পৃথিবীর বয়স তো কম হলো না! তবু যেন তাকে চেনার সাধ ফুরায় না। পৌষের দুপুরে বিরান মাঠের ওপারে গরু চড়িয়ে বেড়ায় সুন্দরী, আমাদের সুন্দরীগোগো। গোগো মানে মা। ওর তালি দেওয়া শাড়ি, রিফু করা আলোয়ানের প্রান্ত এমন হিমেল হাওয়া আর রোদ মাখছে কত কত দিন ধরে সে খবর রাখে কে! সে খবর রাখতে বয়েই গেছে মানুষের। তবু দেখো, কাকীগোগোর এই মাঠ আর সর্ষেফুলের ওপারে নদীতীরের নিরাভরণ রুক্ষতা দেখা ফুরোয় না। ও তো কখনও জীবনানন্দ পড়েনি, তবু দেখো ও কেমন একা হতে শিখেছে! একা একা বসে এখন কেবল বাঁশপাতিদের উড়ান দেখবে ও। গুনতি মিলিয়ে গরুদের ঘরে ফেরাবার কাজ ওর। সে কাজে ওর মন ভরে না, কাকীগোগো তাই মাঠে মাঠে শাক তোলে কোঁচড় ভরে। সর্ষে শাক, বাথুয়া শাক আরও কত কী! কুলো ভরে ভরে, ডালা ভরে ভরে সর্ষের পাতা এমন শীতের রোদে শুকোবে। শুকিয়ে শুকিয়ে গুঁড়ো হয়ে গেলে বয়ামে ভরে তুলে রাখবে ও। ভরা ভাদরে কোনও দিন, আর যদি কিছু নাই জোটে তবে গরম ফ্যানে ওই শাক মেখে খাবে ও। খাবে ওর নাতি পুতির দল। টুকুন খানিক লবন আর ভাতে রাইশাকের গন্ধ ছড়িয়ে পড়বে মেটে দেওয়ালের চারধারে। শুধু কি শাক গো? মহুয়ার দিনে ভোর ভোর গাছের তলা বিছিয়ে পড়ে থাকে সাদা সাদা ফুল। সুন্দরীগোগো কোঁচড় ভরে মহুল কুড়োয় যত পারে। ওই মহুল শুকিয়ে বাদামি হলে তাই দিয়ে সময়ে সময়ে মানুষের স্বাদকে জাগিয়ে তুলতে জানে ও। শুকনো মহুল দিয়ে কী আশ্চর্য ডাল রাঁধে ও! মাঠ, জলা, জঙ্গলের সঙ্গে নিত্যদিনের মিতালি ওর। এই তো সেদিন ধানের ক্ষেত ভরে ছিল শুষনি শাকে। কোঁচড় ভরে শাক তুলেছিল ওরা বিকেলভোর।

আধুনিক বিশ্বের খাদ্য খাবারের খবরদারি নিয়ে কাকীগোগো যদি এতটুকু জানত! সেই কবে থেকে মাটি জল আর জঙ্গলের সঙ্গে ওর সখ্য। আনকাল্টিভেটেড ক্রপ বলে ওকে তো কেউ আলাদা করে বিশ্বপণ্যের বাজারনীতি চিনিয়ে দেয়নি! অ-কৃষিজাত ফল শাক আর কন্দে সেই শৈশব থেকে ওর অধিকার। ও জানে, কখন কোন গাছে মুকুল আসে, কখন কোন কোন গাছের ডাল ভাঙতে নেই। ওর এই জানাটুকু নিয়ে আ-বিশ্বের কারওর কোনও মাথাব্যথা নেই। বিপণনের মুখ হয়ে উঠবে না ও কোনোদিনও। অথচ এমন রোদ্দুর মরে আসা দুপুরে ওর নির্বিকার বসে থাকাটুকুর মধ্যে এক নির্বিকল্প সমাধির ছবি ফুটে ওঠে না কি? সে ছবি আমায় নিয়ে যায় কোন সে সুদূর বৌদ্ধ বিহারে।
সেই যেখানে জঙ কন তার রান্না আর যাপনের মধ্য দিয়ে বোধিকে স্পর্শ করতে চাইছেন প্রতিদিন। কোনও প্রথাসিদ্ধ কালিনারি স্কুল তো তাকে সার্টিফিকেট দেয়নি! তবু দেখুন, কী আশ্চর্য দক্ষতায় তাঁর যাপন দিয়ে তিনি সেলিব্রিটি শ্যেফের মর্যাদা পেয়েছেন! বিহারের পাশেই তাঁর শাক-সবজির বাগান। সে বাগানের গাছ গাছালির মধ্যে তিনি প্রতিদিন প্রাণকেই আবিষ্কার করেন। আবিষ্কার করেন মহাজাগতিক শক্তিকে। তাঁর রান্নাই যেন তাঁর ধ্যান। কী নিপুণ দক্ষতায় পদ্মের পাপড়ি দিয়ে তিনি চা বানান। পাপড়ির ভাঁজ খুলতে খুলতে তিনি যেন কোন কুলকুণ্ডলিনীকে স্পর্শ করতে চান! এ তো মা-মাসিদের আঁচলে হলুদ মুছতে মুছতে জনতা স্টোভে দু-চামচ চা আর চিনি ফুটতে দেওয়া নয়! ভিক্ষুণীর কোন গহীন হৃদয়ের সহজানন্দকে ছুঁয়ে যাওয়ার স্বাদ এসে থিতু হয় অমন পদ্মের চায়ে। ভিক্ষুণী যখন ওর নরম বেঁটেখাটো আঙুল দিয়ে কিমচির পাত্রগুলি সাজিয়ে রাখেন তখন তিনি মনে মনে জানেন ফার্মেণ্টেশনের মধ্য দিয়ে প্রতিদিন জড়ো হচ্ছে প্রাণবীজ। কোরিয়ান ভিক্ষু আর ভিক্ষুণীদের পাতে কিমচি পরিবেশন তাই ওঁর কাছে নিছক হেঁশেল সামলানো তো নয়! গেঁজে ওঠা কিমচির পাত্র ওর কাছে এই মহাজাগতিক শক্তিকে ছুঁয়ে যাওয়ার আশ্চর্য বোধিচিত্ত। এমন করেও যে রান্নার মধ্যে একখানা আধ্যাত্মিক যাপন এসে মিলেমিশে যেতে পারে সেকথা কেই-বা ভেবেছিল! অথচ তাবড় বিশ্ব এমন একজন ভিক্ষুণীর সামনে এসে তাদের ক্ষুধার পাত্রখানি মেলে ধরতে উদগ্রীব। সকলেই সামান্য হলেও আস্বাদ করতে চায় এমন রান্না। চাইবে নাই বা কেন বলুন! তেল-নুন-লকড়ির রান্নাঘরে এমন করে একটুকরো প্রাণকে ছুঁতে চায় সকলেই।

অথচ কী স্বাভাবিক দেখুন, এঁদের কেউই তো আর সুন্দরীগোগোকে চেনে না! চেনা সম্ভবও নয়। যদি তাঁরা চিনতেন, তবে তাঁরা টের পেতেন – ওই বিরান মাঠের ওপারে চেয়ে চেয়ে কাকীগোগো ওর হারিয়ে যাওয়া মেয়ের কথা ভাবে। খালাস দিতে গিয়ে নেই হয়ে যাওয়া মেয়ের মুখ মনে করে ও শাক তোলে দুপুর ভর। এ গাঁয়ের লোক জানে, সুন্দরীর হাতে হাড়িয়ার স্বাদ খোলে ভালো। চালে আর বাখরে মিলিয়ে মিশিয়ে দিতে দিতে সুন্দরী গোগো কি আসলে কোনও প্রাণকেই স্পর্শ করতে চায় কোনও এক গভীর চৈতন্যের অতলে? হয়তো বা। কিন্তু আপনি যদি বেমক্কা এসব প্রশ্ন করে বসেন, কাকীগোগো তাহলে ভাষাহীন চোখে চেয়ে রইবে কেবল। বলেছি না, ও তো আর জীবনানন্দ পড়েনি! ও কেবল উদাস হয়ে বলে বসতে পারে, হাড়িয়ার স্বাদ হবে কী করে বল! পাড়ু ধানের চাষ কি আর কেউ করে? স্বর্ণতে (ধান) কি আর হাড়িয়ার স্বাদ হয় রে! এমন করে পাড়ু ধানের নিরুদ্দেশ সংবাদ আর কে দেবে বলুন এ গাঁয়ে! এই আক্ষেপের স্বরে মেয়েকে হারানোর বিষণ্ণতার সুরও কি মিশে আছে? থাকতেও পারে। মাটি জল আর মানুষকেই তো ও চিরকাল স্বাভাবিক বলে চিনে এসেছে! সেই ওর ধ্যান, সেই ওর বোধি।
বেলা ফুরিয়ে এল। গরুরা এখন ধুলো উড়িয়ে বাড়ি ফিরবে। সূর্য ডুবে যাওয়া পশ্চিম আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে সুন্দরী গোগো আর কিছুক্ষণে ঘরে ফিরবে। এই গাঁয়ের মাটি ক্ষেত আকাশ কালকাসুন্দার ঝোপ দেখবে ওকে। দেখবে নাই বা কেন বলুন, ওই তো ওদের সেই সহজসুন্দরী। কোন সে কুলকুণ্ডলিনীকে স্পর্শের আকাঙ্ক্ষায় ও প্রতিদিন পান্তাভাতের সানকিতে ওষ্ঠ ছোঁয়ায়। ওর আঙুল রোদ্দুরে মেলে দেয় চুকাপাতির পাপড়ি। ওর মধ্যে এ গাঁয়ের বোধিচিত্তখানা প্রাণ পাচ্ছে আজও! ওর চলে যাওয়ায় স্থির হয়ে আছে পশ্চিমের আকাশ, অনন্ত গোধূলির আলো। গোগো, তুমি কি এখন ভাত রাঁধবে?
আগামী পর্ব: ১৫ মার্চ ২০২৩
ছবি সৌজন্য: লেখক ও Flickr
অমৃতা ভট্টাচার্য (জ.১৯৮৪-) শান্তিনিকেতনের জল হাওয়ায় বড়ো হয়েছেন। পাঠভবনে তাঁর পড়াশোনা। পরে বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগ থেকে বাংলা উপন্যাসে বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে গবেষণা করেছেন। পড়িয়েছেন জগদ্বন্ধু ইনস্টিটিউশনে এবং পরে চারুচন্দ্র কলেজে। বর্তমানে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলের দেশজ রান্না নিয়ে কাজ করছেন। স্বপ্ন দেখেন পুঁজির প্রতাপের বাইরে অন্যরকম জীবনের, খানিকটা যাপনও করেন তা। যে হাতে শব্দ বোনেন সেই হাতেই বোনেন ধান, ফলান সব্জি। দেশ-বিদেশের নানা-মানুষের অন্যরকম জীবন দেখতে ভালোবাসেন। তাঁর লেখা স্মৃতিগ্রন্থ ‘বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ ’ এবং 'রেখেছি পত্রপুটে' পাঠকের সুসমাদর পেয়েছে।
আরেকটা পৃথিবীর যাপন