১
গুপ্তচরদের গোপন বার্তা বা সংকেত বা Code– আজকের দিনের অতি পরিচিত একটি ঘটনা। সে ব্যাঙ্কের ATM-এর পাসওয়ার্ডই হোক, কিংবা ই-মেল বা ফেসবুকের পাসকোড– সবই আসলে সংকেতের খেলা। আজকের দুনিয়াতে মিলিটারির গোপনতম তথ্য, অপরাধীদের নিজস্ব খবর চালাচালি, গোটা দুনিয়ার টাকা পয়সা লেনদেন, সব কিছুই নির্ভর করছে কি-বোর্ডের সাংকেতিক কিছু “কোড”-এর উপর। বিশ্ব আজ যেন অদৃশ্য সব দরজায় ঢেকে নিয়েছে নিজেকে, যার চাবি একমাত্র এই ‘কোড’গুলি।
এই গোপন বার্তা বা সংকেতের ইতিহাস মোটেই আধুনিক নয়। বরং বেশ প্রাচীন। ইতিহাসের জনক হেরোডোটাসের লেখায় খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে গ্রিস ও পারস্যের যুদ্ধে এই গোপন বার্তার ভূমিকার কথা উল্লেখ করেছেন। যখন পারস্যের রাজা জ়েরেক্সেস পারসেপোলিস নগরে নিজের রাজধানী স্থাপন করেন, তখন প্রতিবেশী সব রাষ্ট্র উপঢৌকন পাঠায় তাকে– ব্যতিক্রম এথেন্স ও স্পার্টা। প্রতিশোধ নিতে ৪৮০ খ্রিস্টপূর্বে জ়েরেক্সেস আচমকা এথেন্স ও স্পার্টাকে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। পারস্যের সুসা নগরে থাকত ডেমারেটাস নামের এক গ্রিক। চুরির দায়ে এককালে দেশ থেকে নির্বাসিত হলেও এই বিপদের দিনে সে চুপ ক’রে ব’সে থাকতে পারল না। মোম মাখানো কাঠের ট্যাবলেটে লুকিয়ে সে জ়েরেক্সেস-এর সৈন্যদের গতি প্রকৃতি জানিয়ে দিল গ্রিসকে। ফলে ২৩ সেপ্টেম্বর বিশাল সৈন্য নিয়ে জ়েরেক্সেস যখন গ্রিস আক্রমণ করলেন, তখন আক্রমণের চমকটাই গেল ভোঁতা হয়ে।
গ্রিকরা সংখ্যায় অল্প হলেও রীতিমতো ফাঁদে ফেলে পারসিকদের জব্দ করে। অবশ্য ডেমারেটাসের এই পদ্ধতিকে সঠিক অর্থে “সংকেত” বা “কোড” বলা চলে না। বরং গুপ্ত বার্তা বা hidden message বলা চলে। শোনা যায়, গ্রিক রাজা হিস্টাইরাস নিজের গোপন বার্তা পাঠাতে বার্তাবাহকের সব চুল কেটে নেড়া করে দেন। নেড়া মাথায় বার্তা লেখা হয়- পরে চুল গজালে বার্তাবাহক সেই বার্তা বহন ক’রে নিয়ে যায়। (বোঝাই যাচ্ছে রাজার গোপনীয়তা যত ছিল, তাড়া অতটা ছিল না।)। এই ধরনের বার্তাকে বলে স্টেগানোগ্রাফি (Steganography)। গ্রিক Steganos মানে ‘গুপ্ত’ বা ঢাকা আর graphin মানে (সবাই জানি) “লেখা”। প্রাচীন চিনারা হালকা মসলিনে গোপন বার্তা লিখতেন। লিখে সেই কাপড় গুটিয়ে, ছোট্ট বল বানিয়ে, মোম দিয়ে মুড়ে ক্যাপসুল মত বানিয়ে ফেলতেন। বার্তাবাহক সেই ক্যাপসুল গিলে ফেলত। কী করে সেই লিপি উদ্ধার হত? এহ বাহ্য! ইতালীয় বিজ্ঞানী জিওভান্নি পোর্তা ডিমসিদ্ধর উপর ফটকিরি আর ভিনিগারের মিশ্রণ দিয়ে লেখা চালু করেন। খোলার উপর কিছু না দেখা গেলেও খোলা ভাঙলে ডিমের উপর খয়েরি রঙের লেখা ফুটে উঠত। এই ধরনের বার্তায় মুশকিল একটাই। ধরা পড়লে সব চেষ্টা মাঠে মারা যেত। আর সেই জন্যেই উদ্ভূত হয় সাংকেতিক লিপি বা cryptography।
২
এই সাংকেতিক লিপি বা cryptography-র crypto শব্দটি এসেছে গ্রিক Kryptos থেকে, যার মানে “লুকানো”। কিন্তু এর উদ্দেশ্য বার্তাকে লুকিয়ে ফেলা নয়। বরং বার্তার মানেকেই লুকিয়ে ফেলা, যাতে সেই বার্তা হাতে পেলেও কীভাবে তা পড়তে হবে না জানলে কেউ তার পাঠোদ্ধার করতে পারবে না। গোপন বার্তাকে নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে ভেঙে ফেলা হবে, যে নিয়মটি শুধু গ্রহীতাই জানবে। যে পদ্ধতিতে বার্তাকে ভেঙে সংকেত বানাবেন প্রেরক, গ্রাহক ঠিক তার বিপরীত পদ্ধতি প্রয়োগ করে সে বার্তা উদ্ধার করবেন। যদিও Steganography-র সাথে cryptography-র আপাত কোনও সম্পর্ক নেই, তবুও বার্তার গোপনীয়তা বাড়াতে প্রথমে বার্তাকে সংকেতে পরিণত করে, তারপর লুকিয়ে ফেলা হয়। আসুন, বার্তাকে সংকেতে পরিণত করার প্রাচীন পদ্ধতিগুলি একটু দেখে নিই–
সংকেত তৈরির দুটি মৌলিক অংশ হল ‘transposition’ বা স্থান বিনিময় আর ‘substitution’ বা প্রতিস্থাপন। স্থানবিনিময় মানে একটি শব্দের অক্ষরগুলিকে শুধু এদিক-ওদিক সাজানো। যেমন, cow শব্দটিই ধরি। এর অক্ষরগুলিকে ছয়ভাবে সাজানো যায়। cow, cwo, ocw, owc, wco আর woc। কিন্তু যতই অক্ষর এবং বাক্যসংখ্যা বাড়বে, তত এই বিন্যাসের সংখ্যা বাড়বে হু হু করে। মাত্র ৩৫টি অক্ষরের একটি বাক্যকেই সাজানো যায় ৫০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০ রকমভাবে। একজন লোক প্রতি সেকেন্ডে একটি করে সম্ভাব্য বাক্য সাজালেও তার প্রায় এই ব্রহ্মাণ্ডের জীবনকালের হাজারগুণ সময় লাগবে সবক’টি বাক্যবিন্যাস পরীক্ষা করতে। অতএব এল প্রতিস্থাপন। স্থান বিনিময় প্রথায় অক্ষরগুলি কোনও নিয়মকানুন ছাড়াই এলোমেলো করা হয়, কিন্তু প্রতিস্থাপন পদ্ধতিতে একটু নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে এলোমেলো করা হয়। নীচের বাক্যটাই ধরি–
প্রাপককে শুধু গোটা পদ্ধতিকে উল্টে নিতে হবে। সামরিক কাজে সাংকেতিক বাক্যের প্রয়োগ প্রথম পাই স্পার্টাদের Scytale-এ। এই স্কাইটেল হল খাঁজ কাটা কাটা একটি কাঠের টুকরো। প্রথমে প্রেরক স্কাইটেল-এ ফিতের মতো একটি কাগজ জড়িয়ে সাধারণ বাক্যের মতো একটি বাক্য লেখেন। পরে সেই ফিতেটা খুলে নিলেই অক্ষরগুলি এলোমেলো হয়ে যাবে। প্রাপক শুধু একই ব্যাসের Scytale-এ ফিতেটি জড়িয়ে নিলেই বার্তা পুনরুদ্ধার হয়ে যাবে। ৪০৪ খ্রিস্টপূর্বে পারস্য থেকে আসা মৃত্যুপথযাত্রী দূত গ্রিক রাজা লাইসানডারের হাতে নিজের চামড়ার কোমরবন্ধটি দিয়েই মারা যায়। আসলে এটি ছিল একটি Scytale Crypt। লাইসানডার তার Scytale-এ বেল্টটি জড়াতেই জানতে পারেন গ্রিসকে আবার আক্রমণ করতে আসছে পারসিকরা।
আশ্চর্য হলেও সত্যি স্থান বিনিময় ও প্রতিস্থাপন পদ্ধতিতে সংকেত তৈরির প্রথম বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা পাই একটি ভারতীয় বইতে। বইয়ের নাম? চমকে উঠবেন না। “কামসূত্র”। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে লেখা এই বইতে ৬৪টি কলার মধ্যে ৪৫তমটির নাম “ম্লেছিতা-বিকল্প”। গ্রিকদের ম্লেচ্ছ বলা হত। জানি না সেখান থেকে এই শব্দের উৎপত্তি কিনা। নারীদের তাদের কাম-কীর্তি গোপন রাখতে ও প্রেমিককে গোপন চিঠি-ইত্যাদি পাঠাতে এই পদ্ধতি অপরিহার্য। এর মূল বৈশিষ্ট্য ছিল একটি অক্ষরকে অন্য অক্ষর দিয়ে প্রতিস্থাপন। ব্যাপারটা কেমন?
ফলে কাপে শাফগাছ মচো, মানে যে কী দাঁড়াবে, সেটা সহজেই অনুমেয়। প্রাপককে শুধু জানতে হবে কোন অক্ষর কী দিয়ে প্রতিস্থাপিত হচ্ছে। সেই লিস্টটা কোনও এক অভিসারের সময় প্রাপককে দিয়ে দিলেই হল। ঠিক এই পদ্ধতিই ব্যবহার করতেন জুলিয়াস সিজার। বিখ্যাত গেলিক যুদ্ধের সময়ে। এতে অবশ্য একটু পরিবর্তন করা হয়। ইচ্ছেমত এলোমেলো না সাজিয়ে প্রতিটি অক্ষরকে নির্দিষ্ট সংখ্যক ঘর পিছিয়ে দেওয়া হয়। যেমন তিনঘর পিছালে প্রতিস্থাপন হবে–
ফলে Caesar শব্দটি হয়ে যাবে Fdhvdu. প্রাপককে শুধু জানতে হবে মূল অক্ষরকে কত ঘর প্রতিস্থাপন করা হল।
৩
আজ যাকে Crypto analysis বলে, সে বিষয়ে সবচেয়ে অগ্রগণ্য ছিলেন আরবরা। ৮০০-১২০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে আরবে এই সংকেতচর্চা গণিতের একটি বিষয়ে পরিণত হয়। বর্তমান Crypto analysis-এর জনক যে বইটি, ‘A Manuscript on Deciphering Cryptographic Messages’- সেটি লেখা এক আরবি দার্শনিকের। নাম? আবু ইউসুফ ইয়াকুব ইবন ইসাক ইবন আস্-সাবাহ্ ইবন ওমরান ইবন ইসমাইল আল-কিন্দি। সংক্ষেপে আল-কিন্দি। তার বইটিতে তিনি শুধু বিভিন্ন সংকেত তৈরি নিয়েই চর্চা করেননি, নানা রকম অজানা সংকেতকে কি ভাবে ডিকোড করতে হয় তা-ও শিখিয়েছেন। শুনলে অবাক লাগবে, হেমেন্দ্রকুমার রায় তাঁর ‘যখের ধন’-এ কিংবা ডয়েল তাঁর বিখ্যাত ‘Adventure of The Dancing Men’-এ যে সংকেতগুলি ব্যবহার করেন, তা সবই আল-কিন্দির বইটিতে আলোচিত!
পশ্চিমের দার্শনিকরা অবশ্য অন্য যুক্তি দেখান। তাঁদের মতে Cryptography নিয়ে আলোচনা বাইবেলেই আছে। বাইবেলের কিছু অংশ সাংকেতিক atbash-এ লেখা। ব্যাপারটা কেমন? না alphabet-এর প্রতিটি অক্ষরকে তার ঠিক উলটো অক্ষর দিয়ে প্রতিস্থাপন। যেমন, a কে z দিয়ে, b কে y দিয়ে, এমনি। সেই হিসেবে JESUS হবে QVHFH আর BIBLE হবে YRYOV. পরবর্তীকালে রজার বেকন বা চসারের রচনাতেও বারবার এসেছে সংকেত ও তার ব্যাখ্যা। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি আবার লিখতেনই mirror image বানিয়ে। ফলে পাঠককে সামনে আয়না নিয়ে বসতে হত। সত্যজিতের ফেলুদা ডায়রি লিখত এই কায়দায়। এমনকী প্রফেসর শঙ্কুর ‘মরু রহস্য’ অভিযানেও একইরকম সংকেতের উল্লেখ আছে। তবে প্রথম বিখ্যাত ইউরোপিয়ান Crypto analyst ছিলেন জিওভান্নি সোরো। ১৫২৬ সালে ভ্যাটিকানের পোপের হাতে দুটি সংকেত আসে– দুটিই চার্চ-বিরোধী বলে সন্দেহ করা হয়। শোনা যায়, দুটিই নাকি সমাধান করেছিলেন ‘সরো’। ঠিক এই সময়টাতেই ইউরোপ জুড়ে বিভিন্ন code-এর উৎপত্তি হয়। এগুলির ধরন ছিল একটু ভিন্ন। এই ক্ষেত্রে অক্ষরের প্রতিস্থাপন না করে গোটা একটি শব্দই প্রতিস্থাপিত হ’ত একটি অক্ষর বা চিহ্ন দিয়ে। যেমন –
খুন — D, অবিলম্বে – 08, আজ রাতে – 28, রাজা – Ω, আগামীকাল – 43, বাঁচাও – Z
অতএব, 28 – Ω – D এই কোডের মানে জলের মতো স্পষ্ট।
৪
১৪৬০ সালে ফ্লোরেন্সের পণ্ডিত লিয়ঁ বাতিস্তা আলবার্তি সেই যুগের থেকে এগিয়ে থাকা অদ্ভুত এক কোড আবিষ্কার করেন। এই কোডের মজাই হল, কোনও নির্দিষ্ট অক্ষর যে কোনও অক্ষর দিয়ে প্রতিস্থাপন করা যেত। ফলে যিনি কোড বানাচ্ছেন, তার কাছে সুযোগ থাকত বেশি, আর কোড-কি না জানলে ডিকোড করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াত। ব্যাপারটা কেমন? এক্ষেত্রে মূল অক্ষরমালার সাইফার একের বদলে একাধিক হত। উদাহরণ দেওয়া যাক-
এবার গুপ্ত সংকেত পাঠানোর সময় শুধু একটা সাইফারের উপরে নির্ভর না করে দুটো থেকেই পরপর শব্দ নেওয়া হল। যেমন HELLO লিখতে হলে প্রথমে প্রথম সাইফার আর পরে পরেরটা নিলে এমন দাঁড়াবে- kfoar. মজা হল এর ফলে একই অক্ষর L-এর জন্য আমরা দুটো সাইফার পাচ্ছি, ফলে যার কাছে ডিকোড সাইফার নেই, তাঁর কাজ আরও কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। অনেক পরে ফরাসী কূটনীতিক ব্লেইজ ভিনিয়ার, আলবার্তির এই সূত্র ধরেই তাঁর বিখ্যাত সাইফার স্কোয়ারটি বানিয়েছিলেন। এক কথায় বলে দিই, সেখানে সাইফার অক্ষর দুইয়ের বদলে ২৬। অর্থাৎ একটি অক্ষরকে প্রতিস্থাপন করতে ২৬ রকম অপশন আছে। ছবি দেখলেই বোঝা যাবে ব্যাপারটা কত জটিল।
গুপ্তসংকেত নিয়ে কচকচি এখানেই থাক। বরং শেষে একটা সত্যিকারের গল্প বলি। রাজা অষ্টম হেনরির ডিভোর্স বা অ্যানি বোলিনকে বিবাহ নিয়ে ইতিহাসে পাতার পর পাতা খরচ হয়েছে। উল্ফ হল-এর মতে বুকার পুরস্কারপ্রাপ্ত বইও লেখা হয়েছে। তাই সে আলোচনায় না গিয়ে বরং আমরা সেই জায়গা থেকে আখ্যান শুরু করি, যেখানে সিংহাসন পুনরুদ্ধার করেছেন রানি এলিজাবেথ। সৎ বোন মেরিকে করেছেন কারারুদ্ধ। ১৫৮৬ সালে, প্রায় ১৮ বছর বন্দি থেকে হাঁপিয়ে উঠলেন মেরি। তিনি তখন স্টাফোর্ডশায়ারে চার্টলি হলে বন্দি। ছেলেও মায়ের বন্দিদশা কাটাতে উদ্যোগী নয়। তাকে স্কটিশরা বুঝিয়েছে যে মেরিই তার বাবাকে হত্যা করেছেন। এমতাবস্থায় চার্টলি হলের এক ক্যাথলিক পুরোহিত গিলবার্ট গিফোর্ডের হাত থেকে তিনি এক গোপন চিঠি পেলেন। জানলেন এলিজাবেথের বিরোধী ও অনুগামীরা এলিজাবেথকে হত্যা করে তাঁকে সিংহাসনে বসাতে চায়।
গিফোর্ড অদ্ভুত উপায়ে চিঠি আদানপ্রদান করতেন। প্রথমে চিঠিটিকে চামড়ায় মোড়া হত। তারপর সেটি বিয়ারের পিপেতে পুরে চার্টলি হলে নিয়ে যাওয়া হত। চিঠি লেখাও হত বিচিত্র কোডে, যা জানতেন কেবল মেরি আর তাঁর অনুগামীদের নেতা অ্যান্টনি ব্যাকিংটন। এই কোডের উপর অগাধ ভরসা ছিল দুজনের। অর্থাৎ Steganography ও Cryptography– দুটি পদ্ধতিই মানা হত এক্ষেত্রে। মার্চের মাঝামাঝি বিপ্লবীরা ডেরা বাঁধল চার্টলি হলের নিকটবর্তী সরাইখানা The Plough-এ। তারা ঠিক করল যে গুপ্তহত্যা করা হবে এলিজাবেথকে। কিন্তু তার জন্য তো মেরির আজ্ঞা লাগবে। তাই ৬ জুলাই, ১৫৮৬ সালে ২৩টি প্রতিস্থাপিত অক্ষর আর ৩৫টি কোড (যা এক একটি শব্দের প্রতিস্থাপক) দিয়ে বিখ্যাত ব্যাকিংটন ষড়যন্ত্রের নকশাটি করে মেরিকে পাঠানো হয় তাঁর আজ্ঞার জন্য।

ব্যাকিংটন আর মেরি সব জানতেন, এটা জানতেন না, যে গিফোর্ড ছিলেন আসলে “ডবল এজেন্ট”। চতুর মন্ত্রী ফ্রান্সিস ওয়াশিংহাম তাঁকে নিযুক্তই করেছিলেন গুপ্তচর হিসেবে। ফলে চিঠি এসে পড়ল ওয়াশিংহামের হাতে। কিন্তু যতক্ষণ না সে চিঠি পড়া যাচ্ছে, ততক্ষণ মেরির বিরুদ্ধে কিছু করা সম্ভব না। ওয়াশিংহাম তলব করলেন টমাস ফিলিপস্-কে, সংকেত উদ্ধারে তৎকালীন যুগে যিনি সবার সেরা। দিনরাতের অক্লান্ত খাটুনির ফসল হিসেবে মাত্র সাতদিনেই সংকেত উদ্ধার করলেন ফিলিপস। সংকেত উদ্ধার করে তো তাঁর চক্ষু চড়কগাছ। সঙ্গে সঙ্গে সেটি ওয়াশিংহামের হাতে দিলেন। ওয়াশিংহাম এই সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিলেন। বহুদিন এলিজাবেথকে অনুরোধ করেও মেরির মৃত্যুদণ্ড দেওয়াতে পারেননি তিনি– হাজার হোক সৎ বোন। কিন্তু সেই বোনই তাঁকে মারার ষড়যন্ত্র করছে জানলে নিশ্চয়ই ছেড়ে দেবেন না এলিজাবেথ।
পশ্চিমী চিন্তকদের মতে Cryptography নিয়ে আলোচনা বাইবেলেই আছে। বাইবেলের কিছু অংশ সাংকেতিক atbash-এ লেখা। ব্যাপারটা কেমন? না alphabet-এর প্রতিটি অক্ষরকে তার ঠিক উলটো অক্ষর দিয়ে প্রতিস্থাপন। যেমন, a কে z দিয়ে, b কে y দিয়ে, এমনি। সেই হিসেবে JESUS হবে QVHFH আর BIBLE হবে YRYOV. পরবর্তীকালে রজার বেকন বা চসারের রচনাতেও বারবার এসেছে সংকেত ও তার ব্যাখ্যা। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি আবার লিখতেনই mirror image বানিয়ে। ফলে পাঠককে সামনে আয়না নিয়ে বসতে হত।
১৭ জুলাই চিঠি পৌঁছল মেরির কাছে। সংকেতে উত্তর দিলেন মেরি– তাঁর আজ্ঞা জানিয়ে। একইসঙ্গে লিখলেন তাঁর মৃত্যু পরোয়ানাও। তবে সে চিঠি ব্যাকিংটন-এর কাছে গেল না। তাঁর কাছে যা গেল তাতে লেখা, মেরি ষড়যন্ত্রে যুক্ত সবার নামের লিস্ট চেয়েছেন। সেটি দেখেই অন্তিম আজ্ঞা দেবেন তিনি। সংকেতের প্রতি অগাধ বিশ্বাসে ব্যাকিংটন একবারও ভাবলেন না যে চিঠিটি আদপেই মেরির লেখা নয়, লিখেছেন টমাস ফিলিপস নামের এক গণিতজ্ঞ। পরের ইতিহাস সংক্ষিপ্ত। দলবল-সহ ধরা পড়ল অ্যান্টনি ব্যাকিংটন। বিচারের সবার মৃত্যুদণ্ড হল।
১৫ অক্টোবর মেরিকে এলিজাবেথের সামনে আনা হলে তিনি স্পষ্ট অস্বীকার করেন। বলেন যে তিনি কিছু জানতেন না। ভাবগম্ভীর এক বক্তৃতায় তিনি দরবারের সবাই এমনকী এলিজাবেথকেও “ইমপ্রেস” করে ফেললেন। ঠিক এই সময় ঝুলি থেকে বেড়ালটা বার করলেন ওয়াশিংহাম। টমাস ফিলিপস্ মেরির চিঠিটি খুলে ধাপে ধাপে ব্যাখ্যা করলেন গোটা ষড়যন্ত্রের ছক। শোনা যায় মেরি এতটাই অবাক হয়েছিলেন, আর একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। চমকে উঠলেন এলিজাবেথও। ওয়াশিংহামের স্বপ্ন সফল হল– মেরিকে মৃত্যুদণ্ড দিলেন রানি, ষড়যন্ত্রের অভিযোগে। ১৫৮৭ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জল্লাদ এক কোপে নামিয়ে দেয় মেরির গলা। মেরির বিস্ময় তখনও পুরো কাটেনি। ভেবে দেখুন একটা কোড আর ডিকোড গোটা পৃথিবীর ইতিহাসকে কেমন অবলীলায় বদলে দিল!
জন্ম ১৯৮১-তে কলকাতায়। স্নাতক, স্নাতকোত্তর এবং পিএইচডি-তে স্বর্ণপদক। নতুন প্রজাতির ব্যাকটেরিয়ার আবিষ্কারক। ধান্য গবেষণা কেন্দ্র, চুঁচুড়ায় বৈজ্ঞানিক পদে কর্মরত। জার্মানি থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর লেখা গবেষণাগ্রন্থ Discovering Friendly Bacteria: A Quest (২০১২)। তাঁর লেখা ‘কমিকস ইতিবৃত্ত’ (২০১৫), 'হোমসনামা' (২০১৮),'মগজাস্ত্র' (২০১৮), ' জেমস বন্ড জমজমাট'(২০১৯), ' তোপসের নোটবুক' (২০১৯), 'কুড়িয়ে বাড়িয়ে' (২০১৯) 'নোলা' (২০২০) এবং সূর্যতামসী (২০২০) সুধীজনের প্রশংসাধন্য। সম্পাদনা করেছেন ‘সিদ্ধার্থ ঘোষ প্রবন্ধ সংগ্রহ’ (২০১৭, ২০১৮)'ফুড কাহিনি '(২০১৯) ও 'কলকাতার রাত্রি রহস্য' (২০২০)।