এখন করোনা আতঙ্কে লকডাউনের আবহে খুব দরকার না হলে বাড়ি থেকে বেরোনো প্রায় একেবারেই বন্ধ সব জেনে শুনেও মাঝে মাঝে একটু বিরক্ত হয়ে পড়ছি বৈকি। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেই চোখে পড়ছে ফাঁকা রাস্তা আর গাছের ফাঁক দিয়ে নিঃশব্দ নন্দদুলাল মন্দির আর মন্দিরের সামনের   বড় মাঠটা। কোনওটা নিয়েই কোনওদিন বিশেষ মাথা ঘামাই নি রোজ সাড়ে পাঁচটা টা নাগাদ স্কুল সেরে ফেরার সময়, দেখি ছেলেরা ফুটবল খেলছে, বুড়োরা মাঠের ধারে সিমেন্টের বেঞ্চে বসে আড্ডা দিচ্ছে বা নাতির হাত ধরে স্ট্রান্ডে হাওয়া খেতে যাচ্ছে ইদানিং চন্দননগর কর্পোরেশন-এর উদ্যোগে মন্দিরের পেছনের পুকুরের পাশটা বাঁধিয়ে একটা পার্ক গোছের করা হয়েছে জায়গাটা বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে বেঞ্চ বসানো হয়েছে, সুন্দর সিঁড়ির ধাপ নেমে গেছে জলে আর আলোয় ঝলমল করছে জায়গাটা শনিবার স্কুলের হাফডে  থাকে বলে দুপুরে বাড়ি ফিরি স্টেশন থেকে রিক্সা বা টোটো প্রায়শই মন্দিরের পেছনের রাস্তা ধরে এসে আমাকে মন্দিরের সামনে বাড়ির গেটের কাছে নামিয়ে দেয়I সেই সময় দেখতে পাই আমাদের পাড়ার আলোদি নতুন হওয়া সেই শান বাঁধানো ঝকঝকে সিঁড়ির ওপর চুপ করে বসে ছিপ দিয়ে মনোযোগ সহকারে মাছ ধরছে কি কন্সেন্ট্রেশনউস্কখুস্ক চুল আর সাত জন্মে না কাচা নোংরা শাড়ি পরা আলোদির সেই গম্ভীর মুখে কি কনফিডেন্স! যারা ওকে পাগল বলে তারা নিশ্চয় ভুল বলে মাঝে মাঝে  অবশ্য মনে হয় যে আলোদি সত্যিই মাছ ধরছে নাকি বেঞ্চে বসে যে কলেজের ছেলেমেয়ে গুলো প্রেম করছে, তাদের কথা শুনছে? সাহস করে জিজ্ঞেস করা হয় নি কোনওদিন কারণ আমাকে টোটো থেকে নামতে দেখলেই আলোদি আরও গম্ভীর হয়ে মাছ ধরায় মন দেয় আমি আবার মাঝে মাঝে ভাবি, অনেকের কাছে শুনেছি ক্লাইভ চন্দননগর আক্রমণ করার সময় ওই পুকুরে নাকি অনেক কিছু ধন সম্পদ লুকিয়ে রাখা হয়েছিল আলোদি যদি কোনও এক নির্জন দুপুরে সে সবের সন্ধান পেয়ে যায়? কী কান্ডটাই না হবে তাহলে! এসবই যে আমার অতিরিক্ত ইতিহাসচর্চার সাইডএফেক্ট সেটা বুঝতে পেরে আবার ভরদুপুরে রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে নিজেই এক চোট হেসে নিই 

মন্দির দুপুরে বন্ধই থাকে ঠিক সন্ধে সাড়ে সাতটা আটটা নাগাদ আরতির কাঁসর ঘন্টার আওয়াজে সারা পাড়া মুখর করে ওঠে সেই সময় আবার বেশ  কিছু ভক্ত সমাগম হয় তারপর সাড়ে আটটা বাজতে না বাজতেই মন্দির বন্ধ আড্ডাটা কিন্তু চলতেই থাকে ছেলেরা মাঝে মাঝে নেট  টাঙিয়ে  ব্যাডমিন্টন খেলে আর পাড়ার লোকজন মাঠ গোল হয়ে বসে গপ্পো জোড়ে রোজ একই জিনিস দেখতে দেখতে এতদিন আলাদা কিছুই মনে হত নাকিন্তু কদিন ধরে মনে হচ্ছে, কারণ এসব এখন আর কিছুই হয় না মন্দিরের মাঠে বা পেছনের পুকুরে এখন কেউ থাকে না, পুজো কখন হয় বোঝা যায় না। খালি দেখা যায় পুলিশ টহল দিচ্ছে, যাতে একটা ছেলেও মন্দির চাতালে না বসে করোনা আতঙ্কে যদ্দিন লকডাউন চলবে তদ্দিন এই ব্যবস্থা বলবৎ থাকবে পাড়া এখন নির্জন, সবাই বাড়ির ভেতরে কেমন যেন মন কেমন করে, কদিন ধরেই মনে হচ্ছে আবার কবে মন্দিরের মাঠ সরগরম হয়ে উঠবে? মন্দিরের মাঠ সরগরম হয়ে ওঠা মানে সারা পাড়া গমগম করা ধর্মাচরণ বা সংস্কৃতি চারণ যাই হোক না কেন, চেয়ারে চেয়ারে মাঠ ভরে যাবে, মাইকের আওয়াজে কানের বেশ ভাজা ভাজা অবস্থা হবে, মন্দিরের সাদা শ্বেতপাথরের চাতালটা একটা স্টেজ হয়ে উঠবে, যেখানে ছেলে মেয়েরা নাচবে গাইবে, লোকাল কোনও শিল্পী তাঁর শৈল্পিক প্রদর্শন ঘটাবেন এই কথা মাথায় রেখেই তো পুরনো ভাঙা চাতালটা ঢেকে তাতে নতুন শ্বেতপাথরের জামা পরানো হয়েছে ঐতিহ্য সংরক্ষণ হয়েছে বৈকি! এর জন্য আবার পুরাতত্ত্ব বিভাগের সহায়তা লাগে নাকি? কেউ দেখতে পাক আর না পাক, পাথরের তলায় দিব্বি সংরক্ষিত হয়ে রইল তিন শতাব্দীর ইতিহাস পাকা মাথার কাজ একেই বলে!

souptik choudhury

খালি ঘর আর ঘর  – সময় যেন থমকে গেছে নিজেকে কেমন যেন বেশ ডিকেন্সের মিস হ্যাভিশ্যামের মতো লাগছে বাগান পেরিয়ে দু একবার  গেটের বাইরে যে চোখ রাখিনি তা নয় আমাদের বাড়ির সামনের শিব পুকুরের ধারের বাড়িগুলোর সমস্ত দরজা বন্ধ চোখটা নিজের অজান্তেই চলে গেল বাঁদিকে কালিদাস চতুষ্পাঠীর দিকে নোনাধরা হলুদ দেওয়ালের গায়ে একটা শ্বেতপাথরের ফলকে লেখা আছে১৮৩২’ আমার জ্ঞানত আমি কোনওদিন এই চতুষ্পাঠীতে কাউকে বিদ্যাশিক্ষা করতে দেখি নি বাবার কাছে শুনেছি উনি ছোটবেলায় দেখেছিলেন যে বেশ কিছু ছাত্র নাকি ওখানে হস্টেলের মতো করে থাকত আর সন্ধে হলেই প্রদীপ জ্বেলে পুঁথি পড়ত এখন কারা থাকে ঠিক জানা নেই চতুষ্পাঠীটাকে বেশ কিছুদিন বাদে দেখতে পেয়ে আমার বেশ আনন্দই হল অথচ আমি যে ঠিক চতুষ্পাঠীর কথা ভাবছিলাম তাও নয়, আমার চোখ ছিল তার সামনের ফাঁকা জায়গাটার দিকে ওইখানেই তো প্রত্যেক বছর জগদ্ধাত্রী পুজোর প্যান্ডেল হয়, ওইখানেই তৈরি হয় বিশাল জগদ্ধাত্রী প্রতিমা তার কত গয়না, কত জাঁক, কত আলো, কত মানুষের ভিড় হয় ওখানে এবারে কী হবে? কে জানে! অথচ প্রত্যেক বছর যখন জগদ্ধাত্রী পুজোর সময় স্কুল থেকে ফেরার সময় স্টেশন থেকে ভিড়ের মধ্যে দিয়ে দু কিলোমিটার হেঁটে হাক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরতে হয়, তখন কী বিরক্ত যে লাগে কি বলব! কিন্তু এখন কেন খারাপ লাগছে? চন্দননগরেরসুমহান ঐতিহ্য’ বলে এত বছর গলা ফাটিয়েছি বলে? অত্যন্ত অভ্যস্ত এক জিনিসের অভাব বোধ করব বলে? অভ্যাস বড় বিষম দায় কিন্তু মানুষের জীবনের দায় তো আরও অনেক বেশি। সত্যিই বড় অদ্ভুত সময়; মনও বড় অদ্ভুতকী চায় আর কী যে চায় না ঠিক বুঝে ওঠা দায়। মনটা  তো স্টেশনের সেইসব ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলোর কথাও ভাবছে, যারা রোজ সকালে এসে হাত পেতে দাঁড়ায়, “আজ বিস্কুট খাবার পয়সা দেবে না?” তারা কীভাবে আছে, কে তাদের খেতে দিচ্ছে কে জানে! শুনছি অবশ্য কিছু সহৃদয় মানুষ তাদের দায়িত্বভার নেবার জন্য এগিয়ে এসেছেন জগতের উদ্ধারকর্ত্রী মনে হয় এইসব শিশুরা সুস্থ থাকলে, তারা খেতে পেলে, বেশি খুশি হবেন                                   

অনেকদিন স্ট্রান্ডে যাওয়া হয় নি শুনেছি সে রাস্তা এখন জনমানবহীন বেঞ্চগুলো ফাঁকা, ঘাটগুলো শূন্য নীল আকাশের তলায় এখন কেবল পাখির কিচিরমিচির আর গাছের ছায়ায় কাঠবেড়ালির ছুটে বেড়ানো ভাবা যায়? সেই মর্নিং ওয়াকার ফোরাম, লাফিং ক্লাব, যোগ ব্যায়ামের ক্লাব বা এমনিই  যাঁরা ভোরবেলা হেঁটে বা দৌড়ে শরীর চর্চা করেন, যাঁরা ঘাটের সিঁড়ি তে ভোরবেলা একসঙ্গে বসে গলা মেলান, “আকাশ আমায় ভরলো আলোয়, আকাশ আমি ভরবো গানে“, যাঁদের শীত গ্রীষ্ম বর্ষা কখনোই ঘরে আটকে রাখা যায় না, তাঁরা আজ গৃহবন্দী? মানুষের অদম্য ইচ্ছা কে দমিয়ে দিল শুধু একটা অমানবিক রোগের ত্রাস? যেসব ছোট ছোট  ছেলেমেয়েরা পয়লা বৈশাখের সকালে অনুষ্ঠান করবে ভেবেছিলো তাদের  নিশ্চয় খুব মনখারাপ আচ্ছা, সেই যে কারা যেন, যারা ভাঙা ঘাটটার কাছে বড় গাছটার তলায় বছরের পর বছর প্লাস্টিকের তাঁবুর তলায় সংসার বিছিয়ে আছে, তারা কি এখনও ওখানে? নাকিদের ঠাঁই হয়েছে কোনও সরকারি ক্যাম্পে? সেই অসংখ্য ছোট ছোট খাবারের দোকানগুলো যাদের জীবিকা যোগায় স্ট্রান্ডে বেড়াতে আসা মানুষজন, তারা কী করছে? এসব চিন্তাই মনে ভিড় করে আসে অনবরত নদীর কাছে  যেতে বড্ড  ইচ্ছে  করছে কিন্তু ওই যে,  মাঝখানে  আবার দুস্তর বাধা থাক! নদী এখন একটু বুক ভরে নিঃশাস নিক। দুনিয়াটা তো উল্টে পাল্টে যাচ্ছে। এই উল্টে পাল্টে যাওয়া দুনিয়াটার সঙ্গে তাকে আবার লড়তে হবে তো! 

পেশায় শিক্ষিকা পূর্বা শিক্ষকতার পাশাপাশি ইতিহাস ও সংরক্ষণ বিষয়ে গবেষণায় রত। তিনি 'হুগলি রিভার অফ কালচারস পাইলট প্রজেক্টের' সঙ্গে যুক্ত ইউনিভার্সিটি অফ লিভারপুল ও ভারত সরকারের উদ্যোগে যেটার কাজ চলছে।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *