প্রযুক্তি উন্নত নয়। যন্ত্রপাতি সেকেলে। লোকলস্করও লাগে। এরজন্যও বেশি না হলেও কিছু না কিছু অর্থের প্রয়োজন। জমির মালিকের হাতে টাকা নেই। লোকলস্কর জোগাড় করে মাটি খুঁড়ে কয়লা তুলে ট্রাকে ভরে বাজারে পাঠানোর সামর্থ্য নেই। এমন পরিস্থিতিতে ঘটে তাদের আগমন যাদের কাছে যথেষ্ট টাকা আছে আর জানা আছে ভূগর্ভের কয়লাকে বাজারে পৌঁছে দেওয়ার যাবতীয় খুঁটিনাটি। জমির মালিকানা পাল্টায় না। কিন্তু কাজ শুরু হয়ে যায়।

আইনের ফাঁকফোকর খুঁজে নিয়ে জমির মালিকের কাছে ঠিক পৌঁছে যায় বিনিয়োগকারী। দলিল-দস্তাবেজে সইসাবুদ করে নয়, শুধুমাত্র মুখের কথায় কাজ শুরু হয়। জমির মালিকানা পাল্টায় না। সহজ সরল স্থানীয় জনজাতির মানুষ অগাধ বিশ্বাসে বিনিয়োগকারীকে খনির কাজ শুরু করার অনুমতি দিয়ে দেন। খনিতে কত বিনিয়োগ হচ্ছে, কত টাকা মুনাফা হবে এ সমস্ত বিষয়ে তার মাথাব্যথা নেই। তাকে ঠকানো হচ্ছে কি না তা নিয়ে জমির মালিক ভাবতে রাজি নয়। সপ্তাহের শেষে অথবা মাস ফুরোলে মৌখিক চুক্তি অনুযায়ী তার কাছে টাকা পৌঁছে গেলেই সে নিশ্চিন্ত। নগদ টাকায় সে কিনতে শুরু করে টিভি বা সিনেমার পর্দায় দেখা স্বপ্নের জীবন। 

আর যাদের নিজের জমি নেই, এর তার বাড়ির সুপারি পেড়ে, কাঁচা সুপারি ছাড়িয়ে অথবা অন্যের ক্ষেতের হলুদ, আলু মাটির ভিতর থেকে বের করে সাপ্তাহিক হাটে বিক্রিবাট্টা করে দিন গুজরান করত তারা হয়ে গেল দিন মজুর। খনি থেকে তুলে আনা কয়লা ট্রাকে তুলে দেওয়ার কাজই এখন তার একমাত্র পেশা। 

সরকার নির্বিকার। মাসের শেষে সরকারি খাজানায় কয়লার রয়্যালটি নিয়মিত জমা পড়ছে। কে জমা দিচ্ছে বড় কথা নয় কোন জমির মালিকের নামে জমা পড়ে রাজকোষের কতটা শ্রীবৃদ্ধি হচ্ছে সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।

বিপুল পরিমাণ নগদ টাকার নিয়মিত আদানপ্রদান সৃষ্টি করে কালো টাকার সমান্তরাল অর্থনীতি। সেই অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় জড়িয়ে পড়ে জয়ন্তিয়া পাহাড়ের সংস্কৃতি থেকে রাজনীতি। এককথায় বদলে যায় ব্যক্তিগত জীবনযাপন প্রক্রিয়া এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে সমাজজীবন। জয়ন্তিয়া পাহাড়ের আদি বাসিন্দাদের নিজস্ব প্রচলিত বিধিবদ্ধ সামাজিক কাঠামো পাল্টে যায়। মাতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিশ্বাসী এই প্রাচীন জনজাতির মানুষ কৃষিজ পণ্য, বাগিচায় উৎপন্ন সুপারি, হলুদ ও অন্যান্য মশলা আর বিভিন্ন ধরনের ফুল উৎপাদনের উপর যুগ যুগ ধরে জীবনযাপন করতে অভ্যস্ত ছিল। ১৯৮০-র দশক থেকে কয়লার উৎপাদন এবং বাণিজ্যকরণ একই সঙ্গে ভেঙে দিল এতদিনের পরিচিত ও প্রচলিত সঙ্ঘবদ্ধ সমাজ। নগদ অর্থ নিয়ন্ত্রিত এক নতুন ধরনের জনজীবন প্রতিষ্ঠা করল যার মধ্যে উৎপাদন ও বাণিজ্যকরণের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নানানরকমের অবৈধ কার্যকলাপ, দুর্নীতি ইত্যাদি।

সকলের সামনেই চলছিল এই ধারাবাহিক বিবর্তন। অনেকেই এইসব বিষয়ে আলোচনা করতেন। তবে সেই অর্থে সোচ্চার ছিলেন না। বাসিন্দাদের অথবা বলা ভালো জমির স্বত্বাধিকারীদের বেশিরভাগ অংশের স্বার্থ জড়িয়ে থাকায় তেমনভাবে জনমতও গড়ে ওঠেনি। একবিংশ শতাব্দীর সূচনা লগ্নে কয়েকটি অসরকারি সংস্থা ধারাবাহিকভাবে বিষয়টি নিয়ে তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু করে। যথেষ্ট তথ্য হাতে আসার পর শুরু হয় প্রচার। প্রশাসন নড়েচড়ে বসে। আলাপ আলোচনা চলতে থাকে। কাজের কাজ কিছুই হয় না। ততদিনে কয়লার উৎপাদন অনেকটাই বেড়ে গেছে।

অসরকারি সংস্থাগুলির সংগৃহিত ছবি-ভিডিও-নথি সম্বলিত প্রামাণ্য তথ্য প্রমান করে দিল সম্পূর্ণভাবে শিশুশ্রম ভিত্তিক একটা উৎপাদন ব্যবস্থা মানবাধিকার লঙ্ঘন করে, অরণ্য ও পরিবেশ সংক্রান্ত আইন উপেক্ষা করে দিনের পর দিন কাজ করে চলেছে। অবৈধভাবে শিশু-কিশোর আমদানি করে কাজ করে চলেছে জয়ন্তিয়া পাহাড়ের র‌্যাটহোল মাইনিং। স্বাস্থ্য পরিকাঠামো অনুপস্থিত বলে অসুস্থ হলে বা দুর্ঘটনা ঘটলে কোনোরকম চিকিৎসার সুযোগ নেই। এমনকি মারা গেলে মৃতদেহ কোথায় যে হারিয়ে যায় কেউ জানে না। শিক্ষার বালাই নেই। স্বাভাবিকভাবেই অন্যান্য অনৈতিক কার্যকলাপের সঙ্গে গড়ে উঠেছে দেহব্যবসা। সবমিলিয়ে কালো টাকার অবাধ বিচরণ। এই ধরনের অর্থনীতি সব দেশে সর্বকালে নিয়ন্ত্রণ করে কতিপয় ক্ষমতাশালী মানুষ। সারা বিশ্বে মাফিয়া নামেই তারা পরিচিত।

দিনের পর দিন সকলের চোখের সামনে সমস্ত রকমের আইন লঙ্ঘনের কাজে লিপ্ত হয়ে কীভাবে এত বেশিসংখ্যক মানুষ নগদ অর্থ উপার্জনের কাজে জড়িয়ে পড়ে, তা নিয়ে রীতিমতো গবেষণা করা যায়।  তবে অসরকারি সংগঠনগুলি  নিরবিচ্ছিন্নভাবে প্রশাসন থেকে শুরু করে বিচার ব্যবস্থার সামনে তথ্য-যুক্তি এবং আইনী বিশ্লেষণের মাধ্যমে জয়ন্তিয়া পাহাড়ের কয়লা উৎপাদন সংক্রান্ত প্রকৃত পরিস্থিতি তুলে ধরে। ফলে ২০১৪-র ১৭ই এপ্রিল জাতীয় পরিবেশ আদালত (National Green Tribunal)  মেঘালয়ের কয়লা খনন ব্যবস্থাকে অবৈধ বলে ঘোষণা করে। খনন বন্ধের নির্দেশ জারি হয়। জমির ওপর জমে থাকা কয়লা পরিবহন নিষিদ্ধ। জমির মালিক পক্ষ আদালতের দ্বারস্থ হলে সুপ্রিম কোর্ট একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কয়লা পরিবহনের নির্দেশ দেয় যাতে জমে থাকা সমস্ত কয়লা সরিয়ে ফেলা যায়। প্রথমবার সময়সীমা শেষ হয়ে আসার প্রাক্ মুহূর্তে জমি তথা খনির মালিকরা সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেন যে আরও কিছুদিন সময় না দিলে সমস্ত কয়লা সরিয়ে নেওয়া যাবে না। আদালত আবেদন মঞ্জুর করে। তারপর বারবার একই আবেদন চলতে থাকে। এখনও পর্যন্ত শেষ সময়সীমা ধার্য্য হয়েছিল এপ্রিল ২০১৯। প্রশ্ন ওঠে, খনিমুখে কত কয়লা জমে ছিল যা পাঁচ বছরেও সরিয়ে দেওয়া গেল না।                                   

এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেল ২০১৮-র ১৩ই ডিসেম্বর। ইস্ট জয়ন্তিয়া জেলার কসান গ্রামের এক খনিতে তলিয়ে গেল পনেরোজন (মতান্তরে ষোলোজন) শ্রমিক। অভিযোগ, সুড়ঙ্গ কাটতে কাটতে এগিয়ে যাওয়ার সময় শ্রমিকদের গাইতি ফাটিয়ে দেয় পাশের নদীর তলদেশ। হু হু করে নদীর জল সুড়ঙ্গের মধ্যে ঢুকতে শুরু করে। বেআইনি এই খনিতে অন্যান্য খনির মতোই না ছিল কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা বা উদ্ধার করার সাজসরঞ্জাম। ফলে হারিয়ে গেল জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রোজগারের সন্ধানে কাজ করতে থাকে এতগুলি বালক-কিশোর। চূড়ান্ত বিচারে এরা সকলেই বেআইনি কয়লা খনির শ্রমিক।                                        

Amitabha Ray Author

প্রশিক্ষিত প্রযুক্তিবিদ ও পরিচিত পরিকল্পনাবিশারদ। পড়াশোনা ও পেশাগত কারণে দেশে-বিদেশে বিস্তর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। তার ফসল বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় বই। জোয়াই, আহোম রাজের খোঁজে, প্রতিবেশীর প্রাঙ্গণে, কাবুলনামা, বিলিতি বৃত্তান্ত ইত্যাদি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *