— রঞ্জিতা, এ কী কাণ্ড? তুমি প্যান্ট শার্ট পরে পুজোবাড়িতে চলে এসেছ ?
— কী করব ? সোজা কাজ থেকে আসছি তো।
— আরে তুমি এখনও এখানে দাঁড়িয়ে বকবক করছ রঞ্জিতা? আমরা কখন থেকে গ্রিনরুমে অপেক্ষা করছি তোমার জন্য…
বার্টলেট হাইস্কুলের দরজা সবে পার হয়েছি। সামনে রেজিস্ট্রেশন ডেস্ক। আশেপাশে চেনা মুখ। নীল লাল হলুদ শাড়ি। চুড়ি বালার রিনঝিন। কুশল বার্তা বিনিময়। সবুজ পাঞ্জাবি। কালো ধুতি। উৎসবের আলোয় ঝলমল করছে সব মুখ। ডেস্কের সামনে লাইন তখনও তেমন লম্বা নয়। শুক্রবার। হাতঘড়িতে সন্ধ্যে সাড়ে ছটা। সঙ্গে একটা ছোট স্যুটকেস। সকাল ছটায় সেটা গুছিয়ে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েছি।
এসব কী ভাবছি আমি? ভাবছি গোলাপির বদলে গাঢ় বাদামি শাড়িতে কি নাটকে আমার ভূমিকাটা বেশি খুলত? যাক গে! এখন এটাই পরে ফেলি। ভাবার সময় কই? তাও ভাগ্যিস ঝুমা চটপট করে চুলটা বেঁধে মুখের মেকআপটা করে দিয়েছে। এরই মধ্যে শুক্লাদি এসে বলে গেছেন,
— তৈরি তো সবাই? রত্নাবলির নাচটা হয়ে গেলেই কিন্তু আমাদের নাটক।
ছাত্রদের বাবা-মার উদ্বেগ মেশান মুখগুলো সব আবছা। হারিয়ে যায় সহকর্মীদের পরিচিত হাসিমুখ। একই দিনের সকাল আর সন্ধ্যে  – যেন দু’টো সম্পূর্ণ আলাদা জগতের মানুষ আমি। মন আকুল। কাঁসরের ধ্বনি। ঘণ্টার আওয়াজ। বুকের মধ্যে উথালপাথাল। আরতি শুরু হল নাকি? দশপ্রহরণধারিনী দেবী। ধর্মকামার্থমোক্ষদা। আমার অস্তিত্বের সঙ্গে গাঁথা হয়ে আছে এই মাতৃমূর্তি। সুমিতদা চালচিত্রটা কেমন করল এ বছর? স্থানীয় শিল্পী সুমিত রায় প্রতি বছর নিজের প্রতিভা ও শ্রম উজাড় করে একই প্রতিমার ভিন্ন ভিন্ন চালচিত্র সৃষ্টি করেন। দেখার মতো কাজ!
— ও শুক্লাদি , একবার মায়ের মুখটা দেখে আসি?
— পাগল হলে নাকি? এক্ষুণি স্টেজে উঠতে হবে। কার্টেন কল-এর পরে যেও।
বিএজিসি-র প্রতিমা
স্থানীয় হাইস্কুল। আড়াইটে দিন। শুক্রবার সন্ধ্যে থেকে শুরু। তারপরের দু’টি দিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত। কলকাতা থেকে আসা শিল্পী। অমিত কুমার। কৌশিকী। মনোময়। দেবশঙ্কর। নাচ, গান, নাটক। প্রতিমা। আগের, তার আগের বছরেরটাই। প্রসাদ। অঞ্জলি। ফুল। বেলপাতা। ঢাকাই শাড়ি। বাইলুম। ধাক্কাপাড় ধুতি। কস্টিউম জুয়েলারি বিক্রেতা। স্টল। খিচুড়ি। সন্দেশ। মিষ্টি পোলাও। কষা মাংস। দারুণ ভিড়। শনিবার। নারকেল নাড়ু। পেঁড়ার বাক্স। অডিটোরিয়ম। ব্যস্ততা। কাটা ফল। ঘটে আমশাখা। কলাবউ। সংস্কৃত মন্ত্র। স্কুল পার্কিং লট। ছোটখাট  জটলা। ঘেরা জায়গা। সিঁদুর খেলা। ওয়েট ওয়াইপস। হাসি। গল্প।  ছবি তোলা। আনন্দ। হুল্লোড়। ভুলে যাওয়া। ভুলে থাকা। শিকাগোর পুজো।
মহালয়া থেকে বিজয়া – এ প্রবাসেও দেবীপক্ষ আসে। বিএজিসি-র নিজস্ব উপস্থপনায় “মহিষাসুরমর্দিনী” মল্লিকাদি, দীপালিদি, বাচ্চুদা আর পাপড়িদির সমবেত কণ্ঠে ‘রূপং দেহি জয়ং দেহি। সুব্রতদার “অশ্বিনের শারদপ্রাতে” পাঠ। গত পনের বছর ধরে।  ছোটবেলায় রেডিওতে শোনা মহালয়ার স্মৃতি। ল্যাপটপের পর্দায় কাজের ইমেইল। প্রেক্ষাপটে মায়ের মুখ। ঘরে বাইরে দৈনন্দিন দিনযাপনের কাজের তালিকা। তারই মধ্যে দিদি কাম বান্ধবীর ফোন
— এই যে রঞ্জিতে, পুজোয় কী শাড়ি পরবে ঠিক করে ফেলেছ?
— না না কোথায় আর? শুক্রবার কাজ থেকে সোজা পুজোতে। সকালে উঠে যে শাড়িটার কথা মনে হবে সেটা প্যাক করে ভরে ফেলব স্যুটকেসে।
শুধু কি শাড়ি? তার সঙ্গে মিলিয়ে হার, দুল, চুড়ি — কেমন করে যেন কাপড় কাচা, রান্না করা, বাসন মাজার ফাঁকে জায়গা করে নেয়। নাভিশ্বাস ওঠে কাজের চাপ সামলে বঙ্গভবনে প্রতি শুক্রবার সন্ধ্যে সাতটার সময় রিহার্সাল দিতে যেতে। কিন্তু উৎসাহের ঘাটতি নেই। বঙ্গভবন – বৃহত্তর শিকাগোর বাঙালিদের নিজেদের বাড়ি। শুধু আমি নই। এ সময় বঙ্গভবন জমজমাট থাকে সাধারণত। নানাবয়সের নানা ছেলেমেয়ে নানা অনুষ্ঠানের মহড়া দিতে থাকে। গান বাজে। নাচের তালে তালে দুলে ওঠে মন। মা আসছেন। প্রতিমার কাঠামোয় খড়ের ওপর মাটি চড়ে। রং লাগান শুরু হবে এবারে। মৃন্ময়ী মা চিন্ময়ী হবেন। আকাশে বাতাসে তারই আয়োজন।
কোন সপ্তাহান্তে যেন এবারের পুজো? খোঁজ নিতে হবে পুজোসংখ্যায় লেখা দেওয়ার নির্ধারিত সময়সীমা পার হয়ে গেল কিনা। পুজোসংখ্যা “শারদীয়া সমাজসংবাদ” ছাপা হবে। স্থানীয় বাঙালীদের গল্প, কবিতা, স্মৃতিচারণ -শারদ অর্ঘ্য। আরও মনে পড়ল-এই শুক্রবারে একটু তাড়াতাড়ি বেরতে হবে কাজ সেরে -পুজোর সংস্কৃতিক সন্ধ্যার নাটকের মহড়া শুরু হচ্ছে। এবারে ভার্চুয়াল। তা হোক। উৎসবের এই তো শুরু।
মনে পড়ে। ঢাকে কাঠি পড়েছে। মা আসছেন। পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুন না কেন, বাঙালির মন এ সময়টায় অন্যরকম হয়ে যায়। আনন্দময়ীর আবাহনের সময় কিনা! বাংলার পাড়ায় পাড়ায় চলেছে প্যান্ডেল বাঁধার প্রস্তুতি। মণ্ডপসজ্জায় কে কত সৃষ্টিশীলতার পরিচয় দিতে পারে তার প্রতিযোগিতা। সেসব থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে থেকেও উৎসবের উত্তেজনার আঁচ এসে পৌঁছয় আমেরিকার মধ্য পশ্চিমের ইলিনয় রাজ্যের এই  শহরে। এখন আকাশ প্রায়দিনই মেঘলা। হাওয়ায় শিরশিরে ভাব। হালকা কার্ডিগান আর চাদরের উষ্ণতা চায় শরীর। গাছে গাছে রঙের জোয়ার। লাল, গোলাপি, বেগুনি পাতায় ছেয়ে গেছে মাঠঘাট পথ। এ দেশের  ঋতুচক্রের নিয়মমতো এখন ‘ফল সিজন’… শরৎকাল।  শারদোৎসবের সময়। বঙ্গভবনে  প্রি-পুজো সেল। শিকাগোর স্থানীয় মানুষজন  শাড়ি বা গয়নার পসরা সাজিয়ে তো বসবেন বটেই, কাছাকাছি অন্যান্য শহর থেকেও আসেন কেউ কেউ। বিএজিসি-র ইমেইল। বান্ধবীদের ফোন। কে কে যাবে সেখানে, কখনই বা যাবে জেনে নেওয়া। বান্ধবীদের সঙ্গে দল বেঁধে শাড়ির দোকানে শাড়ি উল্টে পাল্টে গায়ে ফেলে দেখা। পুজোর উত্তেজনা এই অভিবাসেই বা কম কী? আড়াই দিনের উৎসব। আড়াই মাসের প্রস্তুতি। যেই না সূর্যের দক্ষিণায়ন শুরু হয়, দিনের শেষ আলোর সবটুকু মুছে যেতে রাত প্রায় নটা বাজে। শিকাগোর বাঙালি সমাজ মেতে ওঠে পরিকল্পনায়। আনন্দময়ীর আবাহনের পরিকল্পনায়।
আমাদের একটিই বারোয়ারি পুজো। হ্যাঁ, একটাই পুজো শিকাগোতে। পুজোকে কেন্দ্র করে বাঙালিরা ভাগ হয়নি এখানে। পুজোর ব্যবস্থাপনা করে বেঙ্গলি অ্য়াসোশিয়েশন অফ গ্রেটার শিকাগো, সংক্ষেপে বিএজিসি। এ ছাড়াও এ শহরে হয় বেদান্ত সোসাইটির পুজো, ভারত সেবাশ্রম সংঘের পুজো। সম্প্রতি এখানে শিকাগো কালীবাড়ি দুর্গাপুজোর আয়োজন করছে। ইউনিভার্সিটি অফ ইলিনয়-এর বাঙালি ছাত্রছাত্রীরাও নিজেদের মতো করে দেবীবন্দনার ব্যবস্থা করে। তবে শিকাগোর দুর্গাপুজো মানে বিএজিসি-র পুজো। সব বয়সের বাঙালি দুর্গাপুজোর আনন্দের সামিল হন এখানে। এ পুজো তিথি নক্ষত্র বা দিনক্ষণ পাঁজি মেনে হয় না। পুজোর তিথির কাছাকাছি কোন সপ্তাহান্তে দেবীবন্দনার আয়োজন হয় সাধারণত। ব্যবস্থাপনায় কিছু বিচ্যুতি থেকেই যায়। থাকলেই বা? অন্তরের ভক্তি আর আবেগ দিয়ে আমরা সব ঘাটতি পূরণ করি। আড়াই দিনের জন্য হলেও ভুলে যাই প্রবাসের বেদনা আর জীবনধারণের সংগ্রাম। আমাদের পরবাসে দুর্গাপুজো হল বিশেষ ভাললাগার, ভালোবাসার আর সকলকে কাছে টেনে নেওয়ার উৎসব। আমি ২০০১ সাল থেকে দেশছাড়া। পুজোর সময় দেশে যাওয়ার সুযোগ নেই।
বহুতল ইস্কুলবাড়ির “পিকচার উইন্ডো” দিয়ে বাইরে তাকালাম। আজ  নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা। মন কেমন করা রোদের সোনালি  ছোঁয়া গাছের পাতায় পাতায়। দৈনন্দিনের কর্তব্য থেকে মন সরে যায়। মনে পড়ে যায় তখনই, যে দাগ দিতে হবে ক্যালেন্ডারে। কোন সপ্তাহান্তে যেন এবারের পুজো? খোঁজ নিতে হবে পুজোসংখ্যায় লেখা দেওয়ার নির্ধারিত সময়সীমা পার হয়ে গেল কিনা। পুজোসংখ্যা “শারদীয়া সমাজসংবাদ” ছাপা হবে। স্থানীয় বাঙালীদের গল্প, কবিতা, স্মৃতিচারণ, শারদ অর্ঘ্য। আরও মনে পড়ল, এই শুক্রবারে একটু তাড়াতাড়ি বেরতে হবে কাজ সেরে। পুজোর সংস্কৃতিক সন্ধ্যার নাটকের মহড়া শুরু হচ্ছে। এবারে ভার্চুয়াল। তা হোক। উৎসবের এই তো শুরু।
প্রতিমা পুরনো হলেও পুজো পুরনো হয় না
এ বছর অন্যান্য বছরের থেকে আলাদা। অতিমারী আক্রান্ত আমাদের এই বাসভূমি গ্রহটিতে বাস্তবের চেহারা দ্রুত বদলে যাচ্ছে। উৎসবের রূপ তাই কিছু অন্যরকম এই পুজোয়। মা আসছেন। মনের অবচেতনে খুশির ভাব তাই আছে। কিন্তু এবারের পুজোয় দেখা হবে কি বন্ধুদের সঙ্গে? বৃহত্তর শিকাগোর বাঙালি সমাজ একটা বড় পরিবারের মতো। সব বয়সের সব মানুষ পুজোর সপ্তাহান্তটিতে সমবেত হন। এবারের পুজো ভার্চুয়াল। ভোরবেলা উঠে স্নান সেরে সাজুগুজু করে পুজোবাড়িতে পৌঁছনোর তাড়া নেই ষষ্ঠী, সপ্তমী বা অষ্টমীতে। ভোগ রান্নার দরকার নেই। নাড়ু বানানোর রেসিপি চেয়ে আর প্রতিবেশি দিদিকে ফোন করতে হবে না। বাড়ি বসেই দেখা যাবে পুজো। পুজোর জোগাড় শুরু হয়ে গেছে। সন্ধ্যেবেলার জলসাও উপভোগ করা যাবে একইভাবে। শারদীয়া সন্ধ্যার সংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলছে জোর কদমে। কয়েকটি নির্দিষ্ট জায়গা থেকে প্যাকেটে ভরে ভুরিভোজও মিলবে। মেনু দেখা হয়ে গেছে। ল্যাপটপ বা স্মার্টফোনের পর্দায় দেখা যাবে পুজো। শোনা যাবে আমাদের ঘরের পুরোহিত রামানুজদার সংস্কৃত মন্ত্রোচ্চারণ – “জ্ঞানাজ্ঞানং কৃতং পাপং হরগৌরী হরপ্রিয়ে।” দিন গুনছি।
মারণ জ্বর আমাদের কাবু করলেও বন্ধ করতে পারেনি দুর্গাপুজোর উদযাপন। মারের সাগর আমরা পাড়ি দেবই – আজ হোক বা কাল। এই আশায় বুক বেঁধে আমরা, বৃহত্তর শিকাগোর বাঙালিরা, মাতৃ আরাধনার আয়োজন করেছি এ বছরও। গতবছর বিজয়ার পরে সবাই মিলে গলা ছেড়ে যখন  বলেছিলাম “আসছে বছর আবার হবে”, ধুনুচির ধোঁয়ায় আবছা হয়ে যাওয়া মায়ের মুখে দেখেছিলাম আশ্বাস। সব শেষেই থাকে নতুন আরম্ভের আশ্বাস। বিসর্জনের পরে আবার আবাহনের পালা। হলই বা তা একটু অন্যরকম!

রঞ্জিতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোর বাসিন্দা। পেশায় শিক্ষিকা। নেশা বই পড়া লেখালিখি।"বাতায়ন" নামের একটি আন্তর্জাতিক পত্রিকা সম্পাদনা করেন গত ছ বছর। এক দশকেরও বেশি সময় শিকাগোর "উন্মেষ সাহিত্য গোষ্ঠী"র সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। রঞ্জিতার বিশ্বাস, সাহিত্য ভৌগোলিক সীমানা পার হয়ে মানুষ, দেশ ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটায়।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *