আগের পর্বের লিংক: []

আমার তখন বয়েস অর্ধেক।

গ্রাম থেকে কলকাতায় এসেছি। তখনও ভিসা পাইনি কলকাতার। একজন আউটসাইডার হিসেবে দু’ একটা জায়গায় গেটক্র্যাশ করেছি। তাতে আমার ফল ধরেনি। কিন্তু জীবনে প্রথম সুযোগ এল প্নেনে ওঠার। প্রথমে লোকে বাগডোগরা যায়। আগরতলা যায়। মেরেকেটে দিল্লি। আমার হাতে যখন টিকিট এসে পৌঁছল তখন অনেকক্ষণ টিকিট খুলে বসেছিলাম। এয়ার ইন্ডিয়ার সরকারি টিকিট। তাতে লেখা,  কলকাতা-নিউ ইয়র্ক-কলকাতা। জেএফকে। একেবারে সোজা নিউ ইয়র্কে নামতে হবে, জন এফ কেনেডি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। আমি আয়নাকে জিজ্ঞাসা করলাম, স্যার, আমি কি পারব নামতে

আর নামলেই হবে না। যেতে হবে আমেরিকার সবচেয়ে মারকাটারি কবি অ্যালেন গিনসবার্গের বাড়ি। লেক গার্ডেন্সে থাকতাম তখন। বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমেরিকার সময় হিসেব করে ফোন বুথ থেকে অ্যালেন গিনসবার্গকে ফোন করেছি একবার। যা করেছি তাকে ফোন করা বলে না। একটা করে বাক্য বলছি আর মিটার দেখছি।
– হ্যালো অ্যালেন, হাউ আর য়্যু? বলে তাকালাম, দশ টাকা।
– দিস ইজ সুবোধ ফ্রম ইন্ডিয়া, ফ্রম কলকাতা। কুড়ি টাকা।
– থ্যাংক য়্যু ফর ইওর লেটার। আরও পনেরো টাকা।
অ্যালেন নিজে জিজ্ঞাসা করলেন হাউ ইজ সুনীল? আমি বললাম, হি ইজ ফাইন। কুড়ি টাকা।

Allen Ginsberg
আমাকে যেতে হবে আমেরিকার সবচেয়ে মারকাটারি কবি অ্যালেন গিনসবার্গের বাড়ি

এই ফোনটা করার কোনও দরকার ছিল না। টাকাগুলো জলে গেল। তিরিশ বছর আগে পাবলিক বুথ থেকে আমেরিকায় ফোন করতে হলে এভাবেই করতে হত আমাকে। আর আজ হোয়াটসঅ্যাপে মাসিমা পিসিমা সবাই মিলে তাদের দুলালীকে ঝিঙে পোস্ত কী করে রাঁধতে হয়, তার রেসিপি শেখাচ্ছেন। 

দু’সপ্তাহ ধরে অ্যালেন গিনসবার্গকে সকাল বিকেল দেখে আমার একটা জিনিস মনে হল। এত বড় কবি। এত নাম। এত বদনাম। কবিতা লিখে বোমা মেরেছেন হোয়াইট হাউসে। কলেজ ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে মিছিল বের করেছেন আমেরিকার ভিয়েতনাম আক্রমণের বিরুদ্ধে, যাঁর কথা এত পড়েছি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখায়, সেই লোকটাকে আমি পেলাম না। সেই লোকটা আর নেই। উবে গেছে। এখন তিনি টাই পরেন।

কিন্তু এই লোকটার জন্যই আমি সেবার একটা খনির সন্ধান পেয়েছিলাম। অ্যালাবামা থেকে পালিয়ে আসা এক তরুণ কবির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন অ্যালেন। সেই তরুণ কবি আমাকে প্রথমদিন বলেছিল,
পোয়েটস শুড লিভ লাইক অ্যানোনিমাস পোয়েটস। তোমার একটা ইন্ডিয়ান নাম আছে। আমার একটা আমেরিকান নাম আছে। আই জাস্ট হেট ইট। আমি যে কালো, আমার গায়ের রঙ কালো সেটা আমার নামের ভেতর লেখা আছে। তুমি যে ব্রাউন সেটা তোমার নামে লেখা আছে। 

অ্যালেন আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু তরুণ কবির নামটা বলেননি। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করতেও পারিনি। সে নিজেই দ্বিতীয় দিন আমাকে বলল, ‘আমাকে তুমি M-9 বলে ডাকতে পারো।’ এম নাইন কোনও মানুষের নাম? এক সপ্তাহ বাদে সে আমাকে একটা কবিতা শুনিয়েছিল। এক অসামান্য কবিতা। আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। এত ভাল কবিতা লেখে ছেলেটা, অথচ ছাপাতে চায় না। সারাদিন নিজের সঙ্গে থাকে। নিজের সঙ্গে কথা বলে। কোনও সমসাময়িক কবির সঙ্গে মেশে না। আমি জানতে চেয়েছিলাম, কোনও কবি বন্ধু নেই তোমার? এম নাইন বলেছিল, কবি কখনও বন্ধু হয় না। আমার বন্ধুর নাম মুনলাইট। আমার বন্ধুর নাম ব্ল্যাকম্যাজিক। আমার বন্ধুর নাম আটলান্টিক। 

Fantasy is a failure
কল্পজগৎ আসলে এক ব্যর্থতা

এম নাইন বলে কোনও কবি গত তিরিশ বছরে উঠে আসেনি আমেরিকায়। আমি বারোবার আমেরিকায় গিয়েছি, এই নামে কেউ কোনও কবির নাম শোনেননি। আমি যেবার ফুলব্রাইট ফেলোশিপ পেয়ে পড়াতে গিয়েছিলাম, সেবার একটি আউটরিচ পোগ্রামে অ্যালাবামাতেও গিয়েছিলামসেখানে কৃষ্ণাঙ্গ কবিদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কেউ বলতে পারেননি এম নাইনের কথা। তার একটি কবিতা আমার কানের ভেতরে মাইক্রোচিপ হয়ে থেকে গেছে–

Name is a fantasy
Fantasy is a failure
Failure is a dragon
Dragon is a fury
Fury is no love . It is a killer and it kills the killer.

I have no name.
Do you name a wave?
Do you name a cloud?
Do you name a lightning? 

Name is a fantasy.
Name is a xenophobia
Name is a masterbation
When the gods musterbate do the humans watch?

My blood is Alabama.
My love is fury of flora.
I’m no black You are black.
The black of the universe
is no fantasy.

I am M 9 , a loner like a laptop sitting on the top of the mountain

Waiting for the last lightning.

এবার আসি বাঁকুড়ায়। বাঁকুড়া আমাদের অ্যালাবামা। গরিব কিন্তু এম-নাইনের মতো তীব্র আত্মসম্মান বোধে বজ্রের মতো কঠিন। সবচেয়ে শুকনো জেলা। সবুজ নেই। মর্মর শোনা যায়। কিন্তু এখানে মর্মর মানে হাহাকার। এখানে প্রতিধ্বনি মানে ক্রোধ। এখানে পূর্ণিমা মানে খিদে। শত্রু যত না পুলিশ, তার চেয়ে বেশি শত্রু অমাবস্যা। সেই রকম একটি জেলায় থাকেন এক জেদি যুবক। পঞ্চাশের দিকে এগিয়ে চলেছে তাঁর বয়েস। তিনি একজন প্রাইভেট টিউশনি করা মাস্টার। সারাদিন টিউশনি করেন। সংসার আছে। চাল ডাল তেল হলুদের অমরত্ব দিয়ে তাঁর কোনও লাভ হবে না। 

টিলার মাথায় হাতে একটা ঝলসানো মুরগির ঠ্যাং নিয়ে বসে আছেন সেই জেদি যুবক। তাঁর পেছনে কোন অর্ফিউস নেই। তাঁর পেছনে কোনও বিশ্বভারতী নেই। রেডিও, টেলিভিশন নেই। তাঁকে রক্ষা করতে পারে, এমন কোনও ইনসিওরেন্স নেই। তাঁর পেছনে এমনকী কোনও লিটল ম্যাগাজ়িনও নেই। তাঁর নাম স্বরূপ চন্দ। তাঁকে বাঁকুড়ার এম নাইন বলে ডাকতে ইচ্ছে করে। ওপরে এম নাইনের যেমন একটা পুরো কবিতা তুলে দিয়েছি, তেমনি স্বরূপের একটি কবিতা তুলে দিলাম। দুটো কবিতার মধ্যে কোন মিল নেই।

পৃথিবীতে আসলে কোনও দুটো মৌলিক কবিতার মধ্যে মিল নেই। আমরা হেলেনকে জোর করে টেনে আনি বরিশালে। বসিয়ে রাখি বনলতা সেনের পাশে। কোনও মিল নেই। একটা লেখা হয়েছে অ্যালাবামাতে। একটা লেখা হয়েছে বাঁকুড়ায়। কিন্তু দুটো জায়গা-ই বড় শুকনো। বড় রিক্ত। হাহাকারময়। 

দুটো জায়গাতেই আমি গিয়েছি। বাতাস ছোবল হয়ে ঘুরে বেড়ায়।

রূপেন হাঁসদা

স্বরূপ চন্দ

আমি বাঁকুড়ার পাবলো নেরুদা
চিলি আমার দেশ নয়
লাতিন আমেরিকা আমার মহাদেশ নয়
সানতিয়াগো নয়, আমার জন্ম পুরুলিয়ায় বান্দোয়ানে।

একদিন বাঁকুড়া থেকে দিল্লি যাচ্ছি
আমার প্লেন ক্র্যাশ করল ফুলডুংরি জঙ্গলে
দুদিন জ্ঞান ফিরল না
তৃতীয় দিন মাঝরাতে জ্ঞান ফিরল যখন
দেখি একটা লোক পিঠে স্লিপিং ব্যাগ, কাঁধে বন্দুক নিয়ে
একটা আধপোড়া খরগোশের ঠ্যাং চিবোচ্ছে।

আমি লোকটাকে চিনতে পারলাম
লোকটাকে দেখেই আমার পায়ের নীচের মাটি কেঁপে উঠল
এই লোকটার ছবি যিশুর চেয়েও বেশি বিক্রি হয়
এই লোকটার জন্ম আর্জেন্টিনায়, মৃত্যু বন্দুকের গুলিতে
এই লোকটা বলিভিয়ার জঙ্গলে গান লেখে
কিউবার রাস্তায় সুর করে
আর খোলা আকাশের নীচে গায়:
                  ‘উই শ্যাল ওভারকাম’।

লোকটা আমার মনের কথা বুঝতে পারল
সে আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল:
এটা বলিভিয়া নয়, ফুলডুংরির জঙ্গল
আমি চে গেভারা নই-
    জঙ্গলমহলের রূপেন হাঁসদা।

 

*ছবি সৌজন্য: Shutterstock, biography.com

জন্ম নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরে‚ ১৯৫৮ | ইংরাজি সাহিত্যের অধ্যাপক | পড়িয়েছেন আমেরিকার আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। 'দ্বৈপায়ন হ্রদের ধারে' এনে দিয়েছে সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার‚ ২০১৩ সালে| বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ কবিতা আকাদেমির সভাপতি। লিখেছেন পঁয়ত্রিশটি কাব্যগ্রন্থ যার মধ্যে রয়েছে একা নরকগামী (১৯৮৮), জেরুজালেম থেকে মেদিনীপুর (২০০১), মণিপুরের মা (২০০৫) ইত্যাদি। 'ভাষানগর' পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে সুবিদিত।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *