ডিসেম্বর মাস হল মহামানব যিশু খ্রিস্টের জন্মমাস। ২৫ ডিসেম্বর আমাদের কাছে ‘বড়দিন’। আমরা জানি, এই অমৃতময় পুরুষ গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়েছিলেন যে মানবপ্রেমের মন্ত্র, তার দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, যিনি নিজেও তাঁর সৃষ্টি ও বক্তব‍্যের মধ্যে দিয়ে একই মানবপ্রেমের বার্তা দিয়েছেন জীবনভর। ঘুরে বেড়িয়েছেন সারা পৃথিবী। তাঁরই উদ‍্যোগে প্রতি বছর বড়দিনে শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রমে পালন করা হত খ্রিস্ট জন্মোৎসব, আজও যা অব‍্যাহত। আমরা জানি, রবীন্দ্রনাথ তাঁর আশ্রমে একদিকে যেমন নানা ক্ষেত্রের বহু ভারতীয় প্রতিভাবানের সমাবেশ ঘটিয়েছিলেন, তেমনই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নিয়ে এসেছিলেন অনেক গুণীজনকে। তাঁরা আশ্রমগুরুর মহান আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে থেকে গিয়েছিলেন আশ্রমে। আত্মনিয়োগ করেছিলেন নানা সৃষ্টিশীল কাজে। যাঁদের মধ্যে ছিলেন চার্লস ফ্রিয়ার অ্যান্ড্রুজ, উইলিয়াম পিয়ারসন, লেনার্ড এলমহার্স্ট-এর মতো আরও কিছু বিদেশি বিশিষ্টজন। এঁদের সক্রিয় অংশগ্রহণে খ্রিস্ট জন্মোৎসব একটা অন‍্য মাত্রা পেত। অধিকাংশ সময় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করতেন অ্যান্ড্রুজ সাহেব।

এই উৎসবকে কেন্দ্র করে লেখা কবিতা, গান, প্রবন্ধ ইত‍্যাদির মধ‍্যে দিয়ে যিশুর প্রতি রবীন্দ্রনাথের গভীর আত্মানুভূতির প্রকাশ ঘটেছিল। ১৯২৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর লেখা ‘খ্রিস্টোৎসব’ নামে একটি রচনা তিনি শেষ করেছিলেন এইভাবে―”… রাত্রিতে সূর্য অস্তমিত হলে মূঢ় যে সে ভাবে যে, আলো বুঝি নির্বাপিত হল, সৃষ্টি লোপ পেল। এমন সময় সে অন্তরীক্ষে চেয়ে দেখে, সূর্য অপসারিত হলে লোকলোকান্তরের জ‍্যোতির্ধাম উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। মহারাজার এক দরবার থেকে আর এক দরবারে আলোর সংগীত ধ্বনিত হচ্ছে। সেই সংগীতে আমাদেরও নিমন্ত্রণ বেজে উঠেছে। মহা আলোকের মিলনে যেন আমরা পূর্ণ করে দেখি। জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানকার এই অখণ্ড যোগসূত্র যেন আমরা না হারাই। যে মহাপুরুষ তাঁর জীবনের মধ্যেই অমৃতলোকের পরিচয় দিয়েছিলেন, তাঁর মৃত্যুর দ্বারা অমৃতরূপ পরিস্ফুট হয়ে উঠেছিল, আজ তাঁর মৃত্যুর অন্তর্নিহিত সেই পরম সত‍্যটিকে যেন আমরা স্পষ্ট আকারে দেখতে পারি।” উপনিষদীয় ভাবনায় জারিত রবীন্দ্রনাথ, এভাবেই অমৃতময় পুরুষ যিশুর প্রতি তাঁর দার্শনিক উপলব্ধির প্রকাশ ঘটিয়েছেন আরও বিভিন্ন লেখায়। এ প্রসঙ্গেই আসে ‘মানবপুত্র’ কবিতাটির কথা। কবিতাটি লেখার কয়েক বছর পর, এরই অনুসরণে তিনি একটি গানও রচনা করেন। দুটি ক্ষেত্রেই প্রতিফলিত হয়েছে যিশু খ্রিস্টকে ঘিরে কবির মানবপ্রেমের আর্তি।

কবিতাটিকে যখন গানে পরিণত করলেন রবীন্দ্রনাথ, তার মূল বক্তব্য অক্ষুন্ন রইল। কিন্তু কবিতার গঠনপ্রণালী বদলে গেল গানে। এখান থেকে বোঝা যায়, একজন আদর্শ সংগীতকার যখন কোনও কবিতা থেকে গান তৈরির কথা ভাবেন, তখন তিনি সেইসব কবিতাকেই বেছে নেন, যার মধ্যে সুরবিহারের অবকাশ আছে। এ ব‍্যাপারে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কবিতাটির গঠনে কিছু পরিবর্তন আনতে হয়, যাতে তা আদর্শ গান হয়ে উঠতে পারে। এটা সহজ হয়, কবি যখন নিজের কবিতাতে সুরারোপ করেন। কিন্তু যখন অন‍্যের কবিতাতে কোনও সংগীতকার সুর দিয়ে তাকে একটি সুন্দর গানে পরিণত করতে চান, স্বাভাবিকভাবেই সে ক্ষেত্রে কবিতাটিকে পরিবর্তনের অধিকার তাঁর থাকে না। তখন কোন কবিতায় সুর-প্রবেশের অবকাশ আছে, সেই নির্বাচনটি হয়ে ওঠে মুখ‍্য। যেভাবেই হোক না কেন, কবিতা থেকে অসাধারণ গান হয়ে ওঠার অনেক সার্থক দৃষ্টান্ত যে বাংলা গানের জগতে আছে, তা সবার জানা। আসা যাক মূল প্রসঙ্গে।

Santiniketan picture

১৩৩৯ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ মাসে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ‘মানবপুত্র’ কবিতাটি। যা ‘পুনশ্চ’ কাব‍্যগ্রন্থে সংকলিত হয়। কবিতাটি এইরকম―

মৃত্যুর পাত্রে খৃস্ট যেদিন মৃত‍্যুহীন প্রাণ উৎসর্গ করলেন
                  রবাহূত অনাহূতের জন‍্যে,
                            তার পরে কেটে গেছে বহু শত বৎসর।
আজ তিনি একবার নেমে এলেন নিত‍্যধাম থেকে মর্ত‍্যধামে।
                            চেয়ে দেখলেন,
সেকালেও মানুষ ক্ষতবিক্ষত হত যে-সমস্ত পাপের মারে―
        যে উদ্ধত শেল ও শল‍্য, যে চতুর ছোরা ও ছুরি,
যে ক্রুর কুটিল তলোয়ারের আঘাতে―
                  বিদ‍্যুদবেগে আজ তাদের ফলায় শান দেওয়া হচ্ছে
        হিসহিস শব্দে স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে
                            বড়ো বড়ো মসীধূমকেতন কারখানাঘরে।

কিন্তু দারুণতম যে মৃত‍্যুবাণ নূতন তৈরি হল,
       ঝকঝক করে উঠল নরঘাতকের হাতে,
                পূজারি তাতে লাগিয়েছে তাঁরই নামের ছাপ
                             তীক্ষ্ণ নখে আঁচড় দিয়ে।
                    খৃস্ট বুকে হাত চেপে ধরলেন;
বুঝলেন শেষ হয় নি তাঁর নিরবচ্ছিন্ন মৃত‍্যুর মুহূর্ত,
               নূতন শূল তৈরি হচ্ছে বিজ্ঞানশালায়―
                             বিঁধছে তাঁর গ্রন্থিতে গ্রন্থিতে।
সেদিন তাঁকে মেরেছিল যারা
                            ধর্মমন্দিরের ছায়ায় দাঁড়িয়ে,
     তারাই আজ নূতন জন্ম নিল দলে দলে,
            তারাই আজ ধর্মমন্দিরের বেদীর সামনে থেকে
                           পূজামন্ত্রের সুরে ডাকছে ঘাতক সৈন‍্যকে―
                                    বলছে, ‘মারো মারো’।
            মানবপুত্র যন্ত্রণায় বলে উঠলেন ঊর্ধ্বে চেয়ে,
                           ‘হে ঈশ্বর, হে মানুষের ঈশ্বর,
                                    কেন আমাকে ত‍্যাগ করলে!’

Painting of Jesus Christ

কবিতাটি ১৩৩৯ বঙ্গাব্দ, অর্থাৎ ১৯৩২ সালে লেখা। এর সাত বছর পর, ১৯৩৯ সালের বড়দিনের আগে, এই কবিতা থেকে একটি গান তৈরি করেন রবীন্দ্রনাথ। যা সেই বছরে আশ্রমের খ্রিস্ট জন্মোৎসবের অনুষ্ঠান গেয়েছিলেন আশ্রমকন‍্যা ইন্দুলেখা ঘোষ। অ্যান্ড্রুজ সাহেব শেষবারের মতো সভাপতিত্ব করেছিলেন সেই অনুষ্ঠানে। কারণ, পরের বছর, ১৯৪০-এর মে মাসে তিনি প্রয়াত হন। এই গানটির হয়ে ওঠার কাহিনি তাঁর ‘স্বর্গের কাছাকাছি’ বইয়ের একজায়গায় লিখেছেন মৈত্রেয়ী দেবী―”… এইবার ডিসেম্বরে খৃষ্টজন্মোৎসব হবে। এনড্রুজ সাহেব আসবেন।… দুপুরবেলা আমাকে বললেন, আমার খৃষ্টের উপর একটা গদ‍্যকবিতা আছে না? না, তুমি তো আবার গদ‍্যকবিতা পড় না। আমি বললাম, আচ্ছা বের করে দিচ্ছি। পুনশ্চ থেকে ‘মানবপুত্র’ কবিতাটা বের করে দিলাম। কবি বললেন, এবার তুমি পালাও আমি এটাতে সুর দেব। সন্ধ‍্যাবেলা এসে শুনি ‘একদিন যারা…’ গানটি তৈরি হয়েছে। কবি বললেন, এটি খৃষ্টদিবসে গাওয়া হবে। সাহেব খুশি হবে।” ‘সাহেব’ হলেন অ্যান্ড্রুজ সাহেব। এভাবেই কবিতাটি থেকে জন্ম নিল একটি গান। প্রসঙ্গত, গানটি ‘বড়োদিন’ শিরোনামে ‘প্রবাসী’ পত্রিকার মাঘ ১৩৪৬ বঙ্গাব্দ সংখ‍্যায় প্রকাশিত হয়েছিল।―

একদিন যারা মেরেছিল তাঁরে গিয়ে
     রাজার দোহাই দিয়ে
এ যুগে তারাই জন্ম নিয়েছে আজি,
মন্দিরে তারা এসেছে ভক্ত সাজি―
      ঘাতক সৈন‍্যে ডাকি
                 ‘মারো মারো’ ওঠে হাঁকি।
গর্জনে মিশে পূজামন্ত্রের স্বর―
মানবপুত্র তীব্র ব‍্যথায় কহেন, ‘হে ঈশ্বর!
এ পানপাত্র নিদারুণ বিষে ভরা
দূরে ফেলে দাও, দূরে ফেলে দাও ত্বরা।।’

সেই সময়ের ‘বড়দিন’-কে কেন্দ্র করে, খ্রিস্ট-স্মরণে এইসব কবিতা ও গান লিখে রবীন্দ্রনাথ কী বলতে চেয়েছিলেন তা মোটেই অস্পষ্ট নয়। সেদিক থেকে দেখলে মনে হয়, আজকের সমাজে যখন হিংসা, হানাহানি, মূল‍্যবোধহীনতা, মধ‍্যমেধার দাপট, ক্ষমতার আস্ফালন ইত‍্যাদি চূড়ান্ত আকার নিয়েছে, তখন কবির এই সৃষ্টিগুলি সেদিনের তুলনায় আজকে যে আরও কতটা প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে, সেটাই লক্ষণীয়।

Aveek Chottopadhyay Author

জন্ম ১৯৬৫-তে কলকাতায়। বেড়ে ওঠা চন্দননগরে। স্কুল জীবন সেখানেই। কলকাতার সিটি কলেজ থেকে স্নাতক। ছোটো থেকেই খেলাধূলার প্রতি আগ্রহ। গান শেখাও খুব ছোটো থেকেই। তালিম নিয়েছেন রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের কাছেও। দীর্ঘদিন মার্কেটিং পেশায় যুক্ত থাকার পর, গত বারো বছর ধরে পুরোপুরি লেখালেখি, সম্পাদনার কাজে যুক্ত। পুরনো বাংলা গান, সিনেমা, খেলা ইত্যাদি বিষয়ে অজস্র প্রবন্ধ লিখেছেন। আনন্দবাজার পত্রিকা, এই সময়-সহ বহু পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। সম্পাদিত বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য উত্তমকুমারের "হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি মোর", হেমন্ত মুখোপাধ‍্যায়ের "আনন্দধারা", রবি ঘোষের "আপনমনে", মতি নন্দীর "খেলা সংগ্রহ"। লিখেছেন "সংগীতময় সুভাষচন্দ্র" বইটি। সাত বছর কাজ করেছেন "মাতৃশক্তি" ও "জাগ্রত বিবেক" পত্রিকায়। বর্তমানে নিজস্ব লেখালিখি ও সম্পাদনা নিয়ে ব্যস্ত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *