সাত বছরের রাজিয়া যখন ১৯৯৫-এর তেহরানের বাজারে হন্যে হয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে তার হারিয়ে যাওয়া ৫০০ তোমানের নোটটার জন্য, তার আশা-নিরাশা, হতাশা-আনন্দের দোলাচলে শরিক হয় তার দ্বিগুণ বয়সী একগুচ্ছ দাদা-দিদিরাও, দক্ষিণ কলকাতার গার্ডেন হাই স্কুলের ফিল্ম-ক্লাবে । ‘সব রঙের মিশ্রণে কোনো আলাদা রং থাকে না, রয়ে যায় সাদা, তাই ফিল্মের নাম “ হোয়াইট বেলুন” – আর কীই বা হতে পারত?’ বলে ওঠে ক্লাস এইটের একজন । ‘ঠিক উল্টো, সব রং সরে গেলে থেকে যায় যা, তাই তো সাদা – বাকি বেলুন বিক্রি হলেও শুধু সাদা বেলুনটাই বিক্রি হয়নি যে’, হলের অন্য প্রান্ত থেকে বলে ওঠে অন্য একজন, এক বছরের বড় সে । ‘আমার কিন্তু মনে হল, শেষের যে ছেলেটি ছিল, যে হয়তো ইমিগ্রান্ট, যার কোথাও যাওয়ার নেই এই ইরানের নববর্ষে, বেলুনটাও যেন সেই ছেলেটার মতো’ মনে করে ফিল্ম-ক্লাবের আরও এক সদস্য । 

শুধুমাত্র ফিল্ম দেখা না, পৃথিবীর নানা প্রান্তের অসাধারণ নানা ছবি দেখে তা নিয়ে অকপট বক্তব্য রাখে ইস্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা, ক্লাস ৮ থেকে ১২র । যারা ফিল্ম-ক্লাবের সদস্য তারা জানে, যে ছবি খুব সহজেই হলে গিয়ে দেখা যাবে তেমন ছবি ফিল্ম-ক্লাবে দেখা হবে না সচরাচর । এখানে সেই ছবিগুলোই তারা দেখবে, আলোচনা করবে যা তাদের বয়সী বেশিরভাগই ইস্কুলপড়ুয়ারাই দেখেনি, সাধারণভাবে দেখবেও না, হয়তো । কিন্তু মুখ্য উদ্দেশ্য তো ছবি দেখা না, মূল বিষয় হলো সেই ছবি নিয়ে আলাপ, তর্ক, প্রশ্ন – কোনো একক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হবে না, এখানে কোনো ‘মডেল’ উত্তরও তাই নেই, হয় না, হতে পারে না ।

আর ঠিক সেকারণেই ফিল্ম-ক্লাবটা তার পড়ুয়া সদস্যদের কাছে এত প্রিয় । কারণ এখানেই তারা অনায়াসে বলতে পারে ইংমার বার্গম্যানের “ওয়াইল্ড স্ট্রবেরিস”-এর যে উন্মুক্ত সমাপ্তি তারা গ্রহণ করতে পারছে না । ‘ছবির কোনো অংশ যদি পাল্টাতে চাও’ জিজ্ঞেস করলে তারা অকাতরে বলে ইভাল্ড তার ছেলের প্রতি নির্দয়, অনুভূতিহীন, চরিত্রের এই বৈশিষ্ট্য তারা মেনে নেয় না । কেউ বা মনে করে মারিয়ান কেন এতো সহজে ভেঙে পড়ে? কিংবা সহজ সরল অনুভূতিতে একদল বলেই ফেলে সিনেমার প্রয়োজনে হলেও ওতো দামি একটা গাড়ি কেন ডিরেক্টার নষ্ট করলেন একসিডেন্টে! 

এরাই কিন্তু পড়ে ফেলে ঠিক কীভাবে বাস্টার কিটনের থেকে পৃথক জমিতে বসবাস করেন চার্লি চ্যাপলিন । কিটন তাঁর “কপস” ছবিতে নিতান্তই একজন সাধারণ মানুষ – অনেকের মধ্যে যে কেউ, চ্যাপলিন সবসময়ই স্বতন্ত্র, একমেবাদ্বিতীয়ম । আর এই দুজনকে যখন “লাইমলাইট”এর চূড়ান্ত ক্লাইম্যাক্সে একসঙ্গে দেখা যায় তখন দ্বিগুণ মজার আনন্দ পায় ফিল্ম-ক্লাবের সদস্যরা ।

কিন্তু সব ছবিতেই তো আর অবিমিশ্র আনন্দের উপচার নেই, নেই শেষে মিলিয়ে দেওয়ার সুখানুভূতিও তাইআইভ্যান চাইল্ডহুডবাদা বয় ইন স্ট্রাইপড পাজামাসদেখে ডুকরে ওঠে মোবাইলনিবিষ্ট প্রজন্ম তাদের ঘন চোখের পাতা আর্দ্র হয়ে ওঠে যখনচিলড্রেন অফ হেভেনএর আলি রেসে জিতে গিয়েও হেরে যাওয়ার দুঃখ বহন করে, যখনবাইসাইকেল থিভসএর ছোট ব্রুনো তার বিপর্যস্ত বাবার হাতটা ধরার আগে দুবার ভেবে নেয়  

যে নির্মম সরলীকরণে আমরা প্রত্যহ দোষ দিই আজকের বাঙালি মধ্যবিত্তের শহুরে প্রজন্মের আপাত নিস্পৃহচারণকে, সেই বোধের গোড়াতেই আঘাত করে এই সদস্যরা তারা চমকে দিতে থাকে তাদের চিন্তার সহজ, সরল অভিনিবেশে, তাদের নির্ভীক মতপ্রকাশের স্বাধীন প্রবৃত্তিতেএবং তাদের স্বকীয় দৃষ্টির প্রসারতায়নাহলেঅন দ্য ওয়াটারফ্রন্টএর শেষ দৃশ্যে মার্লোন ব্রান্ডোর মাটি থেকে উঠে আস্তে আস্তে কারখানার কর্মীদের সঙ্গে মিশে যাওয়া দেখে কেন একজন ভেবে উঠবে যেন অনেকটাই যীশু খ্রিস্টের রেসাররেক্শন? কিংবামন আঙ্কলএর স্যাটায়ার যা আমাদের সকলের গালেই, এমন কি তাদের গালেও একটা সপাটে থাপ্পড়, তা দেখে ঠিক চিহ্নিত করতে পারবে শহরকেন্দ্রিক মেকি আধুনিকতাবাদের স্বরূপগুলো । 

আসলে, কিছুই হারিয়ে যায়না সেভাবেমনের গহনে চাপা থাকে, আর অনুযোগ অভিযোগ বাইরে থেকে চাপিয়ে দিই আমরা বড়োরাইতাই সুযোগ পেলে, অনুকূল সাহচর্যে বিকশিত হয় শিশুকিশোরদের মনের মুকুলঠিক যেভাবে আর্ট বা সংগীত একটি শিশুর মানসিক বিকাশে সাহায্য করে, হয়ে ওঠে তার বেড়ে ওঠার অঙ্গাঙ্গী, অনিবার্য উপকরণ সেভাবেই সিনেমা উদ্বেল করতে পারে, ভাবাতে পারে, অনুভূতিপ্রবণ করে তুলতে পারে আগামী প্রজন্মকেএবং সঠিক সিনেমা প্রকৃত অর্থেই মানুষ হয়ে ওঠার শিক্ষকের কাজ করতে পারে অনস্বীকার্যভাবেনিরন্তর ইঁদুরদৌড়ে ছুটতে ছুটতে, বাবামার প্রত্যাশার তুলাযন্ত্রে পরীক্ষিত হতে হতে এই ছোটমানুষগুলো যখন অপাবৃত মায়াময় চোখ দিয়ে দেখতে থাকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বৈচিত্র্যের কাহিনি, বুঝতে থাকে কী অপার রহস্যে তাদের থেকেও দুর্দশায় থাকা মানুষদের মুখে লেগে থাকে অনাবিল হাসি, তখন তাদের মনোজগৎ বিস্তৃত হয়, প্রকাশিত হয় নব উদ্ভাসেআর এখানেই চলচ্চিত্রের উড়ান, আমাদের পরের প্রজন্মের জয়, আমাদেরও হতাশ না হতে শেখার পরীক্ষা

পেশাগতভাবে এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত। নেশায় সিনেমাপ্রেমী। চলচ্চিত্র বিষয়ক একাধিক বই লিখেছেন বাংলা ও ইংরেজিতে। স্মৃতি সত্তা ও সিনেমা, কিছুটা সিঁদুর বাকিটা গোলাপ, সত্যজিত রে'জ হিরোজ অ্যান্ড হিরোইনজ, সিক্সটিন ফ্রেমজ এই লেখকের কিছু পুর্ব প্রকাশিত বই।

3 Responses

  1. প্রথমেই তোমাকে ধন্যবাদ জানাই এই রকম একটা সুন্দর লেখার জন্য ।এই লেখার সমালোচনা করার যোগ্যতা আমার নেই ।ছোটদের নিয়ে এই কাজটা খুবই কঠিন ।এই কাজে সাফল্যের জন্য রইলো শুভেচ্ছা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *