আগমনী, বিভাবরী, চন্দনা, আরাধনা – সাহিত্যপ্রিয় বাঙালির কাছে এগুলি নেহাতই কিছু সুললিত শব্দগুচ্ছ নয়। প্রতিটি শব্দর সঙ্গেই জড়িয়ে আছে তুমুল নস্টালজিয়া। পঞ্চাশ থেকে আশির দশক অবধি যাঁদের কৈশোর কেটেছে তাঁরা তো বটেই, পরবর্তী প্রজন্মগুলির বহু বাঙালি-ও জানেন এগুলি দেব সাহিত্য কুটীরের বার্ষিকী বইগুলির নাম। বেরোত প্রতি বছর পুজোর সময়। বাংলার তাবড় সাহিত্যিকদের কলমের জাদুতে, বাংলার শ্রেষ্ঠ ইলাসট্রেটরদের তুলির ছোঁয়ায় পুজোর দিনগুলি নিঃসন্দেহে আরোই ঝলমলিয়ে উঠত। প্রথম দিকের কয়েকটি বার্ষিকীতে পুরনো লেখা সঙ্কলিত করা হত। দেব সাহিত্য কুটীরের প্রথম বার্ষিকী ‘ছোটদের চয়নিকা’-র (১৯৩১) সূচীপত্রে (‘ধুলোখেলা’ ব্লগের সৌজন্যে প্রাপ্ত)যেমন দেখতে পাচ্ছি খণ্ডটিতে স্থান পেয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছোট নদী’, যতীন্দ্রমোহন বাগচীর ‘কাজলা দিদি’ বা গোলাম মোস্তাফার ‘তরুণের পণ’ এর মতন বিখ্যাত কবিতাগুলি। শিব্রাম চক্রবর্তী, হেমেন্দ্রকুমার রায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের মতন প্রথিতযশা লেখকরা অসংখ্য বার্ষিকীতে নিজেদের নতুন লেখা দিয়েছেন, বইগুলির জন্য প্রায় প্রতি বছর ছবি এঁকেছেন পূর্ণচন্দ্র চক্রবর্তী, প্রতুলচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বা নারায়ণ দেবনাথের মতন শিল্পীরা।দেব সাহিত্য কুটীরের বার্ষিকীর মতনই জনপ্রিয় ছিল বার্ষিক শিশুসাথী-ও। আবার নব্বইয়ের দশকে এসে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় বেরিয়েছে ‘ছুটির সানাই’, ‘ছুটির ঘন্টা’ ইত্যাদি নামের ‘ছুটি’ সিরিজের বার্ষিকী।আর এই একবিংশ শতকেও মাসিক পত্রিকাগুলির শারদীয় সংখ্যার পাশাপাশিই বেরিয়ে চলেছে ‘মায়াকানন’, ‘আমপাতা জামপাতা’, ‘পার্বণী’ এবং আরো কত জানা-অজানা বার্ষিকী।
বার্ষিকী আর শারদীয়া সংখ্যার মধ্যে পার্থক্যটি কী তাহলে? শারদীয়া সংখ্যা বেরোয় প্রচলিত সাপ্তাহিক, পাক্ষিক বা মাসিক পত্রিকার। বিশেষ সংখ্যা, কলেবরেও বিশেষত্ব। জনপ্রিয় বর্তমান লেখকদের নতুন লেখা সেখানে বেরোচ্ছে। বার্ষিকী আবার দু’ধরনের হতে পারে। প্রথমত, অতীত ও বর্তমান দিনের লেখকদের পুরনো লেখার সঙ্কলন। ওপরে ‘ছোটদের চয়নিকা’-র কথা বলছিলাম। আর একটি উদাহরণ দিই, তুলনামূলক ভাবে সাম্প্রতিক। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ১৯৯৩ সালে যখন প্রথম ‘ছুটির সানাই’ বার করলেন সেখানেও স্থান পেল রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, সুখলতা রাওদের লেখা। আবার দ্বিতীয় ধরণের বার্ষিকীও দেখতে পাওয়া যেত – কোনো একটি মাসিক পত্রিকার সবকটি সংখ্যাকে একত্রিত করে বছর শেষে বার করা হত একটি বিশালবপু বই। যেমন বার্ষিক শিশুসাথী।
এই দু’ধরণের বার্ষিকীর আইডিয়াই কিন্তু এসেছে সাগরপার থেকে। আদতে বিলিতী আইডিয়া। বাংলায় বার্ষিকীর প্রচলন হওয়ার বহু আগে থেকেই একাধিক বার্ষিকী বেরোত ব্রিটেন থেকে। তবে এদের সবার মধ্যে আলাদা করে বলতে হয় ‘The Boy’s Own Paper’ এর কথা। ১৮৭৯ সালে শুরু হয়ে অষ্টআশি বছর ধরে চলেছিল কিশোরদের এই পত্রিকা। আমাদের শিশুসাথীর মতনই প্রতি বছরের শেষে সব কটি মাসিক সংখ্যা একত্রিত করে বেরোত ঢাউস এক ভলিউম, ক্রিসমাসের আগেই। বহু সময়েই শুধুমাত্র এই ভলিউমগুলোর জন্যই আলাদা করে ছবি আঁকা হত। পাতাজোড়া রঙিন ছবি দেওয়ার প্রচলন-ও শুরু হয় এই ক্রিসমাস ভলিউমের জন্যই। এহেন পাতাজোড়া রঙিন ছবিগুলি বড় আকর্ষণ ছিল বাংলার বার্ষিকী-র পাঠকপাঠিকাদের জন্যও।
সামান্য খেয়াল করলেই একটা প্রশ্ন জেগে উঠবে, পত্রিকার নাম নিয়ে। ‘Boy’s own’ কেন নাম?তাহলে কী এ পত্রিকা শুধুমাত্রই কিশোরদের জন্য? আদপেই তাই।‘Boy’s own’ শুরু হওয়ার এক বছরের মধ্যেই প্রকাশ পায় ‘The Girl’s Own Paper’। ভিক্টোরিয়ান রক্ষণশীলতার বেশ কিছু প্রতিচ্ছবি দেখতে পাওয়া যায় মেয়েদের জন্য বানানো এই পুরনো বার্ষিকীগুলিতে। সামাজিক বা ধার্মিক অনুশাসনে তখনো প্রবল লিঙ্গভেদ।
১৮৮০-র ‘The Girl’s Own Paper’-এ তাই দেখতে পাচ্ছি পুরনো দিনের ফ্যাশন নিয়ে লেখা। অথচ ওই একই বছরের ‘Boy’s own’-এ কিন্তু ফ্যাশন নয়, যুদ্ধ বা অ্যাডভেঞ্চারের গল্পই প্রাধান্য পাচ্ছে। তবে কৌতুকধর্মী গল্পের যোগান থাকত ছেলে মেয়ে দু’দলের জন্যই।

‘Boy’s own’ বা ‘Girl’s Own’ এর সাফল্য দেখে এরকম ক্রিসমাস ভলিউম বার করতে শুরু করেন আরো অনেক ব্রিটিশ প্রকাশক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় কাগজ দুর্মূল্য হয়ে পড়ায় বদল ঘটে বিজনেস স্ট্র্যাটেজি-র। বহু প্রকাশক সারা বছরের লেখা একত্রিত না করে শুধু ক্রিসমাস স্পেশ্যাল বার করতে শুরু করলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে আক্ষরিক অর্থের ‘বার্ষিকী’গুলো আর চোখেই পড়তে শুরু করল না, রয়ে গেল মূলত ক্রিসমাস স্পেশ্যাল।

কুড়ি-তিরিশের দশকে এসেও কিন্তু ছেলে আর মেয়েদের বার্ষিকী আলাদা করেই বের হত। যেমন ‘The Brown book for boys’ বা ‘The Big budget for girls’। এই চল্লিশ-পঞ্চাশ বছরে অবশ্যই বদল এসেছে। সার্বিক অঙ্গসজ্জাতেও, লেখার বিষয়বস্তুতেও। এই সময় দেখতে পাচ্ছি প্রচ্ছদ প্রায় সব বইতেই রঙিন, ভেতরে পাতাজোড়া রঙিন ছবিও প্রায় আবশ্যিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আরো গুরুত্বপূর্ণ কথাটি হল মেয়েদেরকে শুধু ফ্যাশন আর নৈতিকতার ঘেরাটোপেই রেখে দেওয়া হচ্ছে না। মেয়েদের বার্ষিকীতেও প্রবল ভাবে এসে গেছে অ্যাডভেঞ্চারের ছোঁয়া।
মেয়েদের ক্রিসমাস ভলিউমে দেখতে পাচ্ছি গোয়েন্দা গল্প, বা এনিড ব্লাইটনের ‘ম্যালরি টাওয়ার্স’ ধাঁচের গল্প যা গড়ে উঠেছে স্কুলজীবনের অম্লমধুর স্মৃতি নিয়ে।
ছেলেদের ভলিউমগুলিতে সে অর্থে বদল এসেছে কমই। ঐতিহাসিক গল্পের যোগান ও চাহিদা চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগের তুলনায় কিছুমাত্র কমেনি। অ্যাডভেঞ্চার গল্পগুলিতে তখনো রয়ে গেছে পৌরুষের প্রাবল্য। তবে আঠারোশো আশি-নব্বইয়ের গল্পগুলি যেখানে আবর্তিত হত মূলত ইংল্যান্ড বা স্কটল্যান্ডকে কেন্দ্র করে, উনিশশো কুড়ি বা তিরিশে কিন্তু পটভূমিকা সরে গেছে ব্রিটিশ কলোনিগুলিতে। ভারত বা আফ্রিকার বিভিন্ন দেশকে কেন্দ্র করে লেখা হচ্ছে পরের পর ঐতিহাসিক এবং রোমাঞ্চকর গল্প। অধিকাংশ গল্পই অবশ্য ব্রিটিশ সেনা এবং সেনানায়কদের কৃতিত্ব নিয়ে। গোটা আফ্রিকা মহাদেশ তো বটেই, ভারতবর্ষও তখনো ব্রিটিশদের কাছে ‘অন্ধকারাচ্ছন্ন মহাদেশ’। ‘নেটিভ ইন্ডিয়ান’ দের গতানুগতিক চরিত্রগুলি এযুগের উৎসাহী পাঠককে যে ক্লান্ত করবে সে নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকে না।

বাংলা বার্ষিকীর বাজারে সে অর্থে মন্দা এখনো আসেনি, কিন্তু বিলিতি বার্ষিকীর চল উঠে গেছে বহু আগেই। ইন্টারনেট আসারও বহু আগে। জনপ্রিয় যে বার্ষিকীগুলি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরেও টিঁকে ছিল ষাটের শেষ-সত্তরের শুরুতে সেগুলোও বন্ধ হয়ে যেতে শুরু করে। ক্রিসমাস স্পেশ্যালের জায়গা ততদিনে নিয়ে নিতে শুরু করেছে আটলান্টিকের দু’পারের একাধিক কমিকস সিরিজ। সে ইতিহাস শোনানো যাবে অন্য কোনো দিন।
প্রবীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ব্রিটেনের কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ে ম্যানেজমেন্ট সায়েন্সের অধ্যাপক। অর্থনীতি ও রাজনীতি নিয়ে বিশেষ আগ্রহ। বাংলা ও ভারতের বিভিন্ন সংবাপত্রে অর্থনীতি, রাজনীতি ও বিজ্ঞান বিষয়ক একাধিক প্রবন্ধ লিখেছেন প্রবীরেন্দ্র। এছাড়াও লিখেছেন একাধিক কল্পবিজ্ঞান ও রহস্যকাহিনী। তাঁর প্রকাশিত বইগুলি হল 'বাইট বিলাস', 'ক্যুইজ্ঝটিকা', 'পরিচয়ের আড্ডায়', 'আবার ফেলুদা, আবার ব্যোমকেশ', এবং 'চার'।