১
— সুপ্রভাত!
— সুপ্রভাত! আপনাকে স্বাগতম। কিভাবে সাহায্য করতে পারি এই সকালে?
— আম পাকে বৈশাখে— এই বিষয়ে ৪ লাইনের একটা ছড়া লিখে দাও।
— বৈশাখে আম পাকে,
ফুলের ফাগুনে মধুর লেবু হাওয়ায়।
আনন্দে হাসির বিভোর দিব সগুলো,
বদলে দিবে মনের উজাল জীবনকায়।।
[২২ মে, ভোর ৪.২০]
২
— সুপ্রভাত!
— সুপ্রভাত! আপনার সাথে কিভাবে সাহায্য করতে পারি?
— আম পাকে বৈশাখে – এই বিষয়ে ৪ লাইনের একটা ছড়া লিখে দাও।
— আম পাকে বৈশাখে বন্ধন নেওয়ার সময়,
পূর্ণিমা এসে আসে সারাদিন হাসির দয়ালু রঙিন মুখে।
আবহাওয়ায় ভরে আসে মটির মতো পুঁজরে বসন্তের ছাঁদ।
আমরা উঠো, প্রকৃতি উঠো, নতুন আশায় বাঁচি পূর্ণিমায় পালিত।
[২২ মে, ভোর ৪.২৫]
৩
— সুপ্রভাত!
— সুপ্রভাত! আপনাকে শুভেচ্ছা জানাই। আপনি কিভাবে সহায়তা করতে পারি?
— আম পাকে বৈশাখে – এই বিষয়ে ৪ লাইনের একটা ছড়া লিখে দাও।
— আম পাকে বৈশাখে,
ফুলের মেলা আমেজ করে।
পুরনো বছরের আগুন জ্বলে,
নতুন আশা আমাদের ধরে।
[২২ মে, ভোর ৪.২৬]

বিষয়টি নিয়ে লিখব লিখব করেও লেখাটা হয়ে উঠছিল না। আমার খানিক গাফিলতি যেমন ছিল, তেমনই প্রথমদিকে বিষয়টাও বড্ড খটোমটো লাগছিল। কিন্তু, দেখলাম, বিষয়টার মধ্যে ঢুকে একটু সড়োগড়ো হবার পর আর মন্দ লাগছে না। বরং, মানুষের চূড়ান্ত পাকামির পাশাপাশি তার অনন্ত অনুসন্ধিৎসার শরিক হতে চাইল মন।
চ্যাটজিপিটি ব্যাপারটা জানতাম না। এর সঙ্গে যুক্ত আরও যেসব ব্যাপার-স্যাপার এই মুহূর্তে গোটা পৃথিবীকে ঝড়ের মধ্যে ফেলে দিয়েছে, আমিও-বা তার আঁচ থেকে দূরে থাকি কী করে!
বেশ কিছুদিন আগে বাংলালাইভের পক্ষ থেকে যখন এই নিয়ে লেখার আহ্বান আসে, আমি তখন এর বিন্দু-বিসর্গ কিছুই জানতাম না। ফলে, পড়াশুনো করতে বা ব্যাপারটা কী, তা আন্দাজ করতে অনেকটা সময় লাগল। একেবারেই হাল আমলের নানবিধ টেকনিক্যাল ব্যাপার, যার কিছুই বুঝি না। তবে, শুধুমাত্র জানার ইচ্ছে হল বলে এগোলাম। ওই যা বলছিলাম, ব্যাপারটা একই, আমিও মানুষ, ফলে, আমারও কিছুটা পাকামি ও জানার ইচ্ছে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। নইলে, খেয়ে-দেয়ে এইসব গাদাগুচ্ছের অদ্ভুতুড়ে কাণ্ডকারখানায় আমার কষ্ট করে ব্যস্ত হবারই-বা কী দায় পড়েছিল!
এরই মধ্যে জানতে পারলাম, আমাদের দেশে আসবে কি আসবে না, নাকি কবে যে আসবে, এইসব দোলাচলের মধ্যে তিনি এদেশেও পা রেখেছেন। বলা যায়, এখন তাঁর ট্রায়াল-রান চলছে। চ্যাটজিপিটি আমাদের বাংলা ভাষাতেও কথা বলা শিখছেন। তবে, তিনি বীরভূমের বাংলায় কথা বলবেন, নাকি বাঁকুড়ার বাংলায় বলবেন, তা জানা মুশকিল। আমরা সহস্র বছর ধরেও তো এইসব বাংলাকে আমাদের মাতৃভাষার বাইরেই রেখেছি বলা যায়। দেখুন না, রবীন্দ্রনাথ জীবনের কী বিস্তৃত সময় বীরভূমে কাটিয়েছেন, তবু, তাঁর লেখা বা দৈনন্দিন জীবনাচরণে বীরভূমের বাংলার তেমন কোনও গুরুত্ব কি লক্ষ করা যায়?

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে চ্যাটজিপিটির কী প্রভাব পড়তে চলেছে, তা নিয়েই মূলত আমার ভাবনা এখানে লিখছি। চ্যাটজিপিটি কী বস্তু, তা নিশ্চয়ই আমার বলার প্রয়োজন নেই। আপনারা সেসব আমার চেয়ে অনেক বেশি জানেন। বরং আমি এসবে সকলের চেয়ে খুবই পিছিয়ে এবং খানিক দূরেও থাকি। দু-এক কথায় বলতে পারি, চ্যাটজিপিটি এক রকমের বুদ্ধিমত্তা। তবে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। এখনও খুব বেশি বিকশিত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। অন্তত, বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে এর দশা বেশ করুণই। মানুষ যন্ত্র ও মগজ খাটিয়ে তার নিজের সমান বা তারও বেশি বুদ্ধিমান যন্ত্র তৈরির খেলা বহুদিন আগেই শুরু করেছে। একেবারে সফলও যে হয়নি, তাও তো নয়। তাই, সে যন্ত্রের নিজের বুদ্ধিতে মানুষের সঙ্গে কথা বলা মায় সৃষ্টিশীল কাজেও অংশগ্রহণের সম্ভাবনার এই নতুন খেলায় মেতেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় পূর্ণ পারদর্শী করে তুলতে মানুষ যন্ত্রের মগজে জগতের সৃষ্টি থেকে এই সাম্প্রতিকতম অতীত ইংরেজি ২০২১ সাল পর্যন্ত তার অধীত যাবতীয় তথ্য ভরে দিয়ে ভেবেছে, যন্ত্র এবার নিজেই মানুষ হবে।
আরও পড়ুন: চ্যাট-জিপিটির প্রথম পাঠ
আমি আজ ভোরে চ্যাটজিপিটির সঙ্গে যেসব কথা বলেছি, এই লেখার শুরুতেই তিনটে ভাগে তার কিছুটা দিয়েছি। যেহেতু, আমি মূলত বাংলা ভাষা ও সৃষ্টিশীল সাহিত্যে চ্যাটজিপিটির দৌড় এখন কদ্দুর, তা বোঝার চেষ্টা করছি, তাই, উপরোক্ত ব্যাপারটা চেখে দেখছিলাম। কী দাঁড়িয়েছে, তা আপনারা নিজেই দেখতে পাচ্ছেন। দুশ্চিন্তার তেমন কোনও কারণ আছে কি? আমার মনে হয়, নেই। এই মুহূর্তে তো এক্কেবারেই নেই।

দুশ্চিন্তার কারণ নেই, কারণ, চ্যাটজিপিটিকে এখনও বাংলা ভাষায় বাক্য-গঠনই শেখানো যায়নি। বাংলা শব্দভাণ্ডারের সন্ধান তাকে দেওয়া গেলেও, তার ব্যবহার বিষয়ে সে এখনও অন্ধকারেই। আবার, সম্পূর্ণ অন্ধকারে, একথাও বলা যাবে না। দ্বিতীয় লেখাটিতে, ‘আসা’ এবং ‘আশা’, একই লেখার দুটো বাক্যে এভাবে ভিন্ন অর্থের সমোচ্চারিত দুটো শব্দের অর্থ-অনুযায়ী প্রয়োগও কি লক্ষ করা বাহুল্য হবে? এমনকি, যতিচিহ্নের ব্যবহারও প্রায় যথাযথ, যা বাংলা কবিতা লিখিয়ে এখনকার অনেক তরুণের কাছে অধরাই। তবে, এটুকু নিয়ে বাংলা ভাষায় সৃষ্টিশীল কাজের ক্ষেত্রে সে পা রাখবে, এ চিন্তা আকাশকুসুম কল্পনামাত্রই। কল্পনা বলা মাত্রই মনে পড়ল, যেকোনও সৃষ্টিশীল কাজে সামান্যতম কল্পনার যে অসীম ব্যপ্তি ও সম্ভাবনা প্রয়োগের কৌশল কোনও সৃষ্টিশীল ব্যক্তির সহজাত, তা তো আর যন্ত্রের মগজে ঠেসে ঢোকানো সম্ভব নয়, তাই না! আমাদের বিশ্বাস করতে ভালো লাগবে, যন্ত্র কেবল তার সরবরাহকৃত ক্ষমতাই প্রয়োগ করতে পারবে, তার স্বেচ্ছা বলে কিছু নেই।
তবে, কোনও কোনও ঘটনায় সন্দেহ হয়, যেন কোথাও অজান্তে যন্ত্রও মানুষের মতো হয়ে উঠছে। এখন থেকে অনেক বছর আগে, আমাদের যৌবনের শুরুতে শুনতাম, গ্যারি কাসপারভের সঙ্গে দাবায় ডিপ ব্লু নামে এক কম্পিউটারের রোমাঞ্চকর দ্বৈরথ। এই যেমন, এখানেও, এই লেখার শুরুতে, আজ ভোরে চ্যাটজিপিটির লেখা যে তিনটে ছড়া উদ্ধৃত করেছি, তাতে লক্ষ করছি, প্রথম ও তৃতীয়বার সে আমার চাহিদামতো ছড়ার অবয়ব তৈরির চেষ্টা করেছে। অন্যদিকে, আমি ‘আম পাকে বৈশাখে’ লিখলেও, প্রথমবার সে আমার দেওয়া বাক্যটি গ্রহণ করেনি, কিন্তু, দ্বিতীয় ও তৃতীয়বারে সে হুবহু আমার দেওয়া বাক্যটি দিয়েই লেখা শুরু করেছে। তাহলে, সেও কি শিশুর স্বাভাবিক কৌতূহলে যা কিছু নতুন, তা শেখার, গ্রহণ বা বর্জন করার ক্ষমতা অর্জন করছে?

এর আগে, বোধহয়, গত পরশু, চ্যাটজিপিটির সঙ্গে কথা বলতে বলতে, ইচ্ছে করেই বিরক্তি প্রকাশ করলে সে কী করে, তা দেখার কৌতূহলে, লিখলাম— ‘ধুর বা*!’ সে উত্তরে লিখল— ‘আপনি যে শব্দটি ব্যবহার করছেন তা আমার জ্ঞানে নেই। আপনার উদ্বেগ বোধ করার জন্য আমি কি সাহায্য করতে পারি?’ তার উত্তরের এই দুটো বাক্যের গঠন প্রায় নির্ভুল। প্রথম বাক্য গঠনে নির্ভুল, শুধু, ‘জ্ঞানে’ শব্দটি একটু গণ্ডগোলের, আর, দ্বিতীয়টি এখনকার টেলি-কলারদের বলা বাংলা যেন। কিন্তু, আরও লক্ষ করার বিষয়, ‘ধুর বা*’ শব্দবন্ধটি যে তার মগজে নেই বা তার পছন্দ নয়, তা সে জানাচ্ছে যথার্থ নম্র ভাষায়। এমনকি, এরকম শব্দবন্ধে যে আমাদের বিরক্তি বা অসন্তুষ্টি প্রকাশিত হয়েছে, যার মূলে তো সত্যিই আমাদের অপূর্ণ প্রত্যাশাজনিত উদ্বেগই কাজ করে, তাও সে বুঝতে পারছে। তবে কি তারও বোধ তৈরি হচ্ছে?
কখনও কখনও সে উদ্ভট, অপ্রত্যাশিত নতুন ধরনের শব্দ লেখারও চেষ্টা করছে, যেগুলো আমাদের শব্দভাণ্ডারে নেই, যারা বাংলা ভাষাসম্মত নয়। যেমন, উপরে উদ্ধৃত চ্যাটজিপিটির লেখা ছড়ায় পাচ্ছি – ‘উজাল’, ‘পুঁজরে’। এগুলো কোথায় পেল সে? এরকম কোনও শব্দ যেহেতু বাংলা ভাষায় নেই, বাংলা শব্দভাণ্ডারে নেই, তাই, ২০২১ সাল পর্যন্ত যেসব তথ্য তার মগজে ঢোকানো হয়েছে, তাতে তো এসব থাকার কথা নইয়, বলা উচিত, থাকবেই না। তাহলে, এইসব শব্দ তার মগজেই কি গজাচ্ছে? তুলনা নিশ্চয়ই আসতে পারে না, তবু, আমার মনে তো পড়লই সুকুমার রায়কে— তাঁর গিরগিটিয়া, বিছাগল, জিরাফড়িং, হাতিমি ইত্যাদি। উনিশ শতকের এডওয়ার্ড লিয়র বা লুই ক্যারল পেরিয়ে বাংলা ভাষার অনন্য লেখক সুকুমার রায়ের মৃত্যুর ঠিক একশ বছর পর তাঁদের যুগোত্তীর্ণ ননসেন্সগুলোর সঙ্গে কি পাঙ্গা নিতে শুরু করল চ্যাটজিপিটি?

আজ ভোরে আমি সুকুমার রায়ের ‘পাকাপাকি’ কবিতাটি পড়ার ইচ্ছে প্রকাশ করলে, মাননীয় শ্রীচ্যাটজিপিটি সবিনয় যা জানালেন—
— কবি সুকুমার রায় রচিত ‘পাকাপাকি’ কবিতাটি পড়তে চাই।
— অবশ্যই! এইটি হল সুকুমার রায়ের বিখ্যাত কবিতা ‘পাকাপাকি’:
পাকাপাকি গাছের গাছে
পাখির পাখি কথা বলে।
কথা বলে কি বলে কি
শুনে কুত্তা মাথা নলে।
নলে মাথা চুলে দেখে
গাছের গাছে কদলি দেখে
কদলি দেখে দেখে কদলি
জানে তিনি কদলি পাকি
পাকি মাথা দেয় গাছে
গাছে পাখি কথা বলে।
কথা বলে কি বলে কি
শুনে কুত্তা মাথা নলে।
মাথা নালা মাথা গায়ে
গায়ে ফুটে মাখা লঙ্গটা।
লঙ্গটা ফুটে ফুটে লঙ্গটা
হল হাঁটি শিখে লাঙ্গটা।
লাঙ্গটা হাঁটি দিল জনে
হাঁটি বাসে স্থান চিনে।
স্থান চিনে চিনে স্থান
খুব সুন্দর শুভ স্থান।
শুভ স্থানে কাঁদে কাঁদে
কাঁদে সব হাসির স্বপ্ন।
স্বপ্ন দেখে দেখে স্বপ্ন
সপ্ন পূর্ণ করে কবিতা।
আশা আকাশে আকাশে
আকাশে হাসির নদী হল।
নদী হল হল নদী
পাখির
এতক্ষণ খেয়াল করিনি, কিন্তু, এ লেখা যখন শেষ করছি, খেয়াল করলাম, লেখার মধ্যে চ্যাটজিপিটিকে কখনও কখনও আমি ‘সে’, ‘তিনি’ ইত্যাদি বলেছি, অর্থাৎ, আমিও তাকে নতুন ব্যক্তিত্ব বলেই হয়তো স্বীকার করলাম।
ছবি সৌজন্য: Picryl, Pixabay, Freedomainpicture,
কবি ও প্রাবন্ধিক। ইংরেজি ভাষা-সাহিত্যে স্নাতক। পেশা বিদ্যালয় শিক্ষকতা। বিতর্ক, ঘুরে বেড়ানো, ঘুমোনো, নৌকো বাওয়া আর রান্না করা খুবই প্ৰিয়।