অফিসের কাজে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি গেছি ম্যানচেস্টারে। রবিবার পৌঁছে সোম থেকে শুক্র একটানা হোটেল আর অফিস। পরের রবিবার সকালে রিটার্ন ফ্লাইট। শনিবারটা হাতে পেয়ে ভাবলাম আশপাশে একটু ঘুরে দেখি। শুক্রবার অফিসে কাজ শেষ হলে সহকর্মীদের জিজ্ঞেস করলাম কোথায় যাওয়া যায়! একজন বললেন,”বেশি কিছু তো দেখতে পারবে না এক দিনে। কাল আবার বৃষ্টি হবে বলছে আবহাওয়া দফতর। চলে যাও সিটি সেন্টার বা পিকাডিলিতে। চারদিকে অনেক ট্যুরিস্ট স্পট আছে— হেঁটেই ঘুরতে পারবে। আর এখন তো ক্রিসমাস মার্কেট পুরো জমে গেছে। তোমার ছবি তোলার ভালো সাবজেক্টও পেয়ে যেতে পারো।” কথাটা বেশ মনে ধরল। বছরখানেক লন্ডনে থাকার সুবাদে শুনেছিলাম এদেশে ম্যানচেস্টারের ক্রিসমাস মার্কেটটাই সবথেকে বেশি জমজমাট। পনেরো দিনে প্রায় পঞ্চাশ লাখের বেশি লোকের ভিড় জমে সেখানে। হরেক কিসিমের পসরা সাজিয়ে বসে প্রায় পাঁচশো স্টল।

Manchester

ওরসলিতে নোভোটেল ম্যানচেস্টার ওয়েস্ট হোটেলে ঠাঁই হয়েছে আমার। শনিবার সকাল ন’টার মধ্যে ব্রেকফাস্ট সেরে ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। একটা ট্রান্সপোর্ট কার্ড কিনলাম। ইউরোপের বেশিরভাগ শহরে পাব্লিক ট্রান্সপোর্টের ব‍্যবস্থা ভালো। এইরকম স্মার্টকার্ড যাতায়াতের ক্ষেত্রে খুব কাজে দেয়। সারাদিনে এক বা একাধিক ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির যে কোনও বাসে, ট্রামে, ট্রেনে উঠে পড়া যায়। কিন্তু মুশকিল হল, ওরসলি থেকে সেন্ট্রালে যেতে দুটো রুটের লাল ডবল-ডেকার বাসই ভরসা। ঘণ্টাখানেক লাগে সেন্ট্রাল পৌঁছতে। অল্পের জন্যে একটা বাস মিস করায় আরও দেরি হয়ে গেল। পরের বাস ফাঁকা, উঠে বসলাম দোতলায় একদম সামনের সিটে। এদিকটায় সব বাড়িই প্রায় দোতলা, সামনে একচিলতে বাগান আর গ্যারেজ। রাস্তাঘাট প্রায় শুনশান। আধঘণ্টা বাদেই এরকম বাড়ি কমতে লাগল; রাস্তার দুপাশে তখন একশো-দুশো বছরের ছাই ছাই রঙের পেল্লায় হেরিটেজ বিল্ডিংগুলোর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঝাঁ চকচকে হাইরাইজ। রাস্তাগুলো অপেক্ষাকৃত সরু হতে লাগল, মানুষ আর গাড়ির সংখ্যাও বাড়তে থাকল। বুঝলাম সিটি সেন্টার দূরে নয়। এদিকে রোদ-বৃষ্টির খেলা সমানে চলছে। কেউই হারার পাত্র নয়। যখন বাস পিকাডিলি টার্মিনাসে এসে দাঁড়াল, হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি। গায়ে রেন-জ্যাকেট আছে, কিন্তু ক্যামেরা বাঁচাতে ঢুকে পড়লাম একটা সুপারস্টোরে। এই তালে কিছু শপিং করার লোভ সামলাতে পারলাম না। মেয়ের জন্যে কী নেব, তা মনে মনে লিস্ট করা ছিল। যে সেকশনেই যাচ্ছি, দেখছি আমারই বয়সী একজন সেখানেও হাজির। একই রকমের জিনিস কিনছেন। দেখে আমাদের দেশের বলেই মনে হল। যেচেই আলাপ করলাম। পাকিস্তানের মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। এই শহরে মাঝেমধ্যেই আসেন। ওঁরও এক মেয়ে, আমার মতো, বারো বছরের। আমাকে লিস্ট ধরে ধরে বুঝিয়ে দিলেন এখানে কোন স্টোর বা কোন মল থেকে কিনব জিনিসগুলো।

Christmas market

বৃষ্টি ঝিমিয়ে পড়ল ঘণ্টাদুয়েক বাদে। শপিংও তখন প্রায় শেষ। ঝলমলে মিষ্টি রোদ দেখে পা দিলাম বাইরে। সবুজ গালিচার মতন পিকাডিলি গার্ডেনের ঘাস। মাঝে একটা গোল চত্বরে ছোট ছোট ফোয়ারা, তাতে সন্ধে নামলে নির্ঘাত রং ধরবে। বাচ্চারা খেলছে। ক্যামেরা বার করলাম। কিন্তু সাথে সাথেই আবার আকাশের মুখ গোমড়া। ক্যামেরা আবার ব্যাগে। ঠান্ডা, বৃষ্টি, সঙ্গে ম্যানচেস্টারের হাওয়া! খোলা জায়গায় ঠিকমতন হাঁটাই দায়। চোখের সামনে তিনজনের ছাতা ওল্টালো। সবক’টাই কিন্তু সেই দাদুর বিশাল ছাতা; যা ছাতাও বটে আবার হাঁটার লাঠিও বটে। ওল্ড ট্র্যাফোর্ডের পিচে বল কেন এত সুইং করে তা এতদিনে বুঝলাম। যাইহোক, হাঁটা দিলাম সেন্ট্রালের আকর্ষণ অ্যালবার্ট স্কোয়ারের দিকে।

টাউন হলের সামনে বিশাল এক সান্টা ক্লজ। চারদিকে সারি সারি দোকান, কী নেই তাতে! বেলজিয়াম গ্লাসের আসবাব, জাপানি বনসাই, ইটালিয়ান লেদারের ব্যাগ, ফ্রেঞ্চ পারফিউম, আফ্রিকার কাঠের পুতুল ও আরও অনেক টুকিটাকি জিনিস দেখে চোখে তাক লেগে গেল। দুনিয়ার প্রায় সব কোণ থেকে কিছু না কিছু আছে। একটা স্টলে ঢুকে ভিয়েতনামি সিল্কের একটা স্কার্ফ দেখে লোভ হল। দাম তেরো পাউন্ড থেকে শুরু। বুঝলাম, কেনার সামর্থ‍্য সীমিত হলে এইসব দেখেই সুখ, যাকে বলে উইন্ডো-শপিং। এরপর মরক্কোর ল্যাম্পশেড, ডাচ ডিনার সেট, ম্যানচেস্টারের বিভিন্ন মেমেন্টো পেরিয়ে দেখা পেলাম ভারতীয় ব্রোঞ্জের নটরাজ, লক্ষ্মী আর গণেশের। তাঁদের পাশে সুদৃশ্য লেদার নোটবুক— ওপরে হাতে আঁকা অপূর্ব মোটিফ! মন ভরে গেল, কিন্তু এবার পেটের তাগিদ জানান দিল বিকেল হয়েছে। সকালের তাগড়াই ব্রেকফাস্ট ততক্ষণে পুরোটাই হজম। একটা অরগ‍্যানিক ফুডস্টল থেকে ড্রাইফ্রুটস আর নাটস কিনে মুখে দিতে খিদে যেন আরও বেড়ে গেল। ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি ফিসফিস করে পড়েই চলেছে। বড় রাস্তায় খাবারের আর বিয়ারের স্টলগুলোতে ভিড় দেখে কলকাতা বইমেলার বেনফিশের স্টল মনে পড়ে গেল। একটু ভেতরে ঢুকলাম, পায়ের তলায় এবার পাথরে বাঁধানো সরু রাস্তা। দুপাশে ক্রিসমাসের টুকিটাকি— পুতুল, টুপি, গ্লাভস, টি-শার্ট, সোয়েটার, মাফলার। সবেতেই সান্টার মার্কামারা লালের ছোঁয়া। ক্রিসমাস ক্যারল বাজছে।

Christmas market 2

খিদের চোটে এখন অ্যারোমা ক্যান্ডেলের গন্ধও আর মনে ধরছে না। তবে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। আর্নডেল শপিং সেন্টারের কাছে সার দিয়ে রঙবেরঙের দোকানে তৈরি হচ্ছে ফ্রেঞ্চ ক্রেপ,স্প্যানিশ পায়েলা, হাঙ্গেরিয়ান গুলাস, ইটালিয়ান পিৎজা, আরও কত কী! যত দেখি তত খিদে বাড়ে। শেষে নিলাম গ্রিক ঈড়ো— পিটা ব্রেডের উপর চিকেন, টম্যাটো আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাইস। কামড় দিয়ে মনে হল স্বর্গীয়। খেতে খেতে হাঁটতে থাকলাম। হঠাৎ ক্যারল ছাপিয়ে কানে এল অতি পরিচিত কীর্তন। পা চালিয়ে ভিড় ঠেলে দেখি দু’জনের একজন খোল বাজাচ্ছে, অন‍্যজন হারমোনিয়াম। সঙ্গে খঞ্জনিতে আরও দু’জন। সবারই কপালে তিলক, পরনে ধুতি। দু’জন শাড়ি পরা মহিলাও গলা মিলিয়েছেন। সবারই মুখে হাসি লেগে। এর একটু পাশেই দেখি একজন বয়স্ক ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা গম্ভীর মুখে বাইবেল বিতরণ করছেন। ওয়াইড অ্যাঙ্গেল লেন্স না থাকায় একসাথে ধরতে পারলাম না দুই প্রচারক দলকে। ভালো একটা সাবজেক্ট হাতছাড়া হয়ে গেল। মনে মনে আমিও বলে উঠলাম— হরে খ্রিস্ট, হরে খ্রিস্ট!

ছবি সৌজন্য: লেখক

Prantik Biswas

প্রান্তিক বিশ্বাসের জন্ম কলকাতায়। স্কুলে থাকতে লেখা শুরু। ১৯৯৭ থেকে ২০০০ পর্যন্ত কালান্তর সংবাদপত্র, সময় ও গ্রন্থন পত্রিকায় প্রকাশিত হয় গল্প, কবিতা ও রম্যরচনা। তারপর ২০০০ সাল থেকে দীর্ঘ পনেরো বছরের বিরতি লেখায়। ফিরে আসা ছোটগল্প, অণুগল্প, নিবন্ধ ও উপন্যাসে। তথ্যপ্রযুক্তির কর্মী, বর্তমানে কর্মরত কলকাতায়। লেখা ছাড়া ঘুরতে, ছবি তুলতে আর আঁকতে ভালোবাসেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *