আগের পর্বের লিংক: খলিল জিব্রানের দ্য প্রফেট-এর অনুবাদ: কথামুখ, প্রেম, বিবাহ, সন্ততি

দান ও দাক্ষিণ্য

এবার এক ধনীজন তাঁকে বললেন, দান সম্পর্কে আমাদের কিছু বলুন।
তিনি বললেন:
তুমি দান করলে, কিন্তু তোমার সে বস্তুদান হবে সামান্য, যতক্ষণ না তুমি তোমার সবটুকু উজাড় করে দিতে পারছ। যখন তুমি নিজেকেও উজাড় করে দাও, তখনই তা সত্যিকারের দান হয়ে ওঠে।
বুঝতে হবে যে, ঠিক কোনটি তোমার স্বধন এবং একই সঙ্গে এও বুঝতে হবে যে ভবিষ্যতে কাজে লাগবে ভেবে, ঠিক কোনটিকে সযত্নে রক্ষাও করে চলেছ তুমি।
কিন্তু কী সেই ভবিষ্যৎ? ভবিষ্যৎ কি এনে দেবে অতি বিচক্ষণ এবং দূরদর্শী সেই কুকুরটিকে, যে হাড়ের টুকরোগুলিকে চিহ্নহীন বালিতে লুকিয়ে, তীর্থযাত্রীদের অনুসরণ করে ছুটতে থাকে পবিত্র নগরীর দিকে?
বুঝতে হবে, এ কি তোমার অভাববোধ, না কি অভাবজনিত নিরাপত্তা।
যেমন, ইঁদারাটি পরিপূর্ণ দেখেও, জল ফুরিয়ে যাবার ভয়েই, তোমার তৃষ্ণা মেটে না।
এমন অনেকেই আছে , যারা ধনবান হয়েও সামান্যই দান করেন – তাও আবার সম্মান ও  খ্যাতির আশায় এবং খ্যাতির এই সুপ্ত লোভই তাঁর দানকে অসম্পূর্ণ করে দেয়।  
আবার এমন মানুষও আছে, যাদের সম্পদ স্বল্প, তবু তারা তদের সবটুকুই বিলিয়ে দেয়।
এরা যেমন জীবনে বিশ্বাসী, তেমনই বিশ্বাসী জীবন প্রাচুর্যেও, তাই তাদের ভাঁড়ারও  কক্ষনও শূন্য হয় না।
আর, যারা সানন্দে দান করে, তৃপ্তির সেই আনন্দই তাদের পুরস্কার।
দান করে যারা কাতর হয়ে পড়ে, সেই বেদনাই তাদের খ্রিস্টীয় দানোৎসব।

কেউ কেউ এমনও আছে, যারা দাতা হয়েও না জানে কাতরতা, না খোঁজে আনন্দ, না তারা দান করে সচেতন কোনও গুণের বশবর্তী হয়ে।
তাদের দান যেন সমুদ্র উপত্যকার অদূরে, ওই মেহেদি গাছটি, যা তার নির্গত শ্বাসে সুগন্ধ ছড়ায় চারিপাশে।
এদের হাতের স্পর্শেই তো ঈশ্বর কথা কয়ে ওঠেন এবং তাদের চোখের অন্তরালে থেকে, তিনিই এ পৃথিবীতে তাঁর প্রসন্ন হাসিটিও হাসেন।
প্রার্থী হাত পেতে দাঁড়ালে যাচিতকে যে দান, সে তো শ্রেয় বটেই। কিন্তু নিজের অনুভবে অযাচিত দানই শ্রেষ্ঠতম।
উন্মুক্ত – অঞ্জলিদাতার কাছে তার নিজের দানের অধিক আনন্দই হল, কোনও গ্রহীতাকে খুঁজে পাওয়া।
আর কী এমন তোমার আছে, যা তুমি কুক্ষিগত করে রাখবে?
কোনও না কোনওদিন তোমাকে তো সর্বস্ব দিয়ে দিতেই হবে।
তাই, এখনই দিয়ে দাও, কারণ এই দেওয়ার মরসুমটি তোমারই হতে পারে, যা কিন্তু তোমার উত্তরাধিকারীদের নয়।

তুমি প্রায়শই বল যে, “দান আমি করব, কিন্তু তা শুধু তাকেই যার এই দান প্রয়োজন।”
তোমার বাগানে ফলের গাছগুলি কিন্তু এভাবে বলে না। এমনকী বলে না তোমার তৃণভূমির ওই ঘাসগুলিও।
দেওয়ার শর্তেই তো তাদের জীবন, কারণ না দিতে পারা মানে তো এক অর্থে তারাও নিঃশেষিত।
নিশ্চিত জানবে যে, সে-ই হল যোগ্য গ্রহীতা, যে তার দিন এবং রাত্রিগুলি দান হিসেবেই পেয়েছে এবং যা তোমার তাবৎ দানের থেকেও মহার্ঘ্য।
এবং জীবনসমুদ্র থেকে পান করবার যোগ্যতা যে রাখে, সে নিশ্চিত তোমার ওই ছোট্ট নদীটি থেকে তার নিজের পেয়ালাটিও ভরে নেওয়ার যোগ্য।
আর সেই প্রত্যাখ্যান, যার মধ্যে অন্তর্নিহিত রয়েছে সাহস এবং প্রত্যয়, তার থেকেও কি বৃহত্তর হতে পারে দান বা গ্রহণ?
এবং কে হে তুমি, যে অন্য কেউ তোমার সামনে, তাদের বুক চিরে নিজেদের আবরণ মুক্ত করবে, যাতে তুমি দেখতে পাও কী তাদের গর্ব, বা নগ্ন মূল্য, বা কী তাদের অহংকার? 
প্রথমত দেখ, যে তুমি নিজেই নিজের কাছে একইসঙ্গে দাতা এবং সহায়ক সেই দানপাত্র হিসেবে গ্রহণযোগ্য কিনা।
অকাট্য সত্য এই যে, জীবন কিন্তু শেষ মুহূর্ত অবধিও জীবন দান করে। সেখানে এই যে তুমি নিজেকে মনে করছ একজন দানী বলে, আসলে কিন্তু তুমি তার সাক্ষীমাত্র।
আর এই যে গ্রহীতার দল, তোমরা তো আসলে সকলেই গ্রহীতা; তাই অনুমানও করছ না, কী সেই কৃতজ্ঞতার ভার, কারণ পাছে তার জোয়ালটি তোমার এবং তোমার দাতার ওপরে বর্তায়।
বরং দাতার ওই উপহারের ঊর্ধ্বে এমনভাবে একইসঙ্গে দু’জনেই ওঠ, যেন তা তাঁর দু’টি ডানা হয়ে যায়।
কারণ, তাঁর কাছে তোমার ঋণ বিষয়ে যদি তুমি অতি সতর্ক হয়ে যাও, তাহলে তোমার সন্দেহই প্রকাশ পাবে তাঁর বদান্যতায়, যাঁর এক পৃথিবী মুক্ত হৃদয় আছে একদিকে জননীর জন্যে, আর অন্যদিকে জনকের জন্যে আছেন ঈশ্বর।

Mandar Mukhopadhyay

আড্ডা আর একা থাকা,দুটোই খুব ভাল লাগে।
লিখতে লিখতে শেখা আর ভাবতে ভাবতেই খেই হারানো।ভালোবাসি পদ্য গান আর পিছুটান।
ও হ্যাঁ আর মনের মতো সাজ,অবশ্যই খোঁপায় একটা সতেজ ফুল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *