বাচ্চাদের মধ্যে এখন অ্যাস্থমা খুব বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। কলকাতা শহরের শিশুরোগ বিশেষজ্ঞদের চেম্বারে গেলে দেখা যাবে পঞ্চাশ শতাংশ রোগী অ্যাস্থমার সমস্যা নিয়ে এসেছে। একে বলা হয় চাইল্ডহুড অ্যাস্থমা। এই রোগ সম্বন্ধে বেশ কিছু ভুল ধারণা প্রচলিত। বাচ্চাদের অভিভাবকদের মধ্যেও এ ব্যাপারে সচেতনতা বাড়ানোর প্রয়োজন আছে। কোনও বাচ্চার চাইল্ডহুড অ্যাস্থমা হয়েছে শুনলেই অনেক বাবা মা মনে করেন এটা একটা দূরারোগ্য অসুখ কিন্তু এই ধারণা একেবারেই ঠিক নয়। গত কুড়ি বছরে অ্যাস্থমা নিয়ে প্রচুর গবেষণা হয়েছে আর তাই অ্যাস্থমাটা এখন আমরা আগের চেয়ে অনেক ভালো বুঝি।
নগরায়ণ যত বাড়ছে মানুষ ততই প্রকৃতির থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। শহরাঞ্চলে গাছপালা কমে যাওয়া, বায়ুদূষণ, জনঘনত্ব বেড়ে যাওয়া, বাড়িঘর বেড়ে যাওয়ার কারণে বাচ্চাদের মধ্যে এই অসুখের প্রকোপ বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু সঠিক সময়ে এবং সঠিক ওষুধের প্রয়োগে এই রোগ সারানো সম্ভব। ধুলো ধোঁয়া থেকে বাচ্চাদের দূরে রাখা ছাড়াও এই রোগ সম্বন্ধে বাবা-মায়েদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোও প্রয়োজন যাতে আমরা রোগজনিত মৃত্যু কমাতে পারি। সচেতনতা থাকলে অ্যাস্থমা সম্পূর্ণভাবে সারিয়ে তোলাও সম্ভব। অনেক পূর্ণবয়স্ক মানুষের মধ্যে অ্যাস্থমা দেখতে পাওয়া যায়, কারণ তারা কম বয়সে চিকিৎসা পাননি। অনেক ক্ষেত্রেই ঠিক সময়ে চিকিৎসা হলে পূর্ণবয়সে গিয়ে অ্যাস্থমা নিয়ে ভুগতে হয় না।
অ্যাস্থমা চিকিৎসায় ইনহেলার
অ্যাস্থমা চিকিৎসায় ইনহেলারের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ডাক্তারি ভাষায় আমরা এগুলোকে ইনহেলড কর্টিকো স্টেরয়েড বলে চিনি। সারা পৃথিবীতেই অ্যাস্থমা চিকিৎসায় ইনহেলারের ভূমিকা স্বীকৃত। কিন্তু ইনহেলার ব্যবহারের ব্যাপারে অনেক রোগীর পরিবারের মধ্যে অনীহা দেখতে পাওয়া যায়। গ্রামাঞ্চলে তো বটেই, এমনকি শহরের মানুষের মধ্যেও ইনহেলার নিয়ে ভুল ধারনা আছে। এই ধারণা মূলত দু রকমের –
১। ইনহেলার ব্য়বহার শুরু করলে রোগী আর এর থেকে বেরোতে পারবে না
২। ইনহেলার ব্য়বহার করলে অ্যাস্থমা বেড়ে যাবে
৩। ইনহেলারের মধ্যে থাকা স্টেরয়েড বাচ্চার বৃদ্ধির হার কমিয়ে দিতে পারে
এই ভুল ধারণাগুলো ভাঙা খুব জরুরি। চিকিৎসক মহল এবং মিডিয়ার এ ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করা উচিৎ।
আগে মনে করা হতো, অ্যাস্থমা হাইপার রিঅ্যাক্টিভিটি এয়ারওয়ে ডিজিজ। এখন এটাকে বলা হয় ইনফ্লামেটরি এয়াওয়ে ডিজিজ। ফুসফুসের এই ইনফ্লামেশন অর্থাৎ ফুলে যাওয়া যদি না কমানো যায় তাহলেই রোগীর অ্যাস্থমা হয় আর এই ইনফ্লামেশন কমানোর জন্যই ইনহেলার ব্যবহার করা হয়। ঠিক সময়ে ইনহেলারের প্রয়োগ না হলে বড় হয়ে অ্যাস্থমা হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। যত প্রাপ্তবয়স্ক অ্যাস্থমা রোগী আমরা দেখতে পাই তাদের অধিকাংশই ছোটবেলায় চিকিৎসা পাননি। অন্যদিকে একটা শিশুর যত বেশি বার অ্যাস্থমা অ্যাটাক হবে, বড় হয়ে এই অসুখের প্রকোপে পড়ার সম্ভাবনা তত বাড়তে থাকবে।
বাচ্চার দেহে ইনহেলড কর্টিকো স্টেরয়েডের প্রভাব
অনেক অভিভাবক আশঙ্কা করেন,ইনহেল কর্টিকো স্টেরয়েডের প্রভাবে বাচ্চাদের বাড় কমে যেতে পারে। কিন্তু ইনহেলারে কর্টিকো স্টেরয়েডের পরিমাণ এতই কম থাকে যা তাতে বাচ্চার গ্রোথের ওপর কোনও প্রভাব পড়ে না। উল্টোদিকে অ্যাস্থমা থেকে হওয়া শ্বাসকষ্ট থেকেই বরং বাচ্চার গ্রোথ কমার সম্ভাবনা থাকে। তাছাড়াও, খাওয়ার ওষুধে যে স্টেরয়েড থাকে,যাকে আমরা ওরাল স্টেরয়েড বলি, তা আমাদের পাচনতন্ত্রের মধ্যে দিয়ে প্রথমে রক্তে মেশে তারপর ফুসফুসে যায়। অন্যদিকে ইনহেল কর্টিকো স্টেরয়েড সরাসরি ফুসফুসে যায়। আর সরাসরি ফুসফুসে যায় বলেই অত্যন্ত কম ডোজে রোগীকে এই স্টেরয়েড দেওয়া যায়। তাই তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই স্টেরয়েডে বাচ্চার বাড় কমার সম্ভাবনা থাকে, ইনহেলারেই সেই সম্ভাবনা সবচেয়ে কম।
কী ভাবে বাচ্চাকে অ্যালার্জির হাত থেকে দূরে রাখবেন
অ্যালার্জির ট্রিগার সাধারণত দু রকমের – ইনহেলেন্ট (যেগুলো নিশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে) আর ইনজেস্টেন্ট (যেগুলো মুখ দিয়ে, খাওয়ার মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে)। খাবার থেকে আমরা চাইলেই দূরে থাকতে পারি। যে খাবারে অ্যালার্জি হচ্ছে, সেই খাবার এড়িয়ে চলা উচিত। কিন্তু ইনহেলেন্টের ওপরে অনেক সময়েই আমাদের নিয়ন্ত্রণ থাকে না। আমাদের চারপাশে প্রচুর ট্রিগার রয়েছে, ধুলো তার মধ্যে অন্যতম। পুরনো বই, পর্দা, সোফা, কুশন, এসবের মধ্যে সাধারণত প্রচুর ধুলো জমে থাকে, যা খালি চোখে বোঝা যায় না। অ্যাস্থমা আছে এমন বাচ্চাদের অভিভাবকেরা কয়েকটা বিষয় মাথায় রাখার চেষ্টা করবেন।
১. পর্দা, সোফা কভার নিয়মিত কাচুন
২. বাচ্চার বালিশের কভার ঘনঘন পাল্টাতে থাকুন
৩. খেলাধুলোর সময় অথবা রাস্তাঘাটে মাস্ক ব্যবহার করুন
৪. বাচ্চা বাড়িতে থাকলে ধুলো ঝাড়ার কাজ করবেন না
৫. বাচ্চার সামনে ধূমপান করবেন না
৬. বাড়ি আরশোলা মুক্ত রাখুন
ড. সুব্রত চক্রবর্তী এক জন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ। তিনি ইন্সটিটউট অফ চাইল্ড হেল্থ-এর শিশুরোগ বিভাগের অধ্যাপক এবং একাধিক হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত।