দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারতে ফেরার পর গান্ধীজির আন্দোলনের মূল পথই ছিল সত্যাগ্রহ। বিহারের চম্পারন জায়গাটি বিখ্যাত হয় গান্ধীজির প্রথম সত্যাগ্রহ আন্দোলনের কারণে। ১৯১৭-১৮ সালে নীলকর সাহেবদের অত্যাচারে নীল চাষিদের অবস্থা তখন শোচনীয়। ভাগচাষিদের জমির ভাগ বজায় রাখতে গেলে বাধ্যতামূলকভাবে নীল চাষ করানো হত। এবং প্রায় বিনা মজুরিতে। চম্পারনও তার ব্যতিক্রম ছিল না। গান্ধীজি সে সময় চম্পারনে যান এবং নীলচাষীদের ব্যাপারে খোঁজখবর শুরু করেন, বিপ্লবী সচেতনতা প্রচার করতে থাকেন। ফলে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে চম্পারন ছেড়ে চলে যেতে বলে। প্রচণ্ড ক্ষোভে তিনি আইন অমান্য করেন আর তার ফলস্বরূপ গ্রেফতার হন। পরে সমর্থকদের আন্দোলনের মুখে পড়ে সরকার তাঁকে নিঃশর্তে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। স্বাক্ষরিত হয় ‘চম্পারণ কৃষি বিল’ যা পরে আইনে রূপান্তরিত করা হয়।
এ তো গেল চম্পারনের ঐতিহাসিক খ্যাতির কথা। কিন্তু খাদ্য সংস্কৃতিতেও এই চম্পারনের বেশ সুনাম রয়েছে। বিশেষত পূর্ব ভারতের আঞ্চলিক আমিষ খানাখজ়ানায়। চম্পারন মাটন বা চম্পারন চিকেন কিম্বা চম্পারন ল্যাম্ব আজ অনেক ভারতীয় রেস্তোরাঁর মেন্যুতে ঠাঁই করে নিয়েছে। বিহারের বিশেষ এক রন্ধনশৈলীই শুধু নয়, পূর্ব ভারতের রান্নায় ব্যাবহৃত মশলাপাতি আর ঘানির সরষের তেলে সুপরিপক্ক এই মাংসের বিশেষত্ব হল মাটির হাঁড়িতে দমে রান্না।
মাটির হাঁড়ির মুখ আটার পুলটিস দিয়ে আটকে দেওয়ার কারণে হাঁড়ির অন্দরের কোনও মশলার সুগন্ধ বাইরে বেরুতে পারে না আর ধিকিধকি আগুনে জল ছাড়া অনেকক্ষণ ধরে মাংস রান্না হয় । মুরগির ক্ষেত্রে সময়টা কম আর মাটনের ক্ষেত্রে বেশি সময় লাগে, বলাই বাহুল্য । এই সুসিদ্ধ মাংস, ভাত বা রুটি বা পোলাওয়ের সঙ্গে পরিবেশিত হয় এক টুকরো পেঁয়াজ আর কাঁচালংকার সঙ্গে। এটাই বিহারী কায়দা। ঐতিহ্যগতভাবে মাটির হাঁড়িতে বা মটকায় দম স্টাইলে রান্না করা হয় চম্পারণ মাংস। তাই বুঝি একে হাণ্ডি মাটন / আহুনা মাটন বা মটকা গোস্তও বলে।

এভাবে দমে বসানো রান্নার প্রযুক্তি ভারতীয় রান্নায় নতুন নয়। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, সর্বত্রই নিজস্ব ঘরানায় এই দমে বসানোর পদ্ধতি আছে। দম পুক্ত বা দমপোক্ত এখন দেশীয় রেস্তোরাঁয় পাকাপাকিভাবে জায়গা করে নিয়েছে। আধুনিক কেটারারের কৃপায় নিমন্ত্রণ বাড়িতেও কাতলার দমপোক্ত কিম্বা মাংসের স্বাদের সঙ্গে আমরা বেশ পরিচিত এখন। ‘দম’ মানে নিঃশ্বাস আর পুক্ত মানে রান্না করা। অর্থাৎ গোদা বাংলায়, মুখবন্ধ পাত্র থেকে রান্নার কোনও গন্ধ বাইরে বেরুবে না।
ফারসি মতে বিরিয়ানি তৈরির যথার্থ পদ্ধতি হল এই দম পুক্ত। মানে ধীরে ধীরে রান্না হতে দিতে হবে। ফারসি ভাষায় দম পুক্ত কথার অর্থ হল, ঢিমে আঁচের উনুন। অর্থাৎ অনেকক্ষণ ধরে নীচে আঁচ, ওপরে আঁচ থাকবে। ভেতরে সব একসঙ্গে সুপরিপক্ব হবে, খাদ্যের গুণমান ঠিক থাকবে। মশলাপাতির সুঘ্রাণ বজায় থাকবে আঁটসাঁট পাত্রের মধ্যে। বাঙালিদের বাটিচ্চচড়িও অনেকটা এমনই। অথবা যদি বলি গায়ে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের উদ্ভাবিত মাখা মাখা আলুরদম? কিম্বা ভাপা মাছ বা মাংস? এই স্লো কুকিং হল দম পোক্তর মোদ্দা কথা, যার ফলস্বরূপ হায়দ্রাবাদের “দম কা গোস্ত” বা মাংসের দমপোক্ত অনবদ্য এক পদ। আর সবরকম মশলাপাতির জোগাড় করে তবে এই রান্না দমে বসবে।
আমি দেখেছি এভাবে হাঁড়ির মাথায় বসানো ঢাকায় টিকেয় আগুন দিয়ে দমে মাংস বা পোলাও রান্না। মানে আধুনিক ওটিজির অনুরূপ। মানে নীচ আর ওপর দুদিক থেকেই তাপ পাবে হাঁড়ির অন্দরের মাংস বা চাল। এই হল দম কা গোস্তের ঐতিহ্য। তবে ভারতীয় রন্ধনের বৃত্তান্ত ঘেঁটে যা দেখলাম, সেখানে বিহারের চম্পারন জেলার আর একটি রান্না চোখে পড়ল। তার নাম চম্পারন মাটন। মুরগি দিয়েও বানানো হয়।
দমে বসানো মাংসে তো আর প্রেশারের সিটি পড়বে না, তাই টাইট করে মুখ এঁটে বহুক্ষণ ঢিমে আঁচে বসিয়ে তাকে নরম এবং তুলতুলে করতে হয়। সবশুদ্ধ বসবে দমে। মাটির হাঁড়ির মুখ আটকাতে হবে মাখা আটা দিয়ে। এবার দমে বসে ধীরে ধীরে মাংস সেদ্ধ হবে। বেহুলার লোহার বাসরঘরের মতো নিশ্ছিদ্র হবে সেই দমে বসানো হাঁড়ির নিরাপত্তা। কোনও মশলার গন্ধ যেন বাইরে না বেরোয়।

কে এই রন্ধন পদ্ধতির প্রবর্তক? ইন্টারনেট জানাচ্ছে, সপ্তদশ শতকের নবাব আসফ-উদ-দৌলাহ। বিরিয়ানির আবিষ্কার নিয়ে গবেষণা করতে করতে আমরা জেনে ফেলেছি সেই বৃত্তান্ত। লখনউয়ের বড়া ইমামবাড়ার সূচনা হয়েছিল দুর্ভিক্ষের সময় গরিব প্রজাদের কাজ দেওয়ার জন্য। শ্রমিকরা দিনের বেলায় যেটা তৈরি করত, রাতে সেটাই রাজকর্মচারীরা ধূলিসাৎ করে দিতেন। নবাবের উদ্দেশ্য যতটা না ছিল ইমামবাড়া বানানো, তার চেয়েও বেশি দীর্ঘদিন ধরে প্রজাদের কাজ দেওয়া। প্রকাণ্ড হাঁড়িতে চাল, মাংস, সবজি ইত্যাদি মিশিয়ে ঢাকা এঁটে দেওয়া হত। একসঙ্গে বহু মানুষের পুষ্টি জোগানোই ছিল এই রান্নার উদ্দেশ্য। মূলত এটি আওয়াধি খাবার।
কারও মতে বিহারের মোতিহারি, আবার কারও মতে নেপালের সীমানায় ঘোরাসাহান, যেখানে প্রথম চম্পারন মিট হাউজ খোলা হয়। কিলো হিসেবে বিক্রি হয় হাঁড়িবন্দি চম্পারন মাংস। জল ছাড়া মাংস সেদ্ধ হয় দমে, তাই মাংসের টুকরো ছোট হওয়া আবশ্যক। অর্থাৎ প্রতিটি মাংসের টুকরো কোনওমতেই ৫০-৭০ গ্রামের বেশি হবে না। মাংসের টুকরোগুলো টক দইতে ম্যারিনেট করতে হয় পেঁয়াজ কুচি, আদা-রসুন বাটা, গোটা গোলমরিচ, গোটা শুকনোলংকা, নুন, হলুদগুঁড়ো, লংকাগুঁড়ো, গরমমশলা, তেজপাতা আর ঘি দিয়ে। মাথায় রাখতে হবে এটি বিদেশের ওয়ান পট রেসিপির সমতুল। একেবারে সবশুদ্ধ দিয়ে বসাতে হবে দমে।

রসুনবাটা ছাড়াও একটি গোটা রসুন পড়বে মাংসের মধ্যে। প্রত্যেকের পাতে মাংসের সঙ্গে চার-পাঁচ কোয়া গোটা রসুন যেন পড়ে। সেটাই ট্র্যাডিশন। হাঁড়ির মধ্যে প্রথমে সরষের তেল বেশ গনগনে করে গরম করে নিতে হবে। এবার সবশুদ্ধ সেই ম্যারিনেটেড মাংস ঢেলে দিতে হবে তার মধ্যে। এবার সিল করে দিতে হবে হাঁড়ির মুখ। এ মাংসের রেসিপিতে প্রথাগত কোনও মাপজোক নেই। এটাই বোধহয় স্বাদের মূলে।
আমার ঠাকুমারও এমন আন্দাজ ছিল। এক চিমটে নুন, এক মুঠো পেঁয়াজ দিতেন ফেলে। জিগেস করলে বলতেন, ও আমার আন্দাজ হয়ে গেছে রেঁধে রেঁধে। ঠিক আমাদের শ্যামবাজারের গোলবাড়ির কষা মাংসের মতোই বিহারের এই চম্পারন মাংসের জনপ্রিয়তাও এখন তুঙ্গে। কলকাতায়ও বিক্রি হয় ওজনদরে। চেখেই দেখুন না!
*ছবি সৌজন্য: জয়ন্ত দত্ত
রসায়নের ছাত্রী ইন্দিরা আদ্যোপান্ত হোমমেকার। তবে গত এক দশকেরও বেশি সময় যাবৎ সাহিত্যচর্চা করছেন নিয়মিত। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায় এহং প্রথম উপন্যাস সানন্দায় প্রকাশিত হয়। বেশ কিছু বইও প্রকাশিত হয়েছে ইতিমধ্যেই। সব নামীদামি পত্রিকা এবং ই-ম্যাগাজিনের নিয়মিত লেখেন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, রম্যরচনা ও প্রবন্ধ।