তাই দেখতে ইচ্ছে করে খুব। মেয়ের মুখে এমন প্রত্যয়ের আলো জ্বালিয়ে দিতে পারেন যিনি তিনি তো সহজ নন! এসব ভাবতে ভাবতে দেখি রুহ আমার পাশটিতে এসে দাঁড়িয়েছে। ও তো ইংরেজি জানে না, আমিও ওর ভাষা জানি না। আমরা চোখের ইশারায় কথা কই। চেলা তো আর ঘুমিয়ে পড়ার মেয়ে নয়! ওর পোলারয়েড ক্যামেরায় তোলা কত যে ছবি বসে বসে দেখায় ও! তাইওয়ান হয়ে জাপান, থাইল্যাণ্ড আরও কত না দেশের গাছ,ফুল, মানুষ ওর ক্যামেরায় বন্দী হয়েছে। সেসব ছবি দেখিয়ে দেখিয়ে ও গল্পের আসর জমিয়ে তোলে। ওর বর্ণনার রঙ আমায় অমলকে মনে পড়ায়। মাঝখানে গল্প থামিয়ে ও ওষুধের প‍্যাঁটরা খুলে বসে। ওষুধ খেতে খেতে কলকাতা দেখার গল্প শোনায় ও। রাস্তার ফটাসজল থেকে বাদাম ভাজার গন্ধ ওকে জড়িয়ে ধরেছে জীবনের উত্তাপটুকু দিয়ে। ভিক্টোরিয়ার পরী থেকে হাওড়া ব্রিজের জনারণ্য ওকে এমন করেও খুশি করতে পারে! সত্যি সত্যি তখন আর জীবনের উপর থেকে বিশ্বাস হারাতে ইচ্ছে করে না। বলি, কাল তাহলে আর কী কী দেখবে? গোবিন্দভোগ চাল দিয়ে কমলা কুসুমের ডিমসেদ্ধ খাবে? আমার তো আসলে দেওয়ার মতো কিছু নেই ওকে, তাই মনে হয় এটুকুই ওকে দিতে পারি বুঝি আমি। পরদিন ওরা শহর ঘুরে একই উত্তাপ নিয়ে ঘরে ফেরে। বাবার সঙ্গে ফোনে গল্প করে। ওর গলায় তখন দেশ ঘোরার আনন্দ,পৃথিবী দেখার খুশি উপচে পড়ে। 

Chella girl from Taiwan
দেশ বেড়ানোর নেশা ওর ঘোচেনি

যাঁরা ভূপর্যটকের জীবন বেছে নেন তাঁরা আর চেলা তো এক না! জীবন-মৃত্যুর মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে এমন করে দেশ ঘোরার আনন্দ তো সহজ নয়! আমরা ছেলেবেলায় গণেশ-জননীর গল্প শুনেছিলাম। মা-কে ঘুরলেই বিশ্বদর্শনের পরিপূর্ণতার আনন্দ, সেই তো ছিল সে গল্পে। সে মা কি এই গাছ মাটি আর মানুষের পৃথিবী নয়? শালিখ ফড়িং আর বরফ ঢাকা তুষার চূড়োর পৃথিবী নয়! দার্জিলিঙের সূর্যোদয়ের ছবি দেখিয়েছিল চেলা। বলেছিল, সে অভিজ্ঞতা যে কী অনন্য! ওর ছবি, ওর মুখ দেখতে দেখতে মনে পড়ছিল – ক্রিস্টিন গি, মার্গারেট গি আর গ্যারি ওয়ার একটা বইয়ের সম্পাদনার কাজ করেছিলেন। মূলত এভারেস্টজয়ী মানুষদের অভিজ্ঞতার কথা জুড়ে জুড়ে সে এক আশ্চর্য বই। মেজর এইচ পি এস আলুওয়ালিয়া ১৯৬৫’র মে মাসে সাগরমাথার চূড়োয় উঠেছিলেন। খুব সুন্দর করে বলেছিলেন তিনি, –  ‘The man who has been to the mountains is never the same again; he becomes conscious of his smallness and loneliness in the universe.’

চেলা’কে দেখতে দেখতে মেজরের কথাগুলো মনে পড়ে আমার। আমেরিকা মহাদেশ আবিষ্কারের যে আনন্দ ছিল,চেলার জীবনের আনন্দ কিন্তু তার চেয়ে এতটুকু কম নয়। পৃথিবীকে ও আবিষ্কার করুক প্রাণ ভরে। বারান্দায় হেলান দিয়ে আমাদের দুজনের একখানা পোলারয়েডে তোলা ছবি বহুদিন সাজানো ছিল ঘরে। গরমে, রোদে সে ছবিখান ক্রমে তার রং হারিয়ে ফেলেছে। সে তো ফেলবেই। জীবনের ধর্মই তেমন। তবু, সেসব রং হারিয়ে ফেলবার আগে মনের জানলাগুলো খুলে দেব না একবার! 

চেলা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সুস্থ। তবু দেশ বেড়ানোর নেশা ওর ঘোচেনি। সে নেশা কি ঘোচবার! যে মানুষ একবার পৃথিবীকে দেখতে শেখে তার সাধ কি ফুরোয়! সে সাধ ফুরোবার নয়। 

ছবি সৌজন্য: অমৃতা ভট্টাচার্য

Amrita Bhattacharya

অমৃতা ভট্টাচার্য (জ.১৯৮৪-) শান্তিনিকেতনের জল হাওয়ায় বড়ো হয়েছেন। পাঠভবনে তাঁর পড়াশোনা। পরে বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগ থেকে বাংলা উপন্যাসে বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে গবেষণা করেছেন। পড়িয়েছেন জগদ্বন্ধু ইনস্টিটিউশনে এবং পরে চারুচন্দ্র কলেজে। বর্তমানে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলের দেশজ রান্না নিয়ে কাজ করছেন। স্বপ্ন দেখেন পুঁজির প্রতাপের বাইরে অন্যরকম জীবনের, খানিকটা যাপনও করেন তা। যে হাতে শব্দ বোনেন সেই হাতেই বোনেন ধান, ফলান সব্‌জি। দেশ-বিদেশের নানা-মানুষের অন্যরকম জীবন দেখতে ভালোবাসেন। তাঁর লেখা স্মৃতিগ্রন্থ ‘বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ ’ এবং 'রেখেছি পত্রপুটে' পাঠকের সুসমাদর পেয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *