“বরফ কেটে পথ চলছে স্লেজ গাড়ি। চাকা তো নেই। গাড়ির নিচের লম্বা ডান্ডা দুটোয় ছিটকে ছিটকে যাচ্ছে কুচি কুচি বরফ। গাড়ি টানছে বলগা হরিণের দল। তার মধ্যে একটার নাক আবার টুকটুকে লাল। সে ব্যাটার নাম রুডল্ফ!”

এই পর্যন্ত শুনেই পুটুন ছটফট করে ওঠে। অনেক প্রশ্ন। বল্গা হরিণ কী? রুডলফের নাক কেন লাল? সে সবের যথাসাধ্য ব্যাখ্যা দিতে না দিতেই ধেয়ে আসে এর অমোঘ প্রশ্নবাণ। গানে বলা হয়েছে – ড্যাশিং থ্রু দ্য স্নো, ইন আ ওয়ান হর্স ওপেন স্লে… তাহলে? কোথা থেকে এল বল্গা হরিণের দল? গানে পষ্ট বলেছে একমেবাদ্বিতীয়ম ঘোড়া টানছে স্লেজগাড়ি। আর এ গানের চেয়ে বিশ্বাসযোগ্য বড়দিন সঙ্গীত তো আর কিছু হতে পারে না! যুগ যুগান্তর ধরে এ গান গাওয়া হয়ে চলেছে বড়দিনে। অথচ সান্তাবাবুর ছবি মানেই বল্গা হরিণ। কোথাও এক, কোথাও তিন, কোথাও অনেক! অথচ আইকনিক গানে কিনা হরিণ হল ঘোড়া?

বাধ্য হয়েই হার মানতে হল। পুটুনকে বললাম, “কি জানি! কেন যে হর্স বলল জানি না। বোধহয় এক এক দেশে এক এক রকম, বুঝলি! আমাদের কিনা গরম দেশ। বরফ পড়ে না। বল্গা হরিণ তো এখানে বাঁচবে না! তাই ঘোড়া। আর সাইবেরিয়া কিম্বা ল্যাপল্যান্ডে ঘোড়া চলবে কী করে। অত্ত বরফ! তাই ওখানে বল্গা হরিণ। কিন্তু গানে কি অত কথা বলা যায়। তাই হর্স বলে সেরে দিয়েছে।” পুটুন একটুও খুশি হল না। “তুমি কিচ্ছু জান না। গান কখনও ভুল হয়?” অকাট্য যুক্তি। খানিকক্ষণ তাও এদিক ওদিক করে চেষ্টা চালালাম। কিন্তু পুটুনের মন উঠল না।

একে তো এখনও কেনাই হয়নি রাংতার পাইন গাছে লাল নীল বল, টুনি বাল্ব আর উপহারের বাক্স। লাল ঘণ্টি আর তারা প্যাকেটবন্দি হয়ে পড়ে আছে খাটের পেছনে। এ বার একটু বড় সাইজের সান্তা-পুতুল কেনার ইচ্ছে ছিল পুটুনের। কিন্তু আবদার ধোঁপে টেঁকেনি। কোথায় রাখব, ধুলো পড়বে, ভেঙে ফেলবি, এইসব বাজে কথা বলে মামমাম ছোট্ট সান্তা কিনে এনেছে। ময়দায় অ্যালার্জি বলে কেক খাওয়া তো কবে থেকেই বারণ। তারমধ্যে গান নিয়ে এই উটকো ঝামেলি। পুটুন তিতিবিরক্ত।

এদিকে নিজের উপহারেরও ঠিক নেই। ইশকুলের দিদিমণি বলেছেন, অত দুষ্টু ছেলেদের সান্তা উপহার দেয় না। সারাক্ষণ মারামারি, পড়াশুনো করব না, কারও কথা শুনব না, খালি বায়না করব, এসব কি সান্তা সারাবছর দেখেনি বলতে চাও? এ বছর সান্তার ঝুলিতে তোমার জন্য কিচ্ছুটি নেই। পুটুন বিষয়টা নিয়ে খুবই চিন্তিত ছিল। মামমাম আর বাবার সঙ্গে জরুরি ভিত্তিতে একটা মিটিং ডেকেছিল। ওঁরা বলেছেন, “তুমি তাহলে সরি বলে একটা চিঠি লেখ সান্তাকে। বলো যে এমন আর করবে না। যদি তাতে কিছু কাজ হয়।”

পুটুন লিখতে বসল। পেন্সিল-রবারের ঠিক থাকে না তার কোনওকালেই। মামমামের প্যাড থেকে কাগজ ছিঁড়লে বকুনি অবধারিত। তবু একটা ছিঁড়ে নিল পুটুন। খুঁজেপেতে আধখানা পেন্সিল বেরোল ব্যাগের কোণ থেকে। পুটুন চিঠি লিখতে বসল। কিন্তু শুরুতেই কনফিউশন! ইশকুলে যে বলল, সান্তা হল ফাদার ক্রিসমাস। তাহলে কি ডিয়ার সান্তা লিখবে নাকি ডিয়ার ফাদার ক্রিসমাস? ঠিক হল ওপরে টু ফাদার ক্রিসমাস লিখে, নিচে ডিয়ার সান্তা রাখা হবে। যৎপরোনাস্তি দুঃখপ্রকাশ করে পুটুন জানাল সে আর কক্ষনও দুষ্টুমি করবে না। সে খুবই সরি।

এবার?

উপহারের যে লিস্টিটা সে মনে মনে ভেবে রেখেছে, সেইটে দেয় কোথায়? সরি লিখেই হ্যানা চাই ত্যানা চাই লিখে দেওয়া কি ঠিক হবে? কিন্তু এখানে না লিখলে লিখবেই বা কোথায়? আবার একটা চিঠি? অত লেখাপড়া পুটুনের কোনওকালে পোষায় না। থাক এখানেই লিখে দেওয়া যাক। সান্তাদাদু লোক ভালো। এক দুই করে কী কী চাই লিখে দেয় পুটুন। তারপর চিঠি বালিশের তলায় রেখে দেয়।

সন্ধেবেলা মামমাম আপিস থেকে ফিরলে পুটুন প্রায় বল্গা হরিণের মতোই লাফিয়ে পড়ে মায়ের ঘাড়ের ওপর। এ অবশ্য রোজকার ব্যাপার। কিন্তু মামমাম আজ রাগ না-করে বলল, “রেডি হয়ে নাও। লেক মার্কেটে যাবে না?” ইয়েসসসসস। আর চাই কী। লেক মার্কেট মানেই ক্রিসমাস ট্রি। সোনালি-লাল-নীল-সবুজ বল, লাল ফুলের ঝালর, চিকচিকে লাল রঙের বো, কুট্টি কুট্টি লন্ঠন, বরফ বানানোর জন্য সাদা ফোম স্প্রে, রাইস বাল্বের চেন… পুটুন আর ভাবতে পারে না। গান নিয়ে কী যেন একটা সমস্যা তাকে দিনভর ভাবাচ্ছিল, আর মনেই পড়ে না। আলো ঝলমল লেক মার্কেটের ভিড়ে, একরাশ ছানাপোনাদের কিচিরমিচিরে, শয়ে শয়ে নানা সাইজের রাংতা-গাছের চকমকিতে, কমলালেবুর গন্ধে, চকলেটের কাগজের খচমচ শব্দে পুটুন আহ্লাদে আঠেরোখানা হয়ে যায়। সান্তা, আমার সান্তা, কখন আসবে আমাদের বাড়িতে। মনে মনে বলতে থাকে পুটুন। আমাদের বাড়িতে তো চিমনি নেই। রাত্তিরে বন্ধ দরজা ভেদ করে কী করে ঢুকে পড় তুমি প্রত্যেকবার। আমি কত চেষ্টা করি জেগে থেকে কান খাড়া করে তোমার স্লেজগাড়ির শব্দ শুনতে! কিন্তু পাই না। ঠিক ঘুমিয়ে পড়ি।

ততক্ষণে প্যাকেটবন্দি হয়ে গিয়েছে পাইনগাছ আর তার সাজুগুজুর সরঞ্জাম। বাড়িতে এসে পুটুন শুনল তার চিঠিটাও নাকি আর বালিশের তলায় নেই। সান্তা কি বল্গা হরিণ পাঠিয়ে নিয়ে গেল তাহলে? পুটুন নিশ্চিন্ত হয়েও হতে পারে না! সান্তার বাড়ি নেমন্তন্ন, না আঁচালে বিশ্বাস নেই। উফফফ দুষ্টু ছেলে হওয়ার কি একটা জ্বালা? গাছের ডালে বল বাঁধতে গিয়ে একটা বল ছুড়তে ইচ্ছে হয় পুটুনের। সাঁইইইইই করে সোনালি বল উড়ে যায় জানলার দিকে। ব্যাস। হারেরেরে করে তেড়ে আসে বড়দের দল। কতগুলো তো ঝালর আছে, একটা নিয়ে টানাটানি করলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হচ্ছে শুনি? ওমনি সবাই উহুহুহুহু করে বলে ওঠে, “তাহলে আর সান্তা এল না ঝুলি নিয়ে।” দূর বাবা, এর চেয়ে সান্তার সঙ্গে দেখা করে পষ্টাপষ্টি কথা কয়ে নিলেই হয়, কতটা দুষ্টুমি করলে তুমি আমার নাম উপহারের লিস্টিতে রাখবে আর কতটা হলে কাটাকুটি।

বকুনি টকুনি নিয়েই গাছ সাজানো শেষ। এবার লাল টুকটুক টেডি বিয়ার লাগানো ছোট্ট মোজাখানা মাথার কাছে দেরাজের হ্যান্ডেলে ঝুলিয়ে দেয় পুটুন। মামমাম গলা ফাটিয়ে শুতে ডাকছে। দূর। পুটুনের সব প্ল্যান বানচাল। গানের ব্যাপারটা আজই খোলসা করে নেবে ভেবেছিল। চোখ মিটমিট করে দেখবে স্লেজটা কে টেনে আনে – ঘোড়া না বল্গা হরিণ! কিন্তু হল না। মামমামের গলায় “ব্রিং আস আ ফিগি পুডিং অ্যান্ড আ কাপ অফ গুড চিয়ার” শুনতে শুনতে চোখ বুজে আসে পুটুনের। বন্ধ জানালার বাইরে তখন সান্তার স্লেজ ঘোরাঘুরি করে। চাঁদের ওপর বল্গা হরিণের ছায়া পড়ে। পুটুনের ঘুমন্ত মুখে দেয়ালার হাসি দেখে ফিক করে ফোকলা মুখে হেসে দেয় উড়ন্ত সান্তা। কলকাতার ধোঁয়াশা ভেদ করে ছুটে আসে এক ঝলক হিমহিম বাতাস। সাইবেরিয়া থেকে কি? পুটুন জানতে পারে না। ফ্লাইওভারের নিচে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকা পুটুনরাও জানতে পারে না। তারা কেবল আরও একটু পা গুটিয়ে পাশ ফেরে। ‘তুষারের রাজধানী ধুয়ে যায় জ্যোৎস্নায়…’

লিখতে শিখেই লুক থ্রু! লিখতে লিখতেই বড় হওয়া। লিখতে লিখতেই বুড়ো। গান ভালবেসে গান আর ত্বকের যত্ন মোটে নিতে পারেন না। আলুভাতে আর ডেভিলড ক্র্যাব বাঁচার রসদ। বাংলা বই, বাংলা গান আর মিঠাপাত্তি পান ছাড়া জীবন আলুনিসম বোধ হয়। ঝর্ণাকলম, ফ্রিজ ম্যাগনেট আর বেডস্যুইচ – এ তিনের লোভ ভয়ঙ্কর!!

3 Responses

  1. পুটুনের বড়দিন পড়ে পুটুন হতে ইচ্ছে হলো। আমাদের পুটুনবেলায় এত কিছু জানতামই না।বিজয়দার দোকানের এক আনার পান কেক, ওই অবধি ছিলো দৌড়।ফ্লাইওভারের নীচের পুটুনদের কথা ছুঁয়ে যাওয়ায় লেখাটি যেন সম্পুর্ণতা পেল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *