আগের পর্ব পড়তে: [১] []

রবীন্দ্র-গানে রাগের প্রতিগ্রহণে খাম্বাজ রাগ রবীন্দ্র ভাবনায় কী রূপ ধারণ করে, তা নিয়ে গত পর্বে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। খাম্বাজের প্রসঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই উঠে এসেছে মাজ-খাম্বাজ, গারা-খাম্বাজ এবং খাম্বাজ-বাহারের কথা। মাজ-খাম্বাজই হোক এই পর্বের কেন্দ্রবিন্দু; ‘আজি যত তারা তব আকাশে’ হোক আলোচনার ভিত্তি।

খাম্বাজ ও মাজ-খাম্বাজের পার্থক্যের মূল জায়গাটি অবশ্যই সুরের গুরুত্বের স্থান পরিবর্তনে; খাম্বাজে যেখানে দেখি গুরুত্ব গান্ধার-পঞ্চমে, মাজ-খাম্বাজে তা হয়ে এসে দাঁড়ায় মধ্যম-ধৈবতে। মাজ-খাম্বাজে খাম্বাজ অক্ষুণ্ণ থাকে ঠিকই, কিন্তু, মধ্যম-ধৈবতের স্বতন্ত্র অস্তিত্বই দুটি রাগের মধ্যে তফাৎ সৃষ্টি করে চোখে পড়ার মতো। 

মাজ-খাম্বাজ মাইহার ঘরানায় সর্বাপেক্ষা বেশি চর্চিত। রাগটি মাইহার ঘরানার প্রাণপুরুষ আলাউদ্দিন খাঁর সৃষ্টি কি না, তাই নিয়ে মতভেদ রয়েছে, কিন্তু একথা সত্যি, আলাউদ্দিনের পুত্র আলি আকবর খাঁ, শিষ্য রবিশঙ্কর ও নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়, এবং কন্যা অন্নপূর্ণা দেবীই মাজ-খাম্বাজের পরিচিতি-বৃদ্ধির কারণ। মাজ-খাম্বাজ অতি প্রাচীন রাগ; আলাউদ্দিন খাঁ রামপুরে শিক্ষাগ্রহণকালীন এই রাগ শিখেছিলেন তাঁর গুরু ওয়াজির খাঁর কাছে এমনও মত অনেকের।

Ustad Alauddin Khan
মাইহার ঘরানার প্রাণপুরুষ আলাউদ্দিন খাঁ

আমার মাজ-খাম্বাজ শোনার প্রথম অভিজ্ঞতা আলি আকবর খাঁ এবং নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বৈত-বাদনের মাধ্যমে; তখন আমি শিশু। বাল্যকালে বহুবার রেকর্ডে শুনেছি রবিশঙ্কর-আলি আকবর জুটির মাজ-খাম্বাজ। শুনেছি রবিশঙ্কর বা নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের একক বাদনেও। আজ চারিদিকে মাজ-খাম্বাজের যে রূপ শোনা যায়, তা সর্বতই অনুসরণ করে উপরোক্ত শিল্পীদের দেখানো পথ।

অন্নপূর্ণা দেবীর মাজ-খাম্বাজ শুনি কৈশোরে, ইউটিউবে; এর মাধ্যমে মাজ-খাম্বাজের যে ভিন্নতর রূপের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে, তা কতখানি আমার মনে প্রভাব ফেলেছিল, ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। কোনওরকম অতিপ্রাকৃতিক কোনও কিছুতে বিশ্বাস না করা আমার আজও সেই রেকর্ডিং শুনলে কেমন যেন সব কিছু এলোমেলো হয়ে যায়; মনে ভিড় করে আসে হাজারো না-বলা অনুভূতি।

ব্যক্তিগত স্তর পেরিয়ে যদি শুধুই বাজনার দিকে নজর দিই, দেখা যাবে আলি আকবর খাঁ, রবিশঙ্কর, বা এমনকি নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়ও যেভাবে মাজ-খাম্বাজ বাজিয়েছেন, তার সঙ্গে অনেকটাই তফাৎ অন্নপূর্ণা দেবীর যেভাবে বাজিয়েছেন, তাতে। যদি একটু তুলনা করা যায়, সবসময় হয়ত স্বরবন্ধগুলি একই পাব না, বা পেলেও শিল্পীর চিন্তা-প্রসূত স্বরের গুরুত্বই দুই ধরনকে আলাদা করে।

ধরা যাক রবিশঙ্কর-আলি আকবরের বাদনেই, স্বরবন্ধগুলি

  • ধা্‌ নি্‌ সা গা মা পা ধা মা রে সা নি্‌ ধা্‌ সা নি্‌ 

  • সা গা মা ধা গা পা মা/রে মা গা/সা গা রে/নি্‌ পা্‌ ধা্‌ নি্ ধা্‌‌,
  • গা পা ধা নি ধা পামা গারে গা ধাপা মা

  • সা গা মা গারে গারে গা ধাপা মা 

  • গা মা পা নি র্সা র্রে র্সানি র্রেসা নি ধা

মধ্যমের চেয়ে ধৈবত হয়ত একটু বেশি গুরুত্ব পায় এতে। পূর্বাঙ্গে ষড়জের ব্যবহার অপেক্ষাকৃত কম, বা নেই বললেই চলে; পূর্বাঙ্গে প্রত্যাবর্তনের পর খরজের ধৈবতেই ন্যাস নিতে শোনা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে। মধ্য-সপ্তকে ন্যাস স্বর অনেক সময়ই মধ্যম।

Ravi shankar-Ali akbar
রবিশঙ্কর-আলি আকবর জুটি

অন্নপূর্ণা দেবী ন্যাস স্বর হিসেবে ব্যবহার করলেন মূলত মধ্যম এবং পূর্বাঙ্গে ষড়জকে। কোনও কোনও স্বরবন্ধ ধৈবতে শেষ হলেও, তা ধৈবতেই স্থির থাকে না, মধ্যমে অবতরণ করে। ষড়জে প্রত্যাবর্তনের পর ষড়জ ব্যবহৃত হচ্ছে অনেক সময়ই শুদ্ধ নিখাদের অনুষঙ্গে; আলি আকবর খাঁ ও রবিশঙ্করের বাদনে ষড়জের স্বতন্ত্র ব্যবহারে কখনও কখনও শুদ্ধ নিখাদের প্রয়োগ পাই, ষড়জে প্রত্যাবর্তন তেমন নেই, ষড়জ পেরিয়ে নীচে ধৈবতে ফেরেন তাঁরা, বলেছি। ষড়জ পেরিয়ে ধৈবতে যান অন্নপূর্ণা দেবীও, কিন্তু প্রত্যেকবারই কোমল নিখাদ প্রয়োগের মাধ্যমে। কোমল নিখাদের এই বিশেষ সচেতন ব্যবহার আলি আকবর খাঁ বা রবিশঙ্কর করেননি। তাঁদের ভাবনা ছিল ভিন্ন। আলি আকবর খাঁ বা রবিশঙ্করের মতই অন্নপূর্ণা দেবীরও খাম্বাজই প্রধান অবলম্বন থাকলেও তাঁর ভাবনায় স্বরবন্ধগুলি এমনভাবে সাজানো, মাজ-খাম্বাজ সহজেই খাম্বাজের থেকে আলাদা হিসেবে যেমন চিহ্নিত হয়, তেমনই এই স্পষ্টতা কখনই সংগীত রসাস্বাদনের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় না।

অন্নপূর্ণা দেবীর বাদনে স্বরবন্ধগুলি

  • নি্ধা্ ধা্‌ নি্‌ সা নি্‌ সা
  • গা পা ধা নি ধাপা মাগা পা মা
  • মা মাগা পা/পা পাধা পাধা পামা
  • গামাপা গামা রে সানি্‌সা
  • গা পা ধা নি র্সা নি ধাপা গা পা মা

উল্লেখযোগ্য, অন্নপূর্ণা দেবী যখন উত্তরাঙ্গে ষড়জকে শুধু ছুঁয়ে আসছেন, তখনই তিনি গা পা ধা নি র্সা স্বরবন্ধ ব্যবহার করছেন; নি ধাপা মা’র মাধ্যমে ফিরে আসছেন মধ্যমে। উত্তরাঙ্গে ষড়জে গিয়ে দাঁড়ানোর সময় তিনি ব্যবহার করছেন মা নি ধা নি নি র্সা; রবিশঙ্কর ও আলি আকবর খাঁও হয়ত তাই-ই করছেন, কিন্তু, এক্ষেত্রে শুদ্ধ নিখাদের গুরুত্ব কম। আলী আকবর খাঁ ও রবিশঙ্করের বাদনে এবং অন্নপূর্ণা দেবীর বাদনে, দু-ক্ষেত্রেই শুদ্ধ নিখাদ ও কোমল নিখাদ স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও, অন্নপূর্ণা দেবীর বাদনে দুই নিখাদের এক পারস্পরিক সংযোগ লক্ষ্য করা যায়। এরই সঙ্গে পঞ্চমের পরিমিত ব্যবহারও আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। রবীন্দ্র ভাবনায় খাম্বাজে ঠিক যেমন ভাবে গান্ধার ও পঞ্চমের প্রাধান্য নির্ধারিত হয় মধ্যম ও ধৈবতের দ্বারা, তেমনই অন্নপূর্ণা দেবীর বাদনে মাজ-খাম্বাজে মধ্যম ও ধৈবতের মধ্যে এক সেতু স্থাপন করে পঞ্চম। আলী আকবর খাঁ, বা বিশেষত রবিশঙ্করের বাদনে পঞ্চমের প্রয়োগ পরিমিত হলেও সেক্ষেত্রে পঞ্চম যেন শুধুই এক স্বতন্ত্র স্বর হয়ে দাঁড়ায়; তার অবস্থানের ওপর মধ্যম বা ধৈবতের তাৎপর্য নির্ভর করে যেন শুধু রাগের কাঠামো রক্ষার তাগিদে, মধ্যম ও ধৈবতের মধ্যে সেতু স্থাপন এক্ষেত্রে নেই, আবার তাঁদের ভাবনার ভিন্নতার কারণেই। আরোহণে অন্নপূর্ণা দেবী রেখাবের ব্যবহার প্রায় করেনই না। রবিশঙ্কর ও আলী আকবর খাঁ অনেক সময়ই ধা্‌ নি্‌ সা গারে গা মা ব্যবহার করেন, তা-ও অন্নপূর্ণা দেবীর বাদনে শুনি বলে মনে পড়ে না। অন্নপূর্ণা দেবীর বাদনে যে ব্যাপারটি বারংবার নজরে আসে, তা হল বীণকার অঙ্গে যেকোনো সপ্তকের ষড়জ থেকে ঠিক তার নীচের সপ্তকে গান্ধার বা মধ্যমে মীড় টানা; এই একেকটি মীড় রাগ হিসেবে মাজ-খাম্বাজের উত্তরণ ঘটায় শতগুণ। এই মীড় সুরবাহারের মতো যন্ত্রের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক; খরজের বিস্তারে সেতারে রবিশঙ্করও এই মীড় টানতেন।

Annapurna Devi
অন্নপূর্ণা দেবী

উপরোক্ত আলোচনা থেকে দয়া করে কেউ ধরে নেবেন না, আমি আলি আকবর খাঁ, রবিশঙ্কর এবং অন্নপূর্ণা দেবীর মাজ-খাম্বাজ-চিন্তার তুলনামূলক আলোচনা করছি, কে কার থেকে ভাল বাজাতেন তাই নিয়ে শোরগোল তুলতে। আমার উদ্দেশ্য সংগীত নিয়ে কথা বলা— তোষামোদি বা ব্যক্তিগত আক্রমণ নয়। প্রত্যেকেই নমস্য, প্রণম্য। প্রত্যেকেই তাঁর নিজস্বতার বিচারে অসামান্য।

রবীন্দ্রনাথের ‘আজি যত তারা তব আকাশে’ গানটিতে মাজ-খামাজের যে রূপ পাওয়া যায়, তার সঙ্গে অনেকই সাযুজ্য অন্নপূর্ণা দেবীর চিন্তাধারার। কিছু স্বরবন্ধের মাধ্যমে গানটিকে দেখা যাক। স্বরবিতানের স্বরলিপি অনুসরণ করছি না। গানের কথা আশা করি সকলের মনে আছে; না থাকলে গীতবিতানে দেখুন; গানের কথা মাথায় রাখা প্রয়োজন।

স্বরবন্ধগুলি মোটামুটি এরকম—

  • গা মা পা র্সা নি/ধাপা ধাপা মাগা পামা গা
  • গা মা পা পা/পা ধা মাগা মা পা ধা নি ধা
  • মা নি ধা নি নি র্সা
  • ধা র্সা নি ধা পা ধা গা মা
  • মাগা মা পা/মা পা ধা/পা ধা নি
  • ধাপা ধাপা মা গা মা গা/সা গা মা
গানের আস্থায়ীতে আমরা দেখব, ন্যাস স্বর মূলত মধ্যম। ‘প্রাণ ভরি’তে পঞ্চমের ব্যবহার রয়েছে। পঞ্চম গুরুত্বপূর্ণ অবশ্যই, কিন্তু স্বরবন্ধ পঞ্চমে শেষ হয় না, ধৈবতে পৌঁছয় ‘প্রকাশে’র মাধ্যমে, এবং যেহেতু তারপরেই গানের প্রথম পঙক্তি গাওয়ার কথা, স্বরবন্ধ ফিরে আসে মধ্যম-প্রধান স্বরসমষ্টির দিকে। অন্তরাতে, অর্থাৎ ‘নিখিল তোমার’-এ, শুদ্ধ নিখাদের মাধ্যমে স্বরবন্ধ ষড়জে পৌঁছয়। উত্তরাঙ্গে বিস্তারের পর ‘বিকাশে’ গেয়ে যখন আবার গানের প্রথম পঙক্তি ধরার জায়গায় আসি, তখন আমরা দেখি ‘শে’তে তার সপ্তকের ষড়জ থেকে মধ্য সপ্তকের গান্ধার পর্যন্ত একটি মীড়; গান্ধার থেকে শুরু হয় ‘আজি যত তারা’। পঞ্চমের যে ব্যবহার পেলাম, তা থেকে স্পষ্ট, পঞ্চম মধ্যম-ধৈবতের মধ্যে একটি যোগ সৃষ্টি করে। অন্নপূর্ণা দেবীর বাদনে এই যোগই অনুরণিত হয়। তার সপ্তকের ষড়জ থেকে মধ্য সপ্তকের গান্ধার পর্যন্ত এই মীড়ই কি অন্নপূর্ণা দেবীর চিন্তনে ছাপ ফেলে না?
 
Rabindra sangeet

রবীন্দ্র-গানে সঞ্চারী নিয়ে বহু জায়গায় বহু আলোচনা হয়েছে। এই গানটিতে সঞ্চারী আলাদা আলোচনার দাবি রাখে, কারণ অন্যান্য বেশিরভাগ গানগুলিতে– সব গানে নয়, অবশ্যই– যেখানে দেখি, সঞ্চারির সুরের পথ পূর্বাঙ্গে সীমিত, এই গানে তা দেখি না। এই গানের সঞ্চারীর সুরে এক উত্থান লক্ষণীয়; মা গামাপা মাপাধা পাধানি স্বরবন্ধ আমরা পাব অন্নপূর্ণা দেবীর বাদনে তানের অংশে। দেয়াসিনীর সঙ্গে এক আলোচনায় এই গানটির এই বিশেষ অংশের কথার বক্তব্যের সঙ্গে সুরের চলনের সম্পর্ক কেমন তা উঠে এসেছিল। 

‘আজি যত তারা তব আকাশে’ গানটি সরোদ-শিল্পী বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত মাজ-খাম্বাজের গতের ছকে ফেলে বাজিয়েছিলেন। তাঁর বাজনায় আলি আকবর খাঁ, রবিশঙ্কর, অন্নপূর্ণা দেবী, এঁদের সবার ছায়া থাকা সত্ত্বেও প্রকটতর হয়ে উঠেছিল রবীন্দ্রনাথের চিন্তনে যেভাবে মাজ-খাম্বাজ ধরা দিয়েছিল, তার ছায়া। বস্তুত, বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের বাজনা থেকেই রবীন্দ্র-ভাবনায় মাজ-খাম্বাজ কেমন ছিল, তা নিয়ে স্পষ্ট ধারণা তৈরি করা যায়।

Rabindranath Tagore

দেয়াসিনী যখন প্রস্তাব রেখেছিলেন, ‘সখী, আঁধারে একেলা ঘরে’ গাইবেন, বলেছিলাম, আমাকে তা নাকচ করতে হয়েছিল, যেহেতু তা খাম্বাজ নয়, গারা-খাম্বাজ। আমার অগ্রজ, হারমোনিয়াম শিল্পী শুভেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে একদিন তাঁর সঙ্গে সঙ্গতে বসেছি। তাঁকে খাম্বাজ বাজাতে অনুরোধ করতে তিনি আমাকে বললেন, “খাম্বাজ তো অনেক শোনো। তোমাকে আমি বরং গারা-খাম্বাজ শোনাই। এটা আমার ঠাকুরদার বানানো।” শুভেন্দুদার ঠাকুরদা হারমোনিয়ামের জগতে প্রায় একরকম বিপ্লব ঘটানো শিল্পী দেবকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। শুভেন্দুদার বাদনে, লক্ষ করলাম, গারা-খাম্বাজের গারার আধার রবিশঙ্কর প্রচলিত পঞ্চম-সে গারা; মধ্যম-সে গারা নয়, শুদ্ধ গারাও নয়। শুদ্ধ গারার প্রধান স্বরবন্ধ ধা্‌ নি সা নি্‌ সা; এতে সুরের নোঙর ষড়জ। মধ্যম-সে গারাতে সুরের এই নোঙরই মধ্যমে; শুদ্ধ গারার প্রধান স্বরবন্ধে প্রাপ্ত স্বরগুলি যদি ওই একই নকশায় মধ্যমকে ন্যাস স্বর জ্ঞান করে সাজানো হয়, তাহলে তা হয়ে দাঁড়ায় রে গা মা গা মা;। রবিশঙ্কর পঞ্চম-সে গারাতে সুরের নোঙরকে মধ্যম থেকে ঠেলে পঞ্চমে পাঠিয়ে পঞ্চমকে ন্যাস স্বর জ্ঞান করে আবারও যখন শুদ্ধ গারার প্রধান স্বরবন্ধে প্রাপ্ত স্বরগুলি ওই একই নকশায় সাজান, তা হয়ে দাঁড়াল গা মা পা হ্মা পা। বলা বাহুল্য, পঞ্চম-সে গারা রাগসঙ্গীতের ক্ষেত্রে এক অসামান্য আবিষ্কার। খাম্বাজের সঙ্গে গারাকে জুড়তে গেলে অবশ্যই পঞ্চম-প্রধান পঞ্চম-সে গারাই জুড়তে হবে, যেহেতু মধ্যম-প্রধান মধ্যম-সে গারা বা কোমল-গান্ধার যুক্ত জয়জয়ন্তী-অঙ্গের শুদ্ধ গারা গান্ধার-পঞ্চম কেন্দ্রিক খাম্বাজের সঙ্গে খাপ খায় না। ‘সখী, আঁধারে একেলা ঘরে’তে ‘ঘরে’র ‘রে’ পঞ্চমে, কিন্তু ঠিক তার আগের স্বর তীব্র মধ্যম। ‘মন মানে না’র ‘না’-এর শেষ দুই স্বরও তীব্র মধ্যম এবং পঞ্চম, যা পা হ্মা পা’র মাধ্যমে স্পষ্টত খাম্বাজের ভিতর পঞ্চম-সে গারার ছায়া নিয়ে আসে। আশ্চর্য, এ গান অবশ্যই রবিশঙ্কর পঞ্চম-সে গারার প্রচলন করার আগে। দেবকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মনে গারা-খাম্বাজের উদ্ভাবনের বীজ বপনে এই গানের কোনও প্রভাব ছিল কি না, তা বলতে পারি না।

খাম্বাজ-বাহার রবীন্দ্রনাথের অনেক খাম্বাজে আধারিত গানে স্পষ্ট। এই নিয়ে আলোচনার জন্য প্রয়োজন বাহার রাগের চলন নিয়ে রবীন্দ্রনাথের পরীক্ষা-নিরীক্ষা, শীঘ্রই তাই নিয়ে আলোচনা করব।

যে সময় রবীন্দ্রনাথ ‘আজি যত তারা তব আকাশে’ রচনা করেন, অর্থাৎ ১৯০৪-এ, তখন আলাউদ্দিনের পুত্র-কন্যা-শিষ্য কেউই জন্মগ্রহণ করেননি। কীভাবে তবে রবীন্দ্রনাথ এ রাগের নাগাল পেয়ে থাকবেন, সেই বিষয়ে খোঁজ করা যাবে আগামী পর্বে। যন্ত্রসংগীতের ঘরানাগুলির মধ্যে একমাত্র মাইহার ঘরানার সঙ্গেই রবীন্দ্রনাথের সরাসরি যোগাযোগ ছিল। আলাউদ্দিনের সঙ্গে তো বটেই, এমনকি তাঁর পুত্র-কন্যা এবং শিষ্যগণেরও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ আদান-প্রদানের ইতিহাস পাওয়া যায়। সে সবই প্রসঙ্গক্রমে আলোচিত হবে।

 

 

ছবি সৌজন্য: Wikipedia, Youtube,
* পরের পর্ব প্রকাশ পাবে ১৫ মে 

Subhadra Kalyan Author

সুভদ্রকল্যাণ বর্তমানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক ভারতীয় ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের স্নাতকোত্তর স্তরের ছাত্র। বাংলা ও ইংরাজি উভয় ভাষাতেই তাঁর লেখা সংগীত ও সাহিত্য বিষয়ক বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ প্রকাশ পেয়েছে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। বহু বিশিষ্টজনের সাক্ষাৎকার সংগ্রহ করেছেন, সেগুলিও প্রকাশিত ও সমাদৃত। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তাঁর লেখা কবিতা প্রকাশ পেয়েছে। মূলত ইংরাজি ভাষায় কবিতা লেখেন সুভদ্রকল্যাণ। তাঁর আরেকটি পরিচয় রাগসঙ্গীতশিল্পী হিসেবে। সংগীতশিক্ষা করেছেন আচার্য শঙ্কর ঘোষ, পণ্ডিত বিক্রম ঘোষ, পণ্ডিত উদয় ভাওয়ালকর, ডঃ রাজিব চক্রবর্তী প্রমুখ গুরুর কাছে। পেয়েছেন একাধিক পুরস্কার ও সম্মাননা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *