পানীয় জলের বিষয়ে সকলেই সতর্ক। নতুন জায়গায় আসার আগেই আড়কাঠি পই পই করে জানিয়ে রাখে ঝরনা বা নদীর জলে বিষ মিশে আছে। ধাবা থেকে বোতলের জল কিনে খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। কাজেই পানীয় জল এবং স্নানের জল গাঁটের পয়সা দিয়ে কিনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। এই সুবাদে একদল মানুষ শুধুমাত্র তথাকথিত বিশুদ্ধ জল বিক্রি করেই গ্রাসাচ্ছদন করে চলছে।
বদলে যাচ্ছে নদীর জলের রঙ
র্যাটহোল মাইনিং-এর দৌলতে ইস্ট জয়ন্তিয়া হিলস্ জেলার লুভা বা লুখা নদীর জল পুরো নীল হয়ে গেছে। দূষিত জল নিয়ে মেঘালয়ের মধ্যে আরও আট কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে সোনাপুরের কাছে লুভা নদী বাংলাদেশে ঢুকে লুবাছড়া নাম নিয়ে সিলেট জেলার সুরমা নদীতে পড়ে। লুভার বিষাক্ত জল মিশে সুরমা নদীতে বিপন্ন প্রজাতির গোয়ালপাড়া লোচ মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
কেন এইভাবে নদীর জলের রং বদলে যায় বা জলের রং বদল কীভাবে বন্ধ করা যায় সে বিষয়ে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার নির্বিকার। সমীক্ষায় দেখা গেছে, জলে অম্লতা বেশি। ক্যালসিয়াম ও সালফেটের মাত্রাও বেশি। সালফার-এর আধিক্যের জন্য মেঘালয়ের কয়লা বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের উপযোগী নয়। ঊনবিংশ শতকের ব্রিটিশ প্রশাসকদের সঙ্গে বিংশ শতাব্দীর কোল ইন্ডিয়া লিমিটেড এই বিষয়ে সহমত পোষণ করে। তারপরেও কয়লা খনন করা হয় এবং তার ফলে দূষিত হয় পরিবেশ ও প্রকৃতি।
র্যাটহোল মাইনিং ছাড়া প্রকৃতির অন্যান্য সম্পদের অবৈজ্ঞানিক ব্যবহারও পরিবেশ দূষণের জন্য অনেকাংশে দায়ী। নারপু এলাকায় ২০০৪ ও ২০০৬-এ দু’টি সুবৃহৎ সিমেন্ট সংস্থার কারখানা তৈরি হয়েছিল। এর পরেই ২০০৭ থেকে লুভা নদী জলের রং নীল হয়ে উঠতে শুরু করে। পাশাপাশি কানাইঘাট-এ চলছে বড় বড় পাথর খাদান। থাংস্কাই ও লামস্নং এলাকায় থাকা চুনাপাথর খনি, সিমেন্ট কারখানা ও কয়লা খনিগুলিই রং বদলের জন্য দায়ী বলে সাধারণ ধারণা। লুভা নদীর জলের রং বদলের সঙ্গে জলের চরিত্রও বদলে যায়। জল হয়ে ওঠে বিষাক্ত। সেখানে থাকা অন্য জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদও অক্সিজেন পায় না।
র্যাটহোল মাইনিং-এর জেরে ধ্বংস হচ্ছে বাস্তুতন্ত্র
এমন চলতে থাকলে গোয়ালপাড়া লোচের মতো আরও অনেক জলজ প্রাণীই লুভা-সুরমা থেকে হারিয়ে যাবে। জলের চরিত্র বদল, বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস হওয়ার জেরেই হয়ে চলেছে বিভিন্ন জলজ প্রাণীর অবলুপ্তি। লুভা নদীর দূষিত জল লুবাছড়া নাম নিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে সুরমায় মিশে যাওয়ার ফলে সুরমা নদীর জলও দূষণ মুক্ত হবার সম্ভাবনা কম।

শুধু লুভাই নয়, মেঘালয়ের মিন্ত্রা নদীও জোয়াইয়ের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে লামু ও উমসিয়ারিং নামে পাহাড়ি দু’টি নদীর সঙ্গে মিলিত হয়ে জয়ন্তিয়াপুর বা জৈন্তাপুরের লালা খাল দিয়ে বাংলাদেশে ঢোকে। সেখানে এই নদী সারি নামে প্রবাহিত হয়েছে। সেটিও পরে সুরমা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। মিন্ত্রার জলবাহিত দূষণ ও রাসায়নিকও সুরমায় মিশছে।
উনিশশ আশির দশকে র্যাটহোল মাইনিং-এর সূচনা পর্বে এমন সতর্কবার্তা দেওয়া হত না। যে কোনও প্রাকৃতিক জল পানে মানা ছিল না। কিন্তু একের পর এক শিশু-কিশোর যাদের পরিচয় ‘র্যাটহোল কয়লা খনির শ্রমিক’ অ-শুদ্ধ প্রাকৃতিক জল খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ায়, এমনকি অনেকে মারা যাওয়ার পর থেকে পানীয় জলের বিষয়ে সকলেই সতর্ক।
শ্রমিকদের জন্য নেই চিকিত্সা পরিকাঠামো
সতর্ক না হলে সকলের সমস্যা। এখানে তো চিকিৎসার তেমন কোনও ব্যবস্থা নেই। হাসপাতাল তো দূরের কথা একটা সাদামাটা কাজ চালানোর মতো প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রও খুঁজে পাওয়া কঠিন। থাকার মধ্যে রয়েছে ইস্ট জয়ন্তিয়া হিলস্ জেলার দুটি কমিউনিটি হেল্থ সেন্টার, ছয়টি প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র আর পঁয়ত্রিশটি সাব-সেন্টার।
ওয়েস্ট জয়ন্তিয়া হিলস্ জেলায় রয়েছে চারটি কমিউনিটি হেল্থ সেন্টার, এগারোটি প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র আর ছেচল্লিশটি সাব-সেন্টার। জোয়াই শহরে অবিশ্যি একটি সরকারি হাসপাতাল আছে। ইদানিং কয়েকটি বেসরকারি নার্সিং হোম ও হাসপাতালও তৈরি হয়েছে। কমিউনিটি হেল্থ সেন্টার, প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র আর সাব-সেন্টারের হাল সারা দেশে একইরকম। মেঘালয় তার ব্যতিক্রম নয়।
দূষিত জল ছাড়াও অন্য বিপদ লুকিয়ে আছে খনির ভেতরে। কয়লার সীম কাটতে কাটতে এগিয়ে যাওয়া শ্রমিক কখন যে হঠাৎ করে বিষাক্ত গ্যাসের খপ্পরে পড়ে যাবে তা কেউ জানে না। সবমিলিয়ে সবরকমের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে চলে র্যাটহোল মাইনিং-এর শিশু-কিশোর শ্রমিক।

শ্রমিক অসুস্থ হয়ে পড়লে উৎপাদন ব্যাহত হয়
শ্রমিক অসুস্থ হয়ে পড়লে উৎপাদন ব্যাহত হয়। কাজেই খনির মালিক এবং বিনিয়োগকারীর মাথায় হাত। অসুখের মাত্রা বাড়াবাড়ি অবস্থায় পৌঁছলে চিকিৎসার জন্য একটু দৌড়ঝাঁপ না করলেই নয়। না, লোক দেখানোর জন্য নয়। হঠাৎ করে একজন শ্রমিক কমে গেলে পুরো উৎপাদন ব্যবস্থা বিঘ্নিত হয়।
কাজেই রোগীকে নিয়ে হয় জোয়াই নয় তো ক্লেহরিয়াট-এ ছোটাছুটি। এর মধ্যে রোগী মারা গেলে আরও এক দফা অশান্তি। মৃতদেহ নিয়ে সমস্যা নয়। সে তো পাহাড়ের খাঁজে বা জঙ্গলের গহনে কিংবা নদীতে ফেলে দিলেই হয়। কিন্তু হঠাৎ করে একজন শ্রমিক কোথায় পাওয়া যাবে?
রাস্তার ধারে গড়ে ওঠা অস্থায়ী ধাবায় এদের নিত্যকার খাওয়া দাওয়া। র্যাটহোল মাইনিং-এর দৌলতে এখন তো জাতীয় সড়কের ডাইনে-বামে চরাচর ভেদ করে চলে গেছে অনেক গ্রামছাড়া ভাঙামাটির পথ। গ্রামবাসীর জন্য নয়, কয়লার ট্রাক চলাচলের উপযোগী এইসব রাস্তার ধারেই রমরমিয়ে চলে অবৈধ র্যাটহোল মাইন-এর অনুসারি ধাবা, যেখানে সারাদিন তো বটেই রাতেও কোথাও কোথাও রয়েছে পানাহারের বন্দোবস্ত।
চুরি যাচ্ছে শৈশব
রেডিওতে বাজে নেপালি বা বাংলাদেশি গান। কোনও কোনও ধাবার ভিতরে টিভি-ও চলে। বেশি রাতে ভিডিও চালিয়ে নীলছবিও নাকি দেখানো হয়। আর রয়েছে মূলত ট্রাক ড্রাইভার, খালাসিদের মনোরঞ্জনের জন্য লালবাতির কারবার।
উনিশশো আশির দশক বা তারও আগে গুয়াহাটি বা শিলং থেকে নৈশবাসে শিলচর যাওয়ার সময় জোয়াই বা ক্লেহরিয়াটে বাস থামলেই যাত্রীরা সতর্ক হয়ে যেতেন। বাসের ভিতর ডিম সিদ্ধ বিক্রি করতে আসা বাচ্চা ছেলেগুলো কখন যে কার ব্যাগ-বস্তা নিয়ে দৌড়ে পালাবে তার ঠিক নেই। এমনকি শীতের রাতে যখন বাইরে নির্ঘাত দু’তিন ডিগ্রির বেশি তাপমাত্রা নয়, তখনও এর ব্যতিক্রম হত না। গায়ে নাগা চাদর জড়িয়ে, পায়ে গরম মোজা পরে এবং অবশ্যই বাঁদুরে টুপিতে কান-মাথা ঢেকে বাসের সিটে জবুথবু হয়ে বসে থাকা যাত্রীদের ডিম-বেচা ছোকরাদের উপর সতর্ক নজর রাখতেই হত।
এখন আর অতটা সতর্ক না হলেও চলে। সেইসব ছেলে ছোকরাদের অধিকাংশই এখন র্যাটহোল মাইনিং-এর সঙ্গে যুক্ত। খনি অবৈধ হলেও তারা তো রীতিমতো শ্রমিক। সারাদিন খাটাখাটনির পর সন্ধ্যার আঁধারে বসে জুয়ার আসর। চলে পানাহার। শ্রমিকের বয়সটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। রোজগার থাকলেই জুয়া বা সুরার ঠেকে ঠাঁই মেলে।
ছবি সৌজন্য: minesandcommunities
প্রশিক্ষিত প্রযুক্তিবিদ ও পরিচিত পরিকল্পনাবিশারদ। পড়াশোনা ও পেশাগত কারণে দেশে-বিদেশে বিস্তর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। তার ফসল বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় বই। জোয়াই, আহোম রাজের খোঁজে, প্রতিবেশীর প্রাঙ্গণে, কাবুলনামা, বিলিতি বৃত্তান্ত ইত্যাদি।